সিভিল সোসাইটি, সুশীল সমাজ এবং এনজিও সমাচার
2020-10-15 01:23:00
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
‘এনজিও আন্দোলন’ ও ‘সিভিল সোসাইটি’ তথা ‘সুশীল সমাজ’ নিয়ে আমাদের দেশের ‘অভিজাত ভদ্রসমাজের’ একাংশের হৈ-চৈ করে ‘উঠে পড়ে লাগা’ শুরু হয়েছিল বিগত শতাব্দির আশির দশক থেকে। ঠিক সেই সময়টাতে এর সূত্রপাত ঘটে যখন সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী বিশ্বে ও বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘নয়া- উদারবাদে’র নীতি-দর্শন অনুসরণ শুরু হয়েছিল। ঘটনা পরম্পরায় ঘটে যাওয়া এ দু’টি ঘটনার মধ্যে যোগসূত্রটি মোটেও কাকতালীয় ছিল না। তাদের মধ্যে একটি কার্যকরণ সূত্র ছিল। কী ছিল সেটি?
আশির দশকে সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় এক নতুন মাত্রার সংকটের উদ্ভব হয়। এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে পুঁজিবাদের চরম রক্ষণশীল তাত্ত্বিকরা ‘নয়া উদারবাদী’ (neo-liberal) নীতি-দর্শন নিয়ে হাজির হন। আমেরিকা, ব্রিটেনসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে সেই নীতি-দর্শনের তত্ত্ব প্রয়োগ শুরু হয়। এই নীতির প্রায়োগিক উপাদানের মধ্যে ছিল- বিনিয়ন্ত্রণ, বিরাষ্ট্রীয়করণ, উদারীকরণ, মুক্তবাজার, অবাধ বাণিজ্য। ইত্যাদি। ‘বাজার-মৌলবাদ’ (market-fundamentalism) ঘনিষ্ঠ এই নীতির একটি কেন্দ্রীয় নির্দেশনা ছিল, অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা কমিয়ে আনতে হবে। সবক দেয়া হইয়েছিল যে- ‘govt. has no business to do business’। সমাজের সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্ব শুধুমাত্র ‘নিয়ন্ত্রণমুক্ত ব্যক্তিপুঁজি’ তথা ব্যক্তি খাতের হাতে দিয়ে দিতে হবে। এতদিন ধরে রাষ্ট্র যেসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে এসেছে সেসবকে প্রাইভেট সেক্টরে হস্তান্তর করতে হবে।
ঠিক একই সময়ে আমাদের দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘Non Government Organisation- NGO’ (এনজিও) কার্যক্রমের বিশাল উল্লম্ফন ঘটানো হয়। ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমসহ কমিউনিটিভিত্তিক সামাজিক কাজগুলোর দায়িত্ব এনজিও সংস্থাগুলোর হাতে হস্তান্তর করা শুরু হয়। এসব দায়িত্ব থেকে রাষ্ট্রের নেটওয়ার্কগুলো উঠিয়ে নিয়ে তার জায়গায় এনজিও নেটওয়ার্ক প্রতিস্থাপন করা শুরু হয়। একইসঙ্গে, রাষ্ট্রের বদলে ‘সুশীল সমাজ’, ‘সিভিল সোসাইটি’, ‘এনজিও’ ইত্যাদি-ই কেবল ‘উন্নয়নে’র বাহক হতে সক্ষম বলে ‘মগজ ধোলাই’য়ের এক পরিকল্পিত অভিযান শুরু হয়।
সেসময়, এনজিওগুলো বিশাল ‘ফান্ড’ সহকারে মাঠে নামে এবং শিক্ষিত বেকার তরুণদের, বিশেষত বামপন্থি তরুণদের লোভনীয় ‘চাকরি’ এবং আপাত ‘গরিব দরদী’ কথাবার্তায় প্রলুব্ধ করার অভিযান শুরু করে। অধ্যাপক রেহমান সোবহানের গবেষণা-তথ্য থেকে জানা গেছে যে, এনজিও’র টাকার প্রধান অংশ টার্গেট গ্রুপের ‘গরিব’দের কাছে পৌঁছার বদলে প্রজেক্টের মধ্যবিত্ত ‘ব্যবস্থাপক’দের পেছনে ব্যয় করা হয়ে থাকে। এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, ‘বিপ্লব পিয়াসী’ তরুণসমাজকে ‘নিরাপদ জীবনে’র আস্বাদন দিয়ে ‘পেশাদার বিপ্লবী’র কষ্টকর পথ গ্রহণ থেকে বিরত রাখা। সহজপ্রাপ্য এই টাকার প্রবাহের মুখে অনেক বিজ্ঞজনও ভেসে যেতে শুরু করেন।
অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপরে এই তত্ত্ব জোর করে চাপিয়ে দেয়ার আরেকটি উদ্দেশ্যও ছিল। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের অভিজ্ঞতায় দেখছিল যে, এসব দেশের রাষ্ট্রশক্তিকে সব সময় ‘নিয়ন্ত্রণে’ রাখা যায় না। গণতন্ত্র চর্চার চেষ্টা, জনগণের আন্দোলন, শাসকগোষ্ঠীর দেউলিয়াপনা ইত্যাদি কারণে সবসময়ই তা ক্ষুণ্ন হওয়ার বিপদ থাকে। কিন্তু এনজিওগুলোকে সহজেই ইচ্ছে মতো চালানো যায়। কারণ সেগুলো স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের ‘ঝামেলা-মুক্ত’। তাই, গরিব দেশগুলোতে, রাষ্ট্রের মাধ্যমে ‘সাহায্য’ দেয়ার বদলে এনজিওদের হাত দিয়ে সেই টাকা খরচের ব্যবস্থা করলে, তাতে সে দেশের ওপর সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সহজ হয়। এভাবেই, রাষ্ট্রের ভূমিকাকে কমিয়ে এনে সেখানে এনজিও, সুশীল সমাজ ইত্যাদিকে জায়গা করে দেয়ার এক বিশ্বব্যাপী প্রক্রিয়া সেসময় শুরু হয়।
সেসময় থেকে ‘যুক্তি’ দেয়া হচ্ছে যে, এসব পশ্চাদপদ গরিব দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কখনই সফল হবে না। কারণ, সেসব দেশে সুগঠিত ‘সিভিল সোসাইটি’ নেই, বা থাকলেও তা অতি দুর্বল। তাই, এসব দেশে গণতন্ত্র, রাজনৈতিক দলের ভূমিকা, রাষ্ট্রের ভূমিকা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করা এখন অবান্তর। তাদের এখন নজর দেয়া উচিত ‘সিভিল সোসাইটি’ গড়ে তোলার দিকে।
এদিকে, ঠিক এই সময়টিতেই সোভিয়েত ইউনিয়নে শুরু হয়েছিল ‘গর্বাচভিয়ান’ গ্লাসনস্ট ও পেরেস্ত্রোইকার ঘটনাবলি। বাংলাদেশেও তার ঢেউ এসে লেগেছিল। মার্কসবাদের ‘নবায়নের’ আড়ালে অ-মার্কসীয় নানা তত্ত্বের আমদানি শুরু হয়। ‘সিভিল সোসাইটি’র তত্ত্ব নিয়েও বিভ্রান্তি ছড়ানো শুরু হয়। ‘সর্বমানবিক স্বার্থ বড়, না শ্রেণি সংগ্রামের স্বার্থ বড়’- এরূপ নিরর্থক তাত্ত্বিক বিতর্কের অবতারণা করা হয়। সোভিয়েতের অবলুপ্তির পর অনেকে বলতে শুরু করেন যে, শ্রেণি সংগ্রামের যুগ শেষ হয়ে গেছে এবং সমাজতন্ত্র অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। ইতিহাসের প্রকৃত চালিকা শক্তি এখন আর শ্রেণি সংগ্রাম নয়। সেই চালিকা শক্তি হলো ‘সিভিল সোসাইটি’। মার্কসবাদ বিরোধী ও শ্রেণি সংগ্রামবিমুখ সেসব তত্ত্ব প্রচারে এনজিও’র বিপুল বিদেশি ফান্ড সহজলভ্য ও লোভনীয় এক উদ্দীপক হিসেবে নিয়োজিত হতে থাকে। বামপন্থি দলগুলোতে এনজিওদের সাংগঠনিক-সংস্কৃতি, কাজের ধারা-পদ্ধতি, কথা-বার্তা, এমনকি ভাষা-ব্যবহার ক্রমাগত সংক্রমিত হতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় একসময় এনজিও-র টাকা ও লোকবল বামপন্থি-প্রগতিশীল দলগুলোতে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করে। এনজিওগুলো এমনকি বামপন্থি দলগুলোতে ‘ফ্যাকশনাল’ কাজ চালাতে সচেষ্ট হতে থাকে।
‘সিভিল সোসাইটি’র তত্ত্ব বহু আগে থেকেই আলোচিত হয়ে আসছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লক, রুশো, এ্যাডাম স্মিথ প্রমুখ প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অবয়ব পাওয়া সমাজ-রূপ থেকে পার্থক্য চিহ্নিত করে, মানুষের সৃষ্ট শাসন ব্যবস্থাকে ‘সিভিল সোসাইটি’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এদিকে, জার্মান দার্শনিক হেগেল ‘সিভিল সোসাইটি’কে চিহ্নিত করেন- “মানুষ যেখানে তার ‘পারিবারিক সংহতির গণ্ডি’ অতিক্রম করে ‘বুর্জোয়া সমাজের প্রতিযোগিতার জগতে’ প্রবেশ করেছে, এবং যা কিনা ‘রাজনৈতিক সমাজ’ বা ‘রাষ্ট্র’ থেকে অন্য এক জগৎ” – সে হিসেবে। হেগেলর মতে, সেখানে রয়েছে স্বাভাবিক সমাজ-সম্পর্কগুলোর বদলে শুধু বুর্জোয়া সমাজের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ব্যক্তিস্বার্থ, ব্যক্তিগত চাহিদা এবং অন্তহীন বিভাজন। এবং এ কারণে তা অন্তর্নিহিতভাবে ধ্বংসাত্মক। ফলে, একমাত্র ‘রাষ্ট্রে’র হস্তক্ষেপের দ্বারাই কেবল সার্বজনীন স্বার্থ সমুন্নত রাখা সম্ভব হতে পারে।
মার্কস-এর মতে ‘সিভিল সোসাইটি’ হলো সামন্তবাদী সমাজ থেকে বুর্জোয়া সমাজে উত্তরণের একটি চিহ্ন। তা হলো উৎকট বস্তুবাদ, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অলঙ্ঘনীয় মালিকানাভিত্তিক সম্পত্তি-সম্পর্ক, প্রত্যেক ব্যক্তির অন্য সকলের সাথে প্রতিযোগিতা যুদ্ধে লিপ্ত থাকা, আত্মকেন্দ্রিকতা, চরম স্বার্থপরতা ইত্যাদির আবাসস্থল। এমতাবস্থায়, কেবলমাত্র শাস্তির ভয় দ্বারা বলবৎযোগ্য আইনের প্রয়োগ দ্বারাই সেক্ষেত্রে স্থায়ী সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে। তার ‘পলিটিক্যাল’ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হলো ‘রাষ্ট্র’। মার্কস-এর মতে, মানুষ ও মানবসমাজের পূর্ণ শক্তি ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে তাই, ‘সিভিল সোসাইটি’ এবং তার গর্ভজাত অথচ তার থেকে পৃথক ও বিচ্ছিন্ন ‘পলিটিক্যাল সোসাইটি’ – উভয়কেই বিলুপ্ত করতে হবে। অর্থাৎ, একইসঙ্গে একটি সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিপ্লব সংগঠিত করতে হবে। ‘এ কনট্রিবিউশন টু দি ক্রিটিক অফ পলিটিক্যাল ইকনোমি’ বইয়ের ভূমিকায় মার্কস লিখেছেন, “…আমাদেরকে ‘সিভিল সোসাইটি’র অ্যানাটমির খোঁজ করতে হবে রাজনৈতিক-অর্থনীতির মধ্যে।”
আন্তনিও গ্রামসি কার্ল মার্কস-এর ‘সিভিল সোসাইটি’ সম্পর্কীয় চিন্তাকে নতুন মাত্রিকতায় উন্নীত করেন। মার্কস-এর মতো গ্রামসিও অর্থনীতিসহ রাষ্ট্রবহির্ভূত মানুষের প্রাইভেট জগৎকেই ‘সিভিল সোসাইটি’র পরিধি হিসেবে গণ্য করেন। রাষ্ট্র যে শ্রেণি-আধিপত্যের হাতিয়ার, মার্কসীয় সেই তত্ত্বকে ভিত্তি করেই গ্রামসি তাঁর ‘হেজিমনি’ তত্ত্ব হাজির করেন। তিনি বলেন, “সিভিল সোসাইটি’তে বিদ্যমান ‘হেজিমনি’-কে ট্রেঞ্চ যুদ্ধের কায়দায় পরাভূত করে ‘কাউন্টার-হেজিমনি’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”
এবং আরও বলেন যে, “রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে নেয়ার আগে ও পরে – উভয় পর্বেই শ্রমিক শ্রেণিকে এই কর্তব্য পালনে উদ্যোগী হতে হবে”।
‘সিভিল সোসাইটি’র পুঁজিবাদী তাত্ত্বিকরা মানুষের মাঝে এমন ধারণা ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন যে, ‘সিভিল সোসাইটি’ হলো শ্রেণি-বিভাজন নির্বিশেষ এবং শ্রেণি-দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে অবস্থিত একটি পবিত্র, প্রশান্ত, আলোকিত সামাজিক সত্তা। কিন্তু বাস্তবতা সে কথা বলে না। বাস্তবে তা হওয়া সম্ভবও নয়। কারণ, একটি শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শ্রেণিনিরপেক্ষ নাগরিক সত্তা বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না। মার্কসবাদীরা তো বটেই, এমনকি যুক্তিবাদী যেকোনো সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজবিশ্লেষকই এ কথা অকপটে স্বীকার করেন। পুঁজিবাদী সমাজ যেহেতু শোষক ও শোষিত হিসেবে বিভাজিত, তাই সেখানে ‘শ্রেণিনিরপেক্ষ’ সুশীল সমাজ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না। এমতাবস্থায়, ‘শ্রেণি নিরপেক্ষতা’র ভান করার অর্থ দাঁড়ায় – আধিপত্যকারী শোষক শ্রেণির স্বার্থে বিদ্যমান অর্থনৈতিক-সামাজিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখা। শ্রেণিস্বার্থ সমন্বয়ের ভূমিকার মাধ্যমে তারা বস্তুত সচেতন বা অসচেতনভাবে বিদ্যমান শোষণমূলক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার প্রতিক্রিয়াশীল প্রয়াসের অংশীদারে পরিণত হন। বাংলাদেশের অস্তিত্বের ৫০ বছরে (এবং পাকিস্তানি আমলেও) বারবার ‘গণতন্ত্র’ খর্বিত হয়েছে। গণতন্ত্রের পরিবর্তে চলেছে সামরিক শাসন ও স্বৈরাচার। বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘বড়’ দুটি দলকে কেন্দ্র করে যে দ্বিমেরু-ভিত্তিক রাজনৈতিক কাঠামো স্থাপিত হয়েছে তা কল্পনাতীত লুটপাট ও পাশবিক দুরাচারের জন্ম দিয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের পথ হলো একটি সমাজতন্ত্র লক্ষ্যাভিমুখীন ‘সমাজ-বিপ্লব’। সেই লক্ষ্যে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি ‘বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি’র বিকাশ ঘটানো আজ খুবই জরুরি। সেজন্য গণতান্ত্রিক শাসন, গণতান্ত্রিক অধিকার, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানসমূহকে রক্ষা ও সেগুলোকে গণমুখী ধারায় সংহত ও উন্নত করা ইত্যাদি হলো খুবই গুরত্বপূর্ণ কাজ।
এগুলো সবই হলো ‘রাজনৈতিক’ কর্তব্য। এসব ‘রাজনৈতিক’ কর্তব্যকে খর্ব অথবা তাচ্ছিল্য করে ‘অরাজনৈতিক’ শক্তি ও পন্থার ওপর নির্ভর করে সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা করা খুবই বিপজ্জনক। কারণ তার প্রকৃত অর্থ হবে, বর্তমান সময়ে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠিত বাহিনী হিসেবে সবসময় ‘রেডি’ পজিশনে থাকা সামরিক বাহিনীকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে ডেকে আনা। এটিই ‘বিরাজনীতিকরণে’র রাজনীতির অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। অন্তত আমাদের দেশের বিদ্যমান শক্তি-ভারসাম্য ও শক্তি-বিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে এটি একটি বাস্তব আশঙ্কার বিষয়। ‘বিরাজনীতিকরণে’র বাহক হয়ে ‘সুশীল সমাজ’ সেই প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না তা ভেবে দেখার বিষয়।
বিশ্বপ্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশের বিশেষ বাস্তবতা ‘সুশীল সমাজে’র তত্ত্ব ও প্রয়োগকে একটি প্রতিক্রিয়াশীল ও বিপজ্জনক আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশে ‘সুশীল সমাজে’র তত্ত্ব ও প্রয়োগ যে ‘বিরাজনীতিকরণে’র দুরভিসন্ধি কার্যকর করছে তার সার্বিক চরিত্র হলো ক্ষতিকর। ‘সুশীল সমাজ’ নামে পরিচালিত ‘বিরাজনীতিকরণে’র হাতিয়ারকে রুখে দাঁড়ানো আজ তাই দেশের মঙ্গলাকাক্সক্ষী সকলেরই কর্তব্য। যারা না বুঝে কিংবা সরল মনে এই ফাঁদে পা দিয়েছেন, তাদের এই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজন এনজিও, ‘সিভিল সোসাইটি’ প্রভৃতির ‘বি-রাজনীতিকীকরণের’ ও ‘রাজনীতি-বিরোধিতার’ ধারাকে বিপ্লবী নীতিনিষ্ঠতার সঙ্গে মোকাবিলা করে ক্লান্তিহীনভাবে ও ধৈর্যের সঙ্গে বিপ্লব অভিমুখী ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
এনজিও ফান্ডের বিপুল ‘সিস্টেম লসে’র পরেও, গরিব মানুষ যদি তা থেকে সামান্য পরিমাণেও কিছু সুবিধা পায়, গরিবের প্রকৃত কল্যাণকামী হিসেবে একজন বিপ্লবী তার বিরোধিতাকারী হবে না। মার্কসবাদীরা সবসময় কিংবা সবরকম ‘সংস্কারে’র বিরোধী- এ কথা সঠিক নয়। তবে তারা ‘সংস্কারবাদে’র বিরুদ্ধে। কারণ, তারা জানে যে- ‘ভাঙা কলসে যতোই পানি ঢালা হোক, সে কলস কোনোদিনই ভরবে না’। ‘এ সমাজ ভাঙতে হবে’ আওয়াজের কোনো বিকল্প নেই। মেহনতি মানুষসহ বঞ্চিত গরিব জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করা মার্কসবাদী ও বামপন্থিদের একটি প্রধান কর্তব্য।
জীবিকা নির্বাহের জন্য অনেক বিপ্লবী কর্মীকে এনজিওতে চাকরি নিতে হয়। কোটি কোটি বেকারের দেশে বাধ্য হয়ে তাদেরকে তা করতে হয়। সাধারণ বিবেচনায় এটি কোনো অন্যায় বা ভুল কাজ নয়। কিন্তু এনজিওতে ‘চাকরি’ করাকে গরিবের মুক্তির জন্য ‘বিপ্লবী’ কাজ বলে মনে করা শুধু ভুলই নয়, তা ক্ষতিকর ও বিপজ্জনকও বটে। বিপ্লবী বাক্যবাগীশতার রোমাঞ্চকর উত্তেজনা কিংবা মধ্যবিত্তসুলভ উৎকট প্রদর্শনবাদিতার লোভনীয় প্রলোভনকে জয় করে তরুণ সমাজকে আজ সমাজ বিপ্লবের নীতিনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। ‘চলতি হাওয়া’র কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেয়া যাবে না!
লেখাটি ekota.live থেকে নেয়া