2185

'তুমি মাদরাসায় থেকেও মেডিকেলে চান্স পাবে'

'তুমি মাদরাসায় থেকেও মেডিকেলে চান্স পাবে'

2017-09-18 04:03:14

আম্মুর কাছে শুনেছি, আমার নাকি একটা যমজ ভাই ছিল। প্রিম্যাচিউর ছিলাম আমরা। এত ছোট ছিলাম যে, মা সবসময় ভয়ে থাকতেন, আমরা হয়ত বাঁচবনা। আমাদের যখন তিনমাস বয়স, তখন এক সকালবেলা উঠে মা দেখেন, আমার ভাই আর শ্বাস নিচ্ছে না। ঘুমের মধ্যে মারা যাওয়া ভাইটার কথা আমার কিছুই মনে নেই, কিন্তু আমি ওর গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। তাই একটু একটু যখন কেবল বুঝতে শিখেছি, তখন থেকেই ভাবতাম, মানুষ কেন মারা যায়? একটু ঠান্ডা লাগলে বা সামান্য ব্যাথা পেলেই ভয় পেয়ে যেতাম, ডাক্তারের কাছে যেতে চাইতাম। তখন মা বলত, বড় হলে তোমাকেই ডাক্তার বানাব। তখন নিজের চিকিৎসা নিজেই করতে পারবে।

সেই থেকেই যে মাথায় ঢুকল, ডাক্তার হব, তা কখনো পরিবর্তন হয়নি। মা মাদরাসার শিক্ষিকা বলেই চাইতেন, একজন মুসলিম হিসেবে ইসলাম সম্পর্কে যতটুকু জানা আবশ্যিক আমি যেন তা জানতে পারি। তাই মাদরাসায় ভর্তি হলাম। মাদরাসায় পড়া সত্ত্বেও আমার বাংলা ইংরেজি গণিতে কখনো ঘাটতি ছিল না, আমার শিক্ষক বাবার কারণে। আলিয়া মাদরাসায় ছিলাম বলে আমাদের সিলেবাসেও অবশ্য বাংলা ইংরেজি গণিত ছিল।

এস এস সির পর আমার সাথের বন্ধুরা সবাই মাদরাসা ছেড়ে, ঢাকা কলেজ, নটরডেম এর মত কলেজ গুলোতে চলে গেল। কারণ একটাই মাদরাসায় তখন চতুর্থ বিষয় হিসেবে হয় জীববিজ্ঞান, না হয় গণিত নেয়া যেত, দুইটা একসাথে নেয়া যেত না। আমিও মা কে বললাম, অন্য কলেজে ভর্তি হতে চাই। জীবনে কোন কিছুতে মা আমাকে জোর করেন নাই, কিন্তু এইবার করলেন, বললেন, তোমার ভাগ্যে যদি ডাক্তার হওয়া থাকে, তাহলে তুমি মাদরাসায় থেকেও মেডিকেলে চান্স পাবে। মায়ের কথায় আমি তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসায়ই থেকে গেলাম। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগত, আমার সব বন্ধু চলে গিয়েছিল, স্কুলের আমরা মাত্র তিনজন থেকে গেলাম। সেই সাথে যত বড় ভাইদের কথা শুনতাম, সবাই ঢাকা ভার্সিটির ডি ইউনিট, বি ইউনিটে ভালো রেসাল্ট করতেন, মেডিকেলে এডমিশন টেস্টে কেউ ভাল করেছেন, এমন কখনো শুনতাম না।

সবকিছু মাথায় রেখেই শুধুমাত্র মেডিকেলের প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু প্রথমবার পরীক্ষা দিয়ে আমার রেসাল্ট ভাল হল না। সেই রাতে বাবাকে বলেছিলাম, আমাকে আর একটা বছর চেষ্টা করার সুযোগ দিতে। বাবা সাথে সাথেই রাজি হয়েছিলেন। সেই একটা বছর কেবল মনে প্রাণে পড়া গুছিয়েছি, কোথাও ভর্তি হইনি। পরীক্ষা যখন প্রায় কাছে চলে এসেছে, তখন ঘোষণা আসল, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা এবার থেকে আর হবে না, জিপিএ এর ভিত্তিতে মেডিকেলে ভর্তি নেয়া হবে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মত অবস্থা হয়েছিল। ভর্তি পরীক্ষার দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল, সেখানে চিরকালের নিরীহ আমিও যেতাম, শ্লোগান দিতাম। অবশেষে ভর্তি পরীক্ষা হবে এই ঘোষণা এল, কিন্তু অনেক দেরিতে, নভেম্বরে। অনেক অনিশ্চয়তার কথা ভেবে বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষা দেয়া শুরু করলাম। অন্যরা যখন মন দিয়ে পড়ছিল, আমি তখন সারাদেশ ঘুরে ঘুরে পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় একটা ইউনিটে প্রথম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক উইউনিটে ৩৪৩ তম হওয়ার পর একটু কনফিডেন্স ফিরে পেলাম। এবার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পর বাবা যখন জিজ্ঞেস করল, কেমন হয়েছে, আমি বলেছিলাম, এর চেয়ে ভালো আর হওয়া সম্ভব না।

রেসাল্টের দিনটার কথা কখনো ভুলব না। আসুরার ছুটি ছিল সেদিন, আমি রোযা রেখেছিলাম। বাসার সামনে বন্ধুর সাথে ক্রিকেট খেলছিলাম, আমার ফোন ছিল বন্ধুর হাতে। চিরকাল আমার সব মেসেজ চেক করা বন্ধুটি, ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল, তোর একটা মেসেজ এসেছে। বন্ধু কেন মেসেজ পড়ে নাই, এইটা ভাবতে ভাবতে মেসেজ খুলে দেখি, আমি ফার্স্ট হয়েছি। এক দৌড়ে বাসায় গিয়ে সবাইকে বললাম, সেদিন মা অনেক কেদেছিলেন।

মাদরাসার ছেলেমেয়েরা আসলে মেডিকেল এডমিশন টেস্টে ভাল না করার কারণ হল, দেশের মেধাবীরা বেশিরভাগই মাদরাসায় যায় না, গেলেও তারা এইচ এস সি তে অন্য কলেজে চলে যায়, তখন ভাল কোথাও চান্স পেলেও মাদরাসার নামটা আর আসে না। এমনকি আমি ফার্স্ট হওয়ার আগে অনেকে জানতই না, মাদ্রাসা থেকে পড়ে মেডিকেলে এডমিশন টেস্ট দেয়া যায়। আমি বলব, শুধু যে দেয়া সম্ভব তাই নয়, অনেক ভাল রেজাল্ট করাও সম্ভব। পিছনে ফিরে তাকালে তাই জীবনের কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে আফসোস নেই। আমার মা, বাবা এবং শিক্ষকগণ আমাকে এই সিদ্ধান্তগুলো নিতে সাহায্য করেছেন বলেই আজ আমি এখানে আছি, সুপ্রভ'৭০ এর প্রতিনিধিত্ব করতে পারছি। যেখানেই থাকি না কেন, জীবনের শেষপ্রান্তেও এমনভাবেই আমার গর্বের জায়গা হয়ে থাকবে এই মেডিকেল কলেজ, অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে আমার মেধাবী সহপাঠীরা আর আমার সবচেয়ে শ্রদ্ধার পাত্র স্বনামধন্য সব শিক্ষকরা। আমি সৌভাগ্যবান, হয়তো প্রথম হওয়ার সুবাদেই অনেক প্রথিতযশা শিক্ষকদের এত কাছাকাছি আসার সুযোগ হয়েছে।

লেখাটি 'হিউম্যানস অফ ডিএমসি' ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া 

এমএসএল 

স্বত্বাধিকারী: তানভীর সিনহা
সম্পাদক: মো. খালেদ রায়হান
যোগাযোগ: ক্যাম্পাস টাইমস
ঠিকানা: হাউজ ৬, রোড ১৪, সেক্টর ০৪, উত্তরা
যোগাযোগের নাম্বার: +৮৮০১৬৮৭২৮২৮২৬
ইমেইল: m.k.rayhan15@gmail.com