17767

একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী বলছি

একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী বলছি

2020-06-15 17:29:56

অবস্থা অনেকটা সেই রাখাল বালকের গল্পের মতো। আমাদের যাদের এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল, আমি নিশ্চিত, আমার মতো সবার কাছেই প্রায়ই নতুন নতুন ‘খবর’ আসে। অমুকের বাবা নাকি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তমুক, তিনি বলেছেন, ‘আগামী মাসের ১ তারিখ থেকে পরীক্ষা।’ আরেকজন ‘গোপন সূত্র’ থেকে খবর দেন, আগামী দুই মাসের মধ্যে পরীক্ষা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। একবার তো জুলাইয়ের ১৫ তারিখ সামনে রেখে গোটা একটা রুটিনও হাতে পেয়ে গেলাম! এত গুজবের মধ্যে সত্যিই যদি পরীক্ষার ঘোষণা আসে, শুরুতে হয়তো বিশ্বাসই হবে না।

কোভিড–১৯–এর বদলে যাওয়া পৃথিবীর সঙ্গে আমরা একটা নতুন পরিচয় পেয়েছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে ‘ইন্টারমিডিয়েট থার্ড ইয়ার’ বলে মজা করছে। কিন্তু আমাদের ভেতরে কী চলছে, সেটা শুধু আমরাই জানি।

মার্চের শুরুতে আটঘাট বেঁধে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ৮ মার্চ যেদিন প্রথম বাংলাদেশে করোনা রোগী পাওয়া গেল, মনে মনে বলছিলাম খবরটা মিথ্যা হোক। চ্যানেল বদলাচ্ছিলাম আর আশা করছিলাম, কেউ একজন বলুক, ‘শনাক্ত হওয়া ব্যক্তির রিপোর্টে ভুল ছিল। বাংলাদেশে এখনো করোনার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।’ কিন্তু আমার ধারণাই বরং ভুল প্রমাণ হলো। সেই দিন থেকে একটা বিশাল পাথর যেন বুকের ওপর চেপে বসতে শুরু করল।

মার্চের মাঝামাঝি সময়ে কানাঘুষা শুরু হলো, পরীক্ষা পেছাবে। আমরা তখনো মনে মনে নিজেকে বলেই যাচ্ছি, ‘পরীক্ষা ঠিক সময়মতোই হবে। পড়া চালিয়ে যাও।’ এরই মধ্যে একদিন পত্রিকায় দেখলাম শিরোনাম, ‘এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত’। আমরা পড়লাম ভীষণ দুর্ভাবনায়। একদিকে পরীক্ষার অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে নিজের, পরিবারের, স্বজনদের, বন্ধুদের সুস্থতা নিয়ে দুশ্চিন্তা। শুরুতে অনেকে বলেছিলা, পরীক্ষা পেছানোতে ভালোই হয়েছে, এখন আরও ভালো করে প্রস্তুতি নেওয়া যাবে। কিন্তু দিনে দিনে প্রস্তুতিটা যেন আরও ঢিলেঢালা হওয়া শুরু হলো। অনেকে শুনেছি এইচএসসির পড়ার ফাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্যও প্রস্তুতি শুরু করেছে। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষা আদৌ হবে কি না, সেই নিশ্চয়তাও তো নেই। পরীক্ষার আগেই আমরা এক কঠিন পরীক্ষায় পড়ে গেছি।

সেদিন এক বন্ধু ফোনে বলছিল, ‘কী করি বল। চারদিকে এত দুঃসংবাদ। এদিকে মা সারা দিন পড়তে বলে। পড়ার ভান করতে করতেও ক্লান্ত হয়ে গেছি।’ অথচ সবকিছু কত নিয়ন্ত্রণে ছিল। পরীক্ষার আগে জীবনটাকে বেশ শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে এসেছিলাম। মুঠোফোন দূরে রাখা, টিভি কম দেখা, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাকটিভ রাখা, সময়মতো ঘুম-খাওয়া-পড়ার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। এখন সেই রুটিন অনেকটাই এলোমেলো। তবু সত্যি বলতে এখনও সুস্থ আছি, বাসার সবাই সুস্থ আছে, এটাই সবচেয়ে বড় স্বস্তি। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই পড়তে বসি। বিকেলে গল্পের বই পড়ি। সন্ধ্যায় অঙ্ক করতে বসি, সেটাও অনেকটা ওই গল্পের বই পড়ার মতোই। খুব যে ‘সিরিয়াস মুডে’ পরীক্ষার কথা ভেবে অঙ্ক করি তা নয়, যেটা করতে ভালো লাগে, যতক্ষণ ভালো লাগে, ততক্ষণই করি। পরিবারের সবার সঙ্গে খাবার টেবিলে দারুণ একটা আড্ডা হয়, এটাও একটা প্রাপ্তি। আগে হয়তো শুধু বিশেষ দিনগুলোতেই বাসার সবাই মিলে একসঙ্গে খেতে বসা হতো। এখন প্রতিদিন খাবার টেবিলে দেশ, অর্থনীতি, বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে যে ‘টক শো’, সেখানে আমিও একজন গুরুত্বপূর্ণ আলোচক।

আর হ্যাঁ, আমার রুটিনে কীভাবে যেন একটা কাজ পাকাপোক্তভাবেই জায়গা করে নিয়েছে। তা হলো প্রতিদিন বেলা আড়াইটায় ‘স্বাস্থ্য বুলেটিন’ দেখা। প্রতিদিনই গ্রাফটা ঊর্ধ্বমুখী হয়। তবু খুব আশা নিয়ে দেখি, যদি কোনো সুখবর আসে! যদি দেখা যায় আক্রান্তের সংখ্যা, মৃতের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে!

টেবিলে বসে এই লেখা যখন লিখছি, তখনো সামনে ঘোর অনিশ্চয়তা। জানি না কবে পরীক্ষা হবে, কবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দেবে, আদৌ পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারব কি না, কিংবা সব আবার আগের মতো হবে কি না। শুধু এটুকু জানি, যত যা-ই হোক আমি হার মানব না। মনোবল রাখব। ভাঙব, কিন্তু মচকাব না।

নুসরাত সায়েম, শিক্ষার্থী, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ

সম্পাদক: ইসমাঈল হোসাইন রাসেল
যোগাযোগ: ক্যাম্পাস টাইমস
৪৩ শহীদ নজরুল ইসলাম সড়ক, হাটখোলা রোড, চৌধুরী মল, টিকাটুলি, ঢাকা-১২০৩
মোবাইল: ০১৬২৫ ১৫৬৪৫৫
ইমেইল:[email protected]