19291

বিশ্লেষণ: সাম্প্রতিক আত্মহত্যার ময়নাতদন্ত

বিশ্লেষণ: সাম্প্রতিক আত্মহত্যার ময়নাতদন্ত

2020-09-25 20:35:51

"ছেলেরা মেয়েদের ধর্ষণ করে শারীরিকভাবে, আর মেয়েরা ছেলেদের ধর্ষণ করে মানসিক ভাবে উভয় ক্ষেত্রেই ধর্ষিত /ধর্ষিতা নি:শেষিত হয় চরমভাবে। এই জগতে হয়তো শারীরিক ধর্ষণে বিচার পাওয়া যায়, কিন্তু মানসিক ধর্ষণের কোন বিচার নেই। এই ধর্ষণ রয়ে যায় নিরবে নিভৃতে।"

কি আজব! ধর্ষণ বলতে শুধু মেয়েদের যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়াকেই বুঝি। আমরা কি কখনো বোঝার চেষ্টা করেছি কোন ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক কিংবা যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়াকে ধর্ষণ বলা হয়?ধর্ষণের সজ্ঞায় মানসিক ধর্ষণের বিষয়টি যেভাবে উপেক্ষিত হয়েছে তা স্পষ্টই মানসিক স্বাস্থ্যের গুরত্বকে নাজুক করছে।

মানসিক ধর্ষণের পার্থক্য কোথায়?
কখনো কখনো প্রেম নামক জটিল সম্পর্ক ফাঁদে ফেলা হয় নম্র, ভদ্র, মার্জিত স্বভাবের নিরীহ প্রকৃতির মানুষদের যারা ইচ্ছের বিরুদ্ধে করা অসামাজিক কাজের জোরালো প্রতিবাদ করতে পারেনা। বিভিন্ন ভাবে মায়ার জালে ফেলে তাদের ঋণী করা হয়। তখন সুযোগ বোঝে কৌশলে চরিতার্থ করে মনের কামনা- বাসনা।

মানসিক ধর্ষণের শিকার মানুষটি বিষয়টিকে সযত্নে লুকিয়ে রাখে।প্রেমের নামে দিনের পর দিন মানসিক ধর্ষণের শিকার হয়ে আসা মানুষটি সে কথা লজ্জা, ঘৃণা আর অপমানে কারো কাছে প্রকাশ করতে পারে না।
যে সমাজ মনে করে ধর্ষণ একটি মেয়ে সম্পর্কিত ব্যাপার সে সমাজে মানসিক ধর্ষণের শিকার হওয়া ছেলেটি নিজেকে ছেলে হিসেবে ভাবতে কষ্ট হয়। লিঙ্গভেদে হতে পারে তার বিপরীত চিত্র, সেটি ঘটতে পারে কোন মেয়ের ক্ষেত্রেও।

এভাবে ধর্ষণের শিকার হওয়া ছেলেটি/মেয়েটি তিলে তিলে মানসিক ভাবে নি:শেষ হয়ে যায়। মা-বাবা কিংবা সমাজ হয়তো কেউ বিষয়টি বোঝতে পারে না, না হয় বোঝার চেষ্টা করে না। সমাজ হয়তো সেদিন বোঝতে পারে যে দিন প্রিয়জন নিরুপায় হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। হ্যাঁ, আমি অতিসম্প্রতি ঘটে যাওয়া কত গুলো আত্মহত্যার কথা বলছি।শুধু মাত্র ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ জন শিক্ষার্থী আত্নহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।যারা সমাজে শিক্ষিত মেধাবী হিসেবে পরিচিত তাদের এই অসহায় অাত্নসমর্পণ সমগ্র জাতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।একের পর এক অাত্নহত্যা, আত্মহত্যার ধরণ দেখে সব কিছুর মধ্যে যে যোগসূত্রটি খোঁজে পাওয়া যায় তা হল "Poor personal relationship"।কখনো পরিবারের সাথে ব্যক্তির দূরত্ব, কখনো ভালোবাসার মানুষটির সাথে দূরত্ব কখনো বা সহপাঠী বন্ধু-বান্ধবের সাথে দূরত্ব, কখনো বা বৈষম্য।

শুধু মাত্র ২০২০ সালেই সাবেক- বর্তমান মিলিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে।যাদের মধ্যে ৪ জনই স্নাতকোত্তর পাশ, গড় বয়স ২২-৩৫ বছর।ছয়টি আত্নহত্যার মধ্যে ৫ টি আত্মহত্যার ধরণ ও কারণ প্রায় কাছাকাছি।

কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে নিজের পছন্দের মানুষটিকে ভালোবেসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করতে পেরেছে কেউ বা পরিনয়ের আগেই সম্পর্ক খুড়িয়েছে।কারো মনে না পাওয়ার বেদনা, কারো বা পেয়েও পারিবারিক, মানসিক অশান্তি।কারো বা আবার দীর্ঘ দিনের প্রেম ভালোবাসা সম্পর্ক তিক্ততা পৌছেছে।প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্কে পাওয়া না পাওয়া বেদনায় যে ক্ষত তৈরি হয়েছে সেই ক্ষত বিষাক্ত সাপের ছোবলের চেয়ে ও ভয়াবহ আকারে রূপ নিয়েছে।প্রশ্নের মুখে পড়েছে সামাজিক প্রতিষ্ঠান পরিবার ও মানসিক স্বাস্থ্য।যেখানে পরিবারের ভূমিকা থাকার কথা ছিল সবচেয়ে বেশী সেখানে পারিবারিক বন্ধনে দূরত্ব,মানসিক স্বাস্থ্য কে রীতিমত করা হচ্ছে হেলাফেলা।যার ফলে মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হচ্ছে নতুন মুখ।আমরা আত্মহত্যার খবর সগৌরবে শেয়ার করে যাচ্ছি।আত্মহত্যা করার আগে মানুষটি ভাবছে সে যখন আত্মহত্যা করবে তার খবরটি ও বিদ্যুৎ গতি চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে মনে মনে তৃপ্তির ঢেকুর গিলবে।

আমাদের মনে হয় মানসিক স্বাস্থ্য কে গুরুত্ব দেয়ার সময় হয়েছে।গ্রামে গঞ্জে পাড়া মহল্লায় আপতত সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দিতে না পারলেও স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যে যে চির ধরেছে তা নিবারণ যে অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। তা স্পষ্টতই আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
যে মানসিক ধর্ষণ একের পর এক আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিচ্ছে সেই বিষয়টি আইনে অন্তর্গত করা যায় কিনা সিদ্ধান্ত নেয়ার উত্তম সময় মনে হয় চলে এসেছে।

যেভাবে মানসিক ধর্ষণ ক্রমগত বেড়ে চলছে তার থাবা ক্রমশই ভয়াবহ হচ্ছে । প্রতিনিয়ত চোখের সামনে হারিয়ে যাচ্ছে প্রিয় মুখ গুলো। ২০০৫ সাল থেকে ২০২০ সাল (সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০টি আত্বহত্যার মধ্যে অন্তত ১৮ টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে মানসিক ধর্ষণের শিকার হয়ে।

তবুও আমাদের ঘুম ভাঙ্গে না। আমরা নিরব থাকি। আর নিরবে প্রতিনিয়ত মানসিক ধর্ষণ কে সমর্থন দিয়ে যাই।

লেখক:
অভিজিৎ সরকার
অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সম্পাদক: ইসমাঈল হোসাইন রাসেল
যোগাযোগ: ক্যাম্পাস টাইমস
৪৩ শহীদ নজরুল ইসলাম সড়ক, হাটখোলা রোড, চৌধুরী মল, টিকাটুলি, ঢাকা-১২০৩
মোবাইল: ০১৬২৫ ১৫৬৪৫৫
ইমেইল:[email protected]