24095

বাংলাদেশে শিক্ষক ও শিক্ষার মান

বাংলাদেশে শিক্ষক ও শিক্ষার মান

2022-02-09 07:47:09

একটি দেশের শিক্ষার মান নির্ভর করে সেই দেশের শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থার উপর। গবেষণায় দেখা গেছে,  মানসম্মত শিক্ষার ২০ শতাংশ নির্ভর করে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ওপর বাকি ৮০ শতাংশই নির্ভর করে যোগ্য শিক্ষকের ওপর। আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বারবারই শিক্ষকদের মানের কথা বলে আসছেন। সর্বশেষ তিনি মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের যোগ্য হয়ে উঠতে পরামর্শ দেন। শিক্ষকদের মান উন্নয়নে তিনি প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণে আহবান জানান।

যে কোনো পেশাজীবীর মানোন্নয়নে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, তবে মেধার আবেদন শিরোধার্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় সম্পৃক্ত করার জন্য আকর্ষণীয় সুযোগ–সুবিধা ও প্রণোদনা আমাদের দেশে নেই। আমাদের দেশের শিক্ষার মান ও শিক্ষা বাজেট দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন।

আন্তর্জাতিক স্কেলের মানদণ্ডে বাংলাদেশের শিক্ষার মান ২ দশমিক ৮, ভারত ও শ্রীলঙ্কার শিক্ষার মান ২০ দশমিক ৮ এবং পাকিস্তানের শিক্ষার মান ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। এ থেকেই বোঝা যায় শিক্ষাখাতে আমরা আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো থেকেও কত যোজন যোজন দূরত্বে অবস্থান করছি। বিশ্বের সাথে তাল মেলানো তো বহু দূর।

আগেই উল্লেখ করেছি, শিক্ষার মানোন্নয়ন নির্ভর করে শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থার উপর এবং শিক্ষা ব্যবস্থার চেয়ে শিক্ষকদের অবদানই যেহেতু মুখ্য সেহেতু এই দৈন্য দশা থেকে মুক্ত হতে রাষ্ট্রকে দারস্থ হতে হবে যোগ্য শিক্ষকের উপর। কিন্তু অতি পরিতাপের বিষয় আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ এত ত্রুটিপূর্ণ এবং এত অনিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ যে যোগ্য মেধাবীদের শিক্ষাখাতের সাথে সংযুক্ত করা যাচ্ছে না। সেই সাথে শিক্ষকদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান এত নিন্মমানের যে কেউ উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান না।

মেধাবী যারা 'ঘটনাক্রমে' শিক্ষকতা পেশায় আসছেন তারাও সুযোগ পেলে এই খাত থেকে সরে যাচ্ছেন। বিসিএস ক্যাডার চয়েসে শিক্ষা ক্যাডারকে সবচেয়ে নিচে রাখাটা যে বার্তা দেয় তা দেশ ও জাতির জন্য মোটেও কল্যাণকর নয়। কারণ আজ অব্দি আমরা শিক্ষকতা পেশাটিকে মর্যাদার আসনে বসাতে পারি নাই। আমরা মুখেই বলি 'শিক্ষকেরা সমাজের সবচেয়ে সন্মানিত, পূজনীয় ব্যক্তি' আসলে এইটা একটা সোসিওপলেটিক্যাল ফ্যালাসি। এই মিথ্যার চাদরে শিক্ষকদের ঢেকে রেখে দারিদ্রতার নিদারুণ জাতাকলে পিষ্ঠ করা হয়। একজন মেধাবী শিক্ষার্থী কেন শিক্ষকতা পেষায় আসবেন?

আমাদের দেশের মাথাপিছু আয় এখন প্রায় ২৫৯১ মার্কিন ডলার। টাকার হিসেবে বার্ষিক ২২২৬৭০ টাকা প্রায়। অথচ একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাসিক ১৭৫৪০ টাকায় কর্মজীবনে প্রবেশ করেন।।সেই হিসেবে তার বার্ষিক আয় দাঁড়ায় ২১০৪৮০ টাকা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের হিসেব অনুযায়ীই একজন শিক্ষক দারিদ্র সীমার নিচে অবস্থান করেন। আর সমাজে দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী একজন মানুষ নাকি সবচেয়ে বেশি সন্মানিত!

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের মাসিক টিফিন ভাতা ২০০ টাকা। দৈনিকের হিসেবে তা ৭ টাকার কাছাকাছি।  আজকের দিকে ৭ টাকা দিয়ে এক কাপ চা ও পাওয়া যায় না! ৭ টাকার এক কাপ চায়ের বিনিময়ে শিক্ষকদের কাছ থেকে দিনের সর্বোচ্চ সেবাটুকু আশা করা কতটা যৌক্তিক তা আমাদের নীতিনির্ধারকেরাই ভালো বলতে পারবেন।

গত কয়েকদিনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু প্রজ্ঞাপন চোখে পড়ল, ১৪ তম গ্রেডের অফিস সহকারী প্রমশন পেয়ে ১০ম গ্রেডের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হচ্ছেন। একজন অফিস সহকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচ এসসি পাস। অথচ স্নাতক, স্নাতকোত্তর নিয়ে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের জীবদ্দশায় কেউ কেউ হয়ত ১১তম গ্রেডের প্রধান শিক্ষক হতে পারেন তবে সেই সৌভাগ্য সবার কপালে জোটেও না। নিজস্ব কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি না পেলে কাজের উদ্যম আসবে কোথা থেকে?

এই পেশায় না আছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, না আছে সুন্দর ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা! নেই ভালো কাজের পুরস্কারও। তাই শিক্ষকতা পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন মেধাবীরা। যারা দেশকে ভালোবেসে শিক্ষকতাকে 'মহান' পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন তারাও কিছুদিন পরই হতাশা আর দারিদ্রতায় ভোগেন। এখনও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলতে জীর্ণ শীর্ণ অপুষ্টিতে ভোগা লিকলিকে চেহারার সাদা পাকা চুলের মাস্টারমশাই এর চিত্রই ফুটে ওঠে সবার মানসপটে। যার কপালের প্রতি ভাঁজে ভাঁজে ফুটে ওঠে অভাব দারিদ্রতা আর নিজের সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যত। অথচ দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তাদেরই মেধা ও মননের উপর।

উন্নত দেশে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রতি বেশী গুরুত্ব আরোপ করা হয় অথচ আমাদের দেশে ঠিক তার বিপরীত। ফিনল্যান্ড, সিংগাপুর, জাপান, মালয়েশিয়ার প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের অবস্থা যাচাই করলে আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার করুণ বিষয়টি সহজেই উপলব্ধি করা যায়। উন্নত দেশগুলোর কথা বাদ দিলেও আমাদের প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলংকার প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের মান আমাদের দেশের থেকেও অনেক উন্নত।

ভারতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশাটা এতটাই লোভনীয় যে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পর মেধাবীদের প্রথম লক্ষ্য থাকে শিক্ষক হওয়া। আজকের দিনে ভারত,  চীন, সিঙ্গাপুর,  দক্ষিণ কোরিয়া থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ইউরোপ আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছেন। এসব দেশের শিক্ষার্থীরা ইউরোপের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঘা বাঘা প্রফেসরদের অধীনে গবেষণা করছেন। গবেষণা শেষে দেশে ফিরে এসে দেশের হাল ধরছেন। ওই সব গবেষকরা আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের থেকে যোজন যোজন দূরে থাকে শিশু কাল থেকেই। কারণ তাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাটাই তাদের জীবনের ভীত গড়ে দেয়। যা আমরা পারছি না।

মানতেই হবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দৈন্যদশার জন্য শিক্ষার মানের এই করুন দশা এবং যোগ্য শিক্ষকের বড্ড অভাব আমাদের। আমরা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের কাতারে প্রবেশ করেছি। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্র হবার স্বপ্ন দেখি। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন ভঙ্গুর দশা রেখে জাতির ভবিষ্যৎ উন্নয়ন অসম্ভব। শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বাজেটে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষকতা পেশাকে মর্যাদাপূর্ণ করতে হবে।

মেধাবীরা যেন শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী হন সেই দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। শিক্ষকদের জন্য আলাদা পে-স্কেল চালু করতে হবে। গ্রেডের উন্নতির পাশাপাশি শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ,কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে বেতনভাতা নির্ধারণ করতে হবে। একজন এসএসসি পাশ করা শিক্ষক কিংবা কর্মচারীর বেতন আর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে আসা অনার্স মাস্টার্স ডিগ্রীধারী শিক্ষকের বেতন ভাতা নিশ্চয়ই সমান হবার কোনো যুক্তি নেই! এমনকি পিএইচডি ডিগ্রীধারীদেরও প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে হবে৷ মেধাবীকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী সম্মাননা দিয়েই তাকে এ পেশা বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

'আজকের দিনের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ' সেই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ কর্ণধারের শিক্ষাখাতে আজ যে অনুপাতে বিনিয়োগ করবেন ভবিষ্যতে সেই অনুপাতেই ফেরত পাবেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার করেছি আমরা। অনেক দেরি হয়ে গেছে। প্রতিযোগিতার এই দুনিয়ায় আমাদের শিশুদের যদি যোগ্য প্রতিযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে না পারা যায় তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জবাব দেবার মত ভাষা খুঁজে পাওয়া যাবে না।

রাশেদুজ্জামান কানন
শিক্ষক ও গল্পকার

সম্পাদক: ইসমাঈল হোসাইন রাসেল
যোগাযোগ: ক্যাম্পাস টাইমস
৪৩ শহীদ নজরুল ইসলাম সড়ক, হাটখোলা রোড, চৌধুরী মল, টিকাটুলি, ঢাকা-১২০৩
মোবাইল: ০১৬২৫ ১৫৬৪৫৫
ইমেইল:[email protected]