15227

ড. মীজানের কাছে যুবলীগও একটা বিশ্ববিদ্যালয়!

ড. মীজানের কাছে যুবলীগও একটা বিশ্ববিদ্যালয়!

2019-10-21 01:55:23

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান বলেছেন, যুবলীগের দায়িত্ব পেলে তিনি উপাচার্য পদ ছেড়ে দিতে রাজি আছেন। ‘উপাচার্য না যুবলীগ চেয়ারম্যান কোন পদকে আপনি বেশি গুরুত্ব দেবেন’, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে কোনো রাখঢাক না করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক বলেছেন, ‘অবশ্যই যুবলীগের পদকে গুরুত্ব দেবো। যুবলীগ আমার প্রাণের সংগঠন। এই সংগঠনের জন্য অনেক কষ্ট করেছি। এখন সংগঠনটি একটি সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলে তা গ্রহণ করবো।’

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিসি, ‍যিনি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, শিক্ষা নয়, শিক্ষার মান নয়, গবেষণা নয়, শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারী নয়, ভাবিত হচ্ছেন, যুবলীগ নিয়ে, এই সংগঠনের ভাবমূর্তি নিয়ে! অথচ তিনি নিজে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, সেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এখন চরম ভাবমূর্তির সংকটে নিমজ্জিত। এখানে শিক্ষার মান নেই, শিক্ষার্থীদের ক্লাস করার পর্যাপ্ত ক্লাসরুম নেই, শিক্ষক নেই, গবেষণা নেই, ভালো গবেষণাগার নেই, আধুনিক লাইব্রেরি নেই। এখানে শিক্ষার্থীদের একাংশ সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি-মাস্তানি করে, দোকানদার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মারামারি করে, প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনকে কোনো ধরনের তৎপরতা চালাতে দেয় না, এমনি কত কত অভিযোগ। এসব ব্যাপারে কোনো ধরনের কথা না বলে তিনি যুবলীগের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব পালন নিয়ে ভাবছেন! ড. মীজান যে দৃষ্টিকোণ থেকে, যে কারণেই কথাগুলো বলুন না কেন, তার এই বক্তব্য মোটেও শিক্ষকসুলভ নয়। বরং শিক্ষক হিসেবে তাঁর এই বক্তব্য চরম স্খলনেরই দৃষ্টান্ত। একজন ভিসি যদি নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে না ভেবে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, হকার লীগের ভাবমূর্তি নিয়ে চিন্তিত এবং বিচলিত হন, ‘উপাচার্য না যুবলীগ চেয়ারম্যান কোন পদকে আপনি বেশি গুরুত্ব দেবেন’ এমন প্রশ্নের উত্তরে ‘অবশ্যই যুবলীগের পদকে গুরুত্ব দেবো’ বলেন, তাহলে দেশের উচ্চ শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হতে হয় বৈকি! ৬১ বছর বয়সী ভিসি মিজানুর রহমানের কেন খায়েশ হলো যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ার? তিনি কি জানেন না এই সরকার প্রণীত যুব নীতিতে যুবকের বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ ৩৫ বছর। সে হিসেবে তো ওনার ছেলের যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ার কথা! তাহলে তিনি কেন দায়িত্ব পেলে ভিসির পদ ছেড়ে যুলীগের দায়িত্ব নিতে চান?

আমরা জানি, উপাচার্য হলেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নির্বাহী। তার চেয়েও বড় বিষয় হলো এসব উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে সর্বোচ্চ অবস্থানে (অধ্যাপক) যাওয়ার পরই নিয়োগ পেয়ে থাকেন। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যখন ঘোষণা দিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতা হতে চান, তখন বোঝা যায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা, শিক্ষা ও শিক্ষকের অবস্থা! বিশ্ববিদ্যালয়ে কি কোনো ‘মধু’ই আর অবশিষ্ট নেই, সব ‘মধু’ এখন রাজনৈতিক দলে? যিনি সারা জীবন শিক্ষকতা করেছেন, ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ৬ বছর ধরে, আর মাত্র পাঁচ কি ছয় বছর বয়সে যিনি অবসরে যাবেন, তিনি যখন যুবলীগের নেতা হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেন তখন বুঝতে হবে আমাদের সমাজে শিক্ষকদের মান কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে!

উল্লেখ্য, ড. মীজান ২০০৩ সাল থেকে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সময়ে জাহাঙ্গীর কবির নানক যখন পলাতক, তখন তিনি যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন। অর্থাৎ বিষয়টি নতুন নয়। তিনি মূলত যুবলীগ নেতা। সেই পদে বহাল থেকেই উপাচার্য হয়েছেন। উপাচার্য হওয়ার পর তিনি যুবলীগ থেকে পদত্যাগ করেননি। যুবলীগও তাকে অব্যাহতি দেয়নি। অনেকে এমন কথাও বলছেন যে, প্রেসিডিয়াম সদস্য যদি ভিসি হতে পারেন, ভিসির তবে যুবলীগ প্রেসিডেন্ট হতে দোষ কোথায়?

উল্লিখিত মন্তব্যে অবশ্য যুক্তি আছে। ব্যাপারটা আসলে আমাদের জন্যই দুর্ভাগ্যের। তা না হলে যুবলীগের একজন নেতা দেশের শীর্ষ একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পান কীভাবে? অবশ্য আমাদের দেশের তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসকরা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের আজ্ঞাবহ দলীয় কর্মীতে পরিণত করেছেন। ড. মীজানেরও প্রথম পরিচয় দলীয় কর্মী। শিক্ষক বা উপাচার্য তার দ্বিতীয় পরিচয়। যে পরিচয়ে তিনি মোটেও গর্বিত নন। তাইতো তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির চেয়ে যুবলীগের পদকে অধিক গ্রহণীয় মনে করছেন।

অথচ ভিসি এদেশের সবচেয়ে সম্মানিত পদগুলোর একটি হবার কথা। এ পদের সুযোগ সুবিধাও নেহায়ত কম নয়। তবু কেনো একজন ভিসি সে পদ ছেড়ে যুবলীগের দায়িত্ব নিতে প্রকাশ্যে আগ্রহ ব্যক্ত করেন? অনেকের মতে, ভিসি হিসেবে তিনি যা আয় করেন, কমিশন, লুটপাট, ভাগ-বাঁটোয়ারা থেকে যা পান, যুবলীগের দায়িত্ব পেলে তার থেকে অনেক গুণ বেশি টাকা উপার্জনের সুযোগ পাবেন। সম্রাট-খালেদ-আরমান-শামীম-সিদ্দিকরা সেই দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। তাদের সমস্যা শুধু একটাই, বেপরোয়া চলতে গিয়ে ট্র্যাকের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। তাই এখন কিছুদিন জেলখানার স্বাদ নিতে হচ্ছে।

কিন্তু ড. মীজানের ক্ষেত্রে সেই ঝামেলা নেই। তিনি শিক্ষিত মানুষ। চালাক-চতুরও বটে। কীভাবে নেত্রীর নেকনজরে থাকতে হয়, সেই এলেম তার ভালোই জানা আছে। তিনি ছাত্রলীগের নেতা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। সেখান থেকে যুবলীগের নেতা হয়েছেন। ছাত্রলীগ-যুবলীগে ভূমিকা পালনের পুরস্কার উনি পেয়েছেন। একটি যুব সংগঠনের নেতা থাকা অবস্থায় তিনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। ঘোষণা দিয়ে তিনি কোনো রকম নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ছাত্রলীগের কর্মীদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দিয়েছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় আর শিক্ষা নিয়ে যতটা বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে বলেন তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এমন ব্যক্তিকে যুবলীগ-কৃষকলীগ, এমনকি ছাত্রলীগেও নিশ্চিন্তে নিয়োগ দেওয়া যায়।

অথচ স্বৈরাচারী আমলের ভিসিরা নিজেদের ওজন বুঝে চলতেন। নিজেদের সম্মান ও মর্যাদাকে অক্ষুণ্ণ রেখে তারা দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফজলুল হালিম চৌধুরী যিনি ১৯৮২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনা অনুমতিতে পুলিশী অভিযানের পর ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। তারপর যিনি দায়িত্ব নেন সেই শামসুল হকও সম্মান বজায় রাখতে দায়িত্ব ছেড়েছিলেন। এরপরের ভিসি আবদুল মান্নানও মেরুদণ্ড সোজা করেই চলেছেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, অগণতান্ত্রিক সামরিক একনায়করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রতিষ্ঠান হিসাবে টিকে থাকতে সাহায্য করেছেন আর তথাকথিত গণতান্ত্রিক নেতারা অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও প্রতিষ্ঠান হিসাবে ধ্বংসের ব্যবস্হা করেছেন।

আসলে আমাদের দেশটা যারা চালাচ্ছেন, তারা দেশে জ্ঞানী-গুণী-মেধাবী চান না। তারা চান মোসাহেব। তারা চায় এমন একটা গোষ্ঠী যারা লেজ-নাড়ানোর বিদ্যায় পারঙ্গম। ক্ষমতাসীনরা বিরোধিতা চায় না, সমালোচনা চায় না, কেবল প্রশংসা শুনতে চায়, সমর্থন চায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণির শিক্ষক ক্ষমতাসীনদের এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এসেছেন। অবশ্য এখন রাষ্ট্র-যন্ত্রটাই এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, এটা লুটপাট, মানি লন্ডারিং, পাচারের একটা মেশিনে পরিণত হয়েছে। এর যাবতীয় মেকানিজম কেবল এই একটি উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। সে অর্থে এই রাষ্ট্রযন্ত্রটি পুরোপুরি সফল। সফল এর আমলাতন্ত্র, সকল বিশ্ববিদ্যালয়, সকল প্রতিষ্ঠান। এখানে যারা বিভিন্ন দায়িত্বে আছেন, তারা প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে এ পাচারতন্ত্রের উপকারভোগী। এখন রাষ্ট্রীয় আদর্শই হচ্ছে: অনুগত থাকো, নিয়ন্ত্রিত উপায়ে লুটপাট করো। কেবল সীমা লঙ্ঘন করো না। সীমা লঙ্ঘন করলেই পুলিশ-র‌্যাব ‘নিরপেক্ষ’ ভূমিকা পালন করবে। সম্রাটের পরিণতি বরণ করতে হবে।

আমরা হতাশা থেকে মাঝে মাঝে ছাত্রলীগ-যুবলীগকে দোষ দিই। সমালোচনা করি। যদিও তাদের দোষারোপ করে কোনো লাভ নেই। সম্রাট-আরমান-খালেদ-শামীম-সিদ্দিকদের দোষারোপ করারও কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। কারণ তারা এমন সুযোগ, ব্যবস্থা ও আস্কারা পেয়েছেন বলেই অবৈধ আয়ের পথে পা বাড়িয়েছেন। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের এক শ্রেণির নেতা-কর্মীর লুটপাট-অবৈধভাবে টাকা উপার্জন, সেই টাকা পাচারের কুৎসিৎ আকাঙ্ক্ষাটি জন্ম নিয়েছে দলের উপদেষ্টা ও রক্ষকদের ছত্রচ্ছায়ায়। আজ যতই কয়েকজনকে আটক করে ‘দলে শুদ্ধি অভিযানের’ নাটক সাজানো হোক না কেন, এসবের দায় মূল নেতৃত্বকেই নিতে হবে।

পুনশ্চ: সাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের ড. মীজানুর রহমানকে উদ্দেশ করে লিখেছেন, ‘‘স্যার, আপনার বোধহয় সম্প্রতি মনে হয়েছে, যুবলীগও একটা বিশ্ববিদ্যালয়। এখানেও অনেক ডিপার্টমেন্ট। ক্যাসিনো ডিপার্টমেন্ট, টেন্ডার ডিপার্টমেন্ট, মানি লন্ডারিং ডিপার্টমেন্ট, অসহায় চেয়ে থাকা ডিপার্টমেন্ট …। আপনার দায়িত্ব নেওয়ার ইচ্ছা ঠিকই আছে।’’

চিররঞ্জন সরকার
কলামিস্ট।

সম্পাদক: ইসমাঈল হোসাইন রাসেল
যোগাযোগ: ক্যাম্পাস টাইমস
৪৩ শহীদ নজরুল ইসলাম সড়ক, হাটখোলা রোড, চৌধুরী মল, টিকাটুলি, ঢাকা-১২০৩
মোবাইল: ০১৬২৫ ১৫৬৪৫৫
ইমেইল:[email protected]