বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং: আমাদের হতাশা- প্রত্যাশা ও বাস্তবতা
2021-06-13 18:58:18
সকালের ঘুম ভাঙ্গলো একটা চমৎকার খবর দেখে।এতোটা অবাক হলাম যে লাফিয়ে উঠে পুরো খবরটা পড়তে বসে গেলাম।যতই পড়ছিলাম, আমার হতাশার মাত্রা ততই বাড়তে থাকলো। সেই হতাশার আগুনে আরেকটু ঘি ঢেলে দিলো যখন গুগলের কাছে উত্তর খুঁজে বুঝতে পারলাম বাস্তবতার চাইতে প্রত্যাশাটা একটু বেশী করে ফেলেছিলাম।
খবরের শিরোনামে দেখলাম বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশের চার বিশ্ববিদ্যালয়!!!এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দেখে আমার আবেগ দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। নিউজের প্রথম কয়েক লাইন পড়েই বুঝলাম আসল সমস্যা এই "সেরা" শব্দটিতে। সাংবাদিক সাহেবও অনেক রসিক বটে।
Quacquarelli Symonds (QS) প্রতি বছরের ন্যায় এবারও সারা বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটা তালিকা করেছে যেখানে স্থান পেয়েছে বিশ্বের ১৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়। এটি বিশ্বের ২০ বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিং নেটয়ার্কের সেরা ৩টি প্রতিষ্ঠানের একটি। এই তালিকায় স্থান পেয়েছে আমাদের ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় যার মধ্যে দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আর দুটি প্রাইভেট। খবরের পাতায় সেরা বলতে যেটা বুঝানো হয়েছে সেটা হলো ঢাবি আর বুয়েট রয়েছে ৮০০-১০০০ স্থানের মধ্যে আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় দুটি (ব্রাক আর এনএসইউ) রয়েছে ১০০১-১২০০ এর মধ্যে। যাই হোক, এতো তলানিতে থেকেও আমাদের ভাগ্যের সাথে সেরা শব্দটার সংযুক্তি ঘটেছে, তাতেই আমরা খুশি! যদিও সরকারি-বেসরকারি মিলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা প্রায় ১৬০টি। একই তালিকায় ভারতের মোট ৩৫ টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে (যার মধ্যে ১-২০০ তে আছে ৩টি, ১-৪০০তে ৮টি এবং ১-১০০০ এর মধ্যে ২২ টি বিশ্ববিদ্যালয়।এই তালিকায় পাকিস্তানের আছে ১১ টি বিশ্ববিদ্যালয়(!!) যার মধ্যে ১-৪০০ ব্রাকেটে ৩টি। শতকরা হার হিসাবে করলে, পাকিস্তানের প্রায় ৬%, ভারতের ৪% আর বাংলাদেশের মাত্র ২% ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় এই তালিকায় রয়েছে।শতকরা হিসাবের পাশাপাশি যদি পজিশনটা চিন্তা করা হয় তবেই বুঝতে পারবো এই প্রতিবেশী দেশগুলো তুলোনায় আমাদের উচ্চ শিক্ষা কতটা সেরা।পাকিস্তানের ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২টি ১৯৪৭-১৯৭১ সাল সময়ের মধ্যে স্থাপিত। অবশিষ্টগুলো একদমই নবীন। একই চিত্র ভারতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।তবে বাঙলার নবীনদের এই অবস্থা কেন?
এখন একটু আলোকপাত করা যাক, এই তিনটি দেশের তুলনামূলক শিক্ষাব্যয়ের দিকে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের তথ্যমতে, ১৯৭১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই তিনটি দেশের মধ্যে ভারতের শিক্ষ্যাব্যয়-জিডিপি’র অনুপাত সব থেকে বেশি। তারপরেই পাকিস্তানের অবস্থান। তাহলে বাংলাদেশের অবস্থান স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে। পাঠক মনে প্রশ্ন আসতে পারে, বারবার ভারত-পাকিস্তানের সাথে তুলনা করছি কেনো? এর পিছনে সদোত্তর হলো, এরা আমাদের অতীত ইতিহাসে সবচেয়ে কাছের দেশ। আর বর্তমানে দেশের যেকোন উন্নয়নকেইএই দুই দেশের সাথে তুলনা করার একটা ট্রেন্ড চালু হয়েছে। এটা সরকারের উচ্চ মহলের মন্ত্রীদেরও করতে দেখা যায়।
তাই আমি করলে নিশ্চয়ই পাঠক বেশি দোষ খুঁজে পাবেন না।
আচ্ছা বাদ দেই এই দুই দেশের কথা, ২০২১ সালের বিশ্ব জনসংখায় পর্যালোচনা তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের উচ্চ জিডিপি অর্জনকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ৪১তম(গুগল)। ঠিক এর পরপর অবস্থান করছে মিসর যাদের এই তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১৩টি! তারপর আছে চিলি যাদের এই তালিকায় আছে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়। ৪৪ ও ৪৫ তম অবস্থানে থাকা ফিনল্যান্ড ও রোমানিয়ার এই তালিকায় রয়েছে যথাক্রমে ৯ ও ১১ টি বিশ্ববিদ্যালয়। আর ৪৮ ও ৫০তম অবস্থানে থাকা পর্তুগাল ও পেরুতে আছে যথাক্রেম ৭টি ও ৮ টি বিশ্ববিদ্যালয়। বলা দরকার যে, জিডিপি ভিত্তিক উন্নত দেশের তালিকায় পাকিস্তান ২০৭-এ অবস্থান করছে। একটু উপরের দিকে তাকালে দেখা যাবে, বাংলাদেশের মাথার উপরে থাকা কলম্বিয়ার (৪০তম) এই তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১৯ টি আর ৪৫তম দেশ মালেয়শিয়ার আছে ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় যার ৭টি প্রথম ৪০০-র মধ্যে। সুতরাং, বুঝাই যাচ্ছে কোন পরিসংখ্যান দিয়ে আমাদের উচ্চ শিক্ষার এই অবনতি অথবা ভগ্নদশার যথাযথতা যাচাই করা যাচ্ছে না। তবে কারণ কী?
মূলত ৬টি চলকের/মানদন্ডের উপর নাম্বার দিয়ে প্রতি বছর এই তালিকাটি প্রকাশ করা হয়। এগুলো হলো, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার, শিক্ষক প্রতি গবেষনায় সাইটেশন, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, সুনাম,নিয়োগ কর্তার সুনাম, আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত এবং আন্তরজাতিক শিক্ষার্থীর অনুপাত। এর মধ্যে সবেচেয়ে বেশী মার্ক থাকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুনাম(৪০%), ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত(২০%), সুনাম, শিক্ষক প্রতি গবেষনায় সাইটেশন(২০%)। ৬টি নির্ধারকের মধ্যে শেষোক্ত ৩টি তে মার্ক থাকে যথাক্রমে ১০,৫,৫। এই ছয়টি নির্ধারকের দিকে তাকালেই আমরা সবাই বুঝে যাবো কেনো আমাদের অবস্থান খারাপ।
এই চলকগুলতে আমাদের নিয়মিত খারাপ করার পিছনে বেশ কিছু কারণ আছে। এর মধ্যে অন্যতম যেটি বলে আমি মনে করি সেটি হলো শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতিতে সরব উপসস্থিতি। অবশ্যই শিক্ষক রাজনীতির কিছু সুন্দর দিক আছে। কিন্তু যে দেশে শতভাগ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক দলীয় রাজনীতিতে ঢুকে যায়, সে দেশে ব্যাক্তিস্বার্থ ছাড়া অন্য কিছু আশা করা দুরূহ এবং এর ভয়াবহতা আমরা দেখতে শুরু করেছি। শিক্ষকরা যত বেশী রাজনীতিতে যাচ্ছে, শিক্ষার মান ও পরিবেশ তত বিনষ্ট হচ্ছে। এরুপ হাজার হাজার উদাহরণ আমরা এখন দেখতে পাই। অন্যদিকে, শিক্ষক নিয়োগেও আমরা অনেক অবহেলা দেখতে পাই। ভিসি মহোদয়দের দেখা যায় নিয়ম-নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে স্বজন প্রীতি আর দুর্নীতিতে লিপ্ত হতে। মূলত, রাজনৈতিক দলের সুদৃষ্টিই তাদের এমন আচরণে সাহস যোগায় এবং জবাবদিহীতার নৈতিক ও বাস্তবিক চাপ থেকে মুক্ত থাকতে সহায়তা করে। কানাডার রেগিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষ্ণণায় বলা হয়, বাংলাদেশের শিক্ষকরা দলীয় রাজনীতিতে লিপ্ত হওয়ায় গবেষণা, পড়াশোনা, ক্লাশ নেওয়া এবং শিক্ষার্থীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে যথেষ্ট সময় পায় না। আর তাই এটি শিক্ষার জন্য একটি অভশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছড়িয়েছে। যে সকল শিক্ষকরা গবেষণা করতে চায় তাঁরা তা পারেন না পর্যাপ্ত তহবিলের অভাবে। বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন এতই কম যে, নিজস্ব অর্থে গবেষণা করার কথা ভাবাই যায় ন। বিদেশী শিক্ষক নিয়গের ক্ষেত্রেও রয়েছে যথেষ্ট আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর প্রণোদনার অভাব। তার উপর, অভ্যন্তরীণ কলহ এখানে একটি বড় সমস্যা। এটা হলফ করে বলা যায়, এদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে পরিবেশ, তাতে স্বনামধন্য একজন বিদেশী প্রফেসরের পক্ষে কাজ করা উনুনের উপর শয়নের মতো। আর বিদেশী শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে হলে উপরের সবগুলো মানদন্ডে ভালো করার পাশাপাশি তাদের জন্য আলাদা শিক্ষাবৃত্তি, উন্নত আবাসন, যাতায়াত ইত্যাদির ব্যবস্থা করা পূর্বশর্ত।
এই তালিকায় এশিয়ার মোট ৩৯৯ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আছে যার মধ্যে ৪৪ টির অবস্থান ২০০-এর মধ্যে। তাই অন্তত এশিয়ার একটি দেশ হিসেবে আমরা গর্বে গর্বিত হতেই পারি।
লেখকঃ
আরিফ আহাম্মেদ
সহকারী অধ্যাপক
হিসাববিজ্ঞান বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়