21131

লুইস গ্লুকের নোবেল ভাষণ

লুইস গ্লুকের নোবেল ভাষণ

2021-01-18 04:23:45

ভাষান্তর : সুরাইয়া ফারজানা হাসান

২০২০ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন আমেরিকান কবি লুইস গ্লুক। নোবেল কমিটির বিচারকদের মতে, তার নির্ভুল কবিতাকণ্ঠের একান্ত অনাড়ম্বর রূপ এই মহাবিশ্বে এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হয়ে টিকে থাকবে। ৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত গ্লুকের নোবেল বক্তৃতায় তার কবি জীবনের এক অনন্য যাত্রার পথ উন্মোচিত হয়েছে।

আমি যখন ছোট্টটি ছিলাম, পাঁচ কি ছয় বছর বয়স হবে, তখন আমি আমার মস্তিষ্কে একটি প্রতিযোগিতা মঞ্চস্থ করি, উদ্দেশ্য বিশ্বের সেরা কবিতাটি নির্বাচন করা। দুজন চূড়ান্ত প্রতিযোগী ছিলেন সেখানে : উইলিয়াম ব্লেকের ‘দ্য লিটল ব্ল্যাক বয়,’ আর স্টিফেন ফস্টারের ‘সোয়ানি রিভার’। প্রতিযোগিতা উপলক্ষ্যে আমি লং আইল্যান্ডের দক্ষিণ তীরের গ্রাম সিডারহার্স্টে আমার দাদুর বাড়ির বাচ্চাদের শোবার ঘরটি উপর নিচ করে ফেলি, মুখে শব্দটি না করে, মস্তিষ্কের ভিতর পছন্দের কবিতা আবৃত্তি করতে থাকি, ব্লেকের অবিস্মরণীয় সব কবিতা, আর মস্তিষ্কের ভিতরই গাইতে থাকি, নিঃসঙ্গ ফস্টারের গান দ্য হান্টিং। কীভাবে আমি ব্লেকের কবিতা পড়তে বসি সে-ও এক রহস্য। আমার মনে হয় আমার বাবা-মায়ের বাড়িতে গড়পড়তা রাজনীতি, ইতিহাস এবং অন্যান্য গল্প-উপন্যাসের মাঝে, অল্প ক’টি বাছাই করা কবিতা সংকলন ছিল। তবে আমি দাদুর বাড়ির সাথে ব্লেককে একাকার করে ফেলি। আমার দাদু অবশ্য অতটা কেতাবি মানুষ ছিলেন না। তবে সেখানে ব্লেক ছিল, তাঁর দ্য সং অব ইনোসেন্স এন্ড অব এক্সপিরিয়েন্স কবিতাসহ এবং শেক্সপিয়ারের নাটকের গানের একটা পাতলা বইও ছিল, যেগুলোর অনেক কয়টি আমি মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। আমি শেক্সপিয়ারের রোমান্টিক নাটক সিমবেলিন’এর গান বিশেষ করে ভালোবাসতাম, কেবল গানের কথা নয় বরং সুরের ওঠানামা, মূর্ছনা, ধ্বনির অনুজ্ঞা শ্রবণ করে একটি ভীরু বাচ্চা মেয়ের লাজে শিহরিত হওয়ার এক অভিজ্ঞতা বটে। ‘এন্ড রিনাউন্ড বি দ্য গ্রেভ’ শেক্সপিয়রের বিখ্যাত গীতিকবিতার সেই ছত্র।’ আমি এমনটিই আশা করি।

সম্মান প্রদর্শনের জন্য, উঁচু মাপের পুরস্কার প্রদানের জন্য, এধরনের প্রতিযোগিতা আমার কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়; আমার প্রথমপাঠের গূঢ়-কাহিনি সেসবে পরিপূর্ণ। ‘দ্য হায়েস্ট অব দ্য হাই অনারস’ কবিতাটি আমার কাছে সেরা বলে মনে হয়, এমনকি আমি যখন বেশ অল্পবয়সী ছিলাম তখনও এমনটিই মনে হতো। আমি আর আমার বোন বেড়ে উঠেছি, জোয়ান অব আর্কের ফ্রান্সকে রক্ষা করা, মারি ক্যুরির রেডিয়াম আবিষ্কার, এমন সব ভাবনার মাঝে। পরবর্তীকালে এধরনের মর্যাদাক্রম অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যাসের চিন্তার বিপদ ও সীমাবদ্ধতা টের পাই, তবে আমার শৈশবে, এধরনের পুরস্কার প্রদানকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। একজন মানুষ পর্বতের চূড়ায় দাঁড়াবেন, যাকে বহু দূর থেকে দেখা যাবে, পর্বতের ওপরে কেবল একজনই আকর্ষণের বিষয়বস্তু। একটু নিচে যেসব মানুষজন দাঁড়িয়ে আছেন তারা অলক্ষেই থেকে যাবেন।

অথবা, এই ক্ষেত্রে কবিতার কথা বলি। আমি সত্যিই অনুভব করি, ব্লেক যেকোনোভাবেই হোক আমার এই প্রতিযোগিতার আয়োজন সম্পর্কে সচেতন, এর ফলাফল জানায় আগ্রহী। আমি জানি তিনি মৃত, তবে আমার মনে হতো, তিনি বেঁচে আছেন, আমি যে আমার সাথে কথোপকথনের সময় তার কণ্ঠস্বর শুনতে পেতাম। মনে হতো, তিনি কেবল আমার সাথেই কথা বলছেন। আমার মনে হতো আমি বিশেষ কেউ, বিশেষ সুবিধাভোগী; কারণ ব্লেক, যার সাথে কথা বলতে আমি ব্যাকুল হয়ে থাকি, শেক্সপিয়ারসহ, তার সাথে আমি ইতোমধ্যেই কথা বলে ফেলেছি।

ব্লেক এই প্রতিযোগিতার বিজয়ী ছিলেন। তবে আমি পরবর্তীকালে উপলব্ধি করি, এই গীতিকবিতা দুটি কতটা সাদৃশ্যপূর্ণ; আমি এখনকার মতো তখনও আকৃষ্ট হই সেই নিসঃঙ্গ মানবকণ্ঠের প্রতি, যা তার শোকসঙ্গীত অথবা আকাঙ্ক্ষার মাঝে উচ্চকিত হয়েছে। এবং যেসব কবির কাছে আমি ফিরে ফিরে আসি, তাদের সাহিত্যকর্মের মাঝে আমি বেড়ে উঠি, সেগুলোয় আমি মনোনীত শ্রোতা হিসেবে, চূড়ান্ত ভূমিকা পালন করি। নিবিড়, প্রলুব্ধকর, প্রায়শ অলক্ষে অথবা চুপিচুপি। খেলার মাঠের কবি নন। কেবল নিজেদের সাথে কথা বলা কবি নন।

আমি এই সন্ধি পছন্দ করতাম, আমি সেই চেতনাকে পছন্দ করতাম, যে কবিতাটি আবশ্যকীয়ভাবে এবং একান্তে আমায় বলত, যেন কোনো পুরোহিত অথবা বিশ্লেষকের বার্তায় পাওয়া।

আমার দাদুর বাচ্চাদের শোবারঘরের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান দেখে মনে হবে, গোপনীয়তার গুণে, নিবিড় সম্পর্কের একটি সম্প্রসারিত অংশ সৃষ্টি করেছে কবিতা : সম্পর্কের অবমাননা নয়।

ব্লেক তার কবিতার ছোট্ট কৃষ্ণাঙ্গ বালকটি মাধ্যমে আমায় বলছিলেন; তিনিই সেই কণ্ঠস্বরের গুপ্ত সত্তা। তাকে দেখা যেত না, যেমনটি ছোট্ট কৃষ্ণাঙ্গ বালকটিকে দেখা যায়নি অথবা দেখা গেলেও তা সঠিক ছিল না, দেখা দিত এক অনুভবক্ষমহীন এবং তাচ্ছিল্যপূর্ণ শেতাঙ্গ ছেলের মাধ্যমে। তবে আমি জানতাম, সে যা বলে তা সত্য, ওর কচি মরণশীল দেহ, ধারণ করে আছে দীপ্তিমান পবিত্র একটি আত্মা; আমি ব্যাপারটি জানতাম, কারণ কৃষ্ণাঙ্গ বালকটি ওর অনুভূতি আর অভিজ্ঞতার কথা আমায় বলেছে, ওর কাহিনিতে কারো প্রতি কোনো দোষারোপ নেই, নিজের প্রতিশোধ নেবার স্পৃহা নেই, কেবল এই বিশ্বাস যে, ওর মৃত্যুর পর ওকে যথার্থ পৃথিবীর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে যেখানে ওকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে এবং অধিকতর ভঙ্গুর শেতাঙ্গ বালককে হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে আনন্দের আতিশয্যে রক্ষা করবে। যদিও এটা বাস্তবসম্মত আশা নয়, বরং বাস্তবতাকে এড়িয়ে যায়, কবিতাকে হৃদয়বিদারক করে তোলে আর গভীরভাবে রাজনৈতিক সঙ্কটে ঠেলে দেয়। আহত এবং ন্যায়সঙ্গত ক্রোধে ছোট্ট কৃষ্ণাঙ্গ বালকটি সম্মতি দেয় না, ওর মা পাঠক আর শ্রোতার অনুভব থেকে ওকে রক্ষা করুক। এমনকি সেই পাঠক যদি শিশু হয় তবুও।

তবে মানুষের সম্মান বিষয়টি আলাদা।

আমি সারা জীবনে যত কবিতা পেয়েছি, সবচেয়ে প্রকটভাবে অঙ্কিত কবিতা, যেটা আমি বর্ণনা করেছি, নিবিড়ভাবে নির্বাচিত অথবা আঁতাত করা কবিতা, সেই কবিতা যাতে শ্রোতা অথবা পাঠক যার যার অবদান রেখে যায়, একটি আত্মবিশ্বাস অথবা হই-হট্টগোলের প্রাপক হিসেবে, কখনো-বা সহযোগী-চক্রান্তকারী হিসেবে। ‘আমি কেউ-না,’ ডিকিনসন বলেন। ‘তুমিও কি কেউ নও?/ তবে আমাদের একটি জুটি হলো... বলবে না গো...’ অথবা এলিয়ট : ‘চলো তবে যাই, তুমি আর আমি/যখন আকাশ ফুঁড়ে সন্ধ্যা ছড়িয়ে পড়ে/ টেবিলের ওপরে রোগীকে যেমনভাবে অচেতন করা হয়...’ এলিয়ট বয়স্কাউট দলকে তলব করছেন না। তিনি পাঠকের কাছে কিছু চাইছেন। বিপরীতে শেক্সপিয়ারকে তিনি বলছেন, ‘আমি কী তোমাকে গ্রীষ্মের দিবসের সাথে তুলনা দেবো’ :

শেক্সপিয়ার আমায় গ্রীষ্মের দিবসের সাথে তুলনা করেননি। আমি তাঁর দীপ্তিমান পুন্যাত্মাকে হঠাৎ হঠাৎ শোনার অনুমতি পেয়েছি, তবে তার কবিতায় আমার উপস্থিতির প্রয়োজন নেই।

যে ধরনের কবিতা কৌশলে আমি আকৃষ্ট, সমষ্টিগত কণ্ঠস্বর অথবা ভয়ংকর রায়। নিবিড় বক্তৃতার নিরাপত্তাহীনতা এর ক্ষমতায় যোগ হয় এবং পাঠকের ক্ষমতা, সংস্থার মাধ্যমে কণ্ঠস্বরকে উৎসাহ প্রদান করা হয়, এর অজুহাতে অথবা আত্মবিশ্বাসে।

এধরনের একজন কবির কী হয়, যখন সংঘবদ্ধ, দৃশ্যমান নির্বাসন তাকে এড়িয়ে যায়, প্রশংসা অথবা উপরে তোলার পরিবর্তে? আমি বলব, এ ধরনের কবি হুমকি অথবা ধূর্ততায় পরাস্ত অনুভব করবে।

এটা ডিকিনসনের বিষয়বস্তু। সবসময় নয়, তবে প্রায়শ।

আমি কৈশোরে এমিলি ডিকিনসন পড়ি খুব ধৈর্য নিয়ে। সাধারণত গভীর রাতে, বিছানায় যাওয়ার আগে, বসারঘরের সোফায়।

আমি কেউ নই! তুমি কে?

তুমিও কি কেউ নও?

এবং যে সংস্করণে আমি তখন পড়তাম এবং এখনও পছন্দ করি:

তবে আমরা দুজনে জুটি... বলবে না গো!

ওরা আমাদের নির্বাসনে দেবে, জানো তো...

আমি যখন সেখানে সোফায় বসেছিলাম, ডিকিনসন আমায় বেছে নিয়েছেন, অথবা চিনে নিয়েছেন। আমরা সেখানে গণ্যমান্য কেউ, অদৃশ্য সঙ্গী, আমাদের কেবল একটি বিষয়ই জানা, আমরা একে অপরকে সমর্থন করি। এই পৃথিবীতে আমরা কেউ নই।

তবে আমাদের মতো জীবিত লোকজনকে নির্বাসনে দিয়ে কী করবে, আমরা যেখানে নিরাপদ জায়গায়, গাছের গুঁড়ির নিচে? নির্বাসন তখনই হবে যখন গুঁড়িটা সরিয়ে নেয়া হবে।

আমি এখানে কিশোরী মেয়েদের ওপর এমিলি ডিকিনসনের সর্বনাশা প্রভাবের কথা বলছি না। আমি সেই মেজাজ মর্জি সম্পর্কে বলছি যেটা সাধারণ মানুষের জীবনকে অবিশ্বাস করে অথবা এমন একটি রাজত্ব হিসেবে দেখে, যেখানে সিদ্ধান্ত নিয়মনিষ্ঠতা ধ্বংস করে, এবং অকপটতার স্থলে আংশিক-সত্য আসে এবং উন্মোচনের আদেশ দেয়। উদাহরণস্বরূপ : ধরা যাক, কণ্ঠস্বরটা একজন চক্রান্তকারীর, ডিকিনসনের কণ্ঠস্বর, বিচারসভার কণ্ঠস্বর। ‘আমরা কেউ নই, তুমি কে?’ সেই বার্তাটা হঠাৎ অলক্ষুণে হয়ে যায়।

অক্টোবর মাসের ৮ তারিখ সকাল আমার জন্য এক বিস্ময় বটে, আমি আতঙ্ক অনুভব করি, যা আমি বর্ণনা করছি। আলোটা অত্যুজ্জ্বল ছিল। মানদণ্ডটা বড্ড বেশি ব্যাপক।

আমাদের অনেকে যারা বই লিখেন সম্ভবত অনেকে কাছে পৌঁছানোর ইচ্ছে পোষণ করেন। তবে কিছু কবি অনেকের কাছে পৌঁছানোটা এমন স্থানিক অর্থে নেন না, যে মিলনায়তনটা লোকে পরিপূর্ণ। ওরা অনেকের কাছে সময়গতভাবে পৌঁছে যেতে চান, ক্রমানুসারে, অনেকে সময় নিয়ে, ভবিষ্যতের দিকে, তবে কিছু বুদ্ধিমান উপায়ে এই পাঠকেরা সবসময় একাকী আসেন, একজনের পর একজন।

আমি বিশ্বাস করি, আমাকে এই পুরস্কার দিয়ে সুইডিশ একাডেমি নিবিড়, একান্ত কণ্ঠকে বেছে নিয়ে সম্মানিত করছে, যেটি জনগণের কথা মাঝে মাঝে উদ্দীপ্ত করে অথবা প্রসার ঘটায়, তবে কখনো প্রতিস্থাপন করে না।

সম্পাদক: ইসমাঈল হোসাইন রাসেল
যোগাযোগ: ক্যাম্পাস টাইমস
৪৩ শহীদ নজরুল ইসলাম সড়ক, হাটখোলা রোড, চৌধুরী মল, টিকাটুলি, ঢাকা-১২০৩
মোবাইল: ০১৬২৫ ১৫৬৪৫৫
ইমেইল:[email protected]