
প্রায় ১৩ দিন বন্ধ থাকার পর সীমিত পরিসরে চালু হয়েছে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। নিছক ‘ভুল বোঝাবুঝি’ থেকে হাসপাতালটির চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পিটিয়ে তাড়িয়ে দেন জুলাই আন্দোলনের আহতরা। এরপর থেকেই হাসপাতালটি বন্ধ রয়েছে। ১৩ দিন ধরে হাসপাতালটি কেন বন্ধ, কারা অবস্থান করছেন সেখানে, কী দাবি তাঁদেরে—এসব নিয়ে আজ সোমবার অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগো নিউজ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সালাহ উদ্দিন জসিমের প্রতিবেদনটি ক্যাম্পাসটাইমসের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলোে—
দেশের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ একমাত্র সরকারি চক্ষু হাসপাতাল জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। ১৩ দিন ধরে বন্ধ হাসপাতালটির চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম। সেখানে অবস্থান করছেন শুধু জুলাই আন্দোলনের কিছু আহত। তাদের নিয়মিত খাবার সরবরাহ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে ৬০০ কোটি টাকার এ হাসপাতালটি এখন যেন আবাসিক হোটেল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
গত ২৮ মে নিছক ‘ভুল বোঝাবুঝি’ থেকে হাসপাতালটির চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পিটিয়ে তাড়িয়ে দেন জুলাই আন্দোলনের আহতরা। এরপর থেকে নিরাপত্তা শঙ্কায় কেউ হাসপাতালে আসছেন না। হাসপাতালের সব সেবা বন্ধ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, শহীদ জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশসহ অনেকে চেষ্টা করেও বিষয়টির সমাধানে নিয়ে আসতে পারেননি।
এরই মধ্যে গত কয়েকদিন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা, সহকারী উপদেষ্টাসহ নানান পক্ষের তৎপরতায় দফায় দফায় বৈঠক হয়, তদন্ত কমিটি কাজ করে। অবশেষে গত ৩ জুন হাসপাতালের জরুরি বিভাগটি চালুর সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি দেশসেরা চক্ষু বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বলা হয়, মেডিকেল বোর্ড ৪ জুন হাসপাতাল পরিদর্শন করবে। একই সঙ্গে বোর্ড জুলাই আহতদের চিকিৎসা সমন্বয় এবং সামগ্রিক কার্যক্রম নির্ণয় করবে।
যেমন সিদ্ধান্ত তেমন কাজ। বন্ধের এক সপ্তাহ পর ৪ জুন পুলিশি পাহারায় যথারীতি জরুরি বিভাগ চালু করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরাও পরিদর্শনে আসেন। তারা হাসপাতালে এসে জুলাই আহতদের সঙ্গে চিকিৎসাসংক্রান্ত বৈঠকে বসতে চান। এর মধ্যে ৩০ জন তাদের ডাকে সাড়া দেন। এদের চিকিৎসাও দেন বোর্ডের সদস্যরা। তবে বেশিরভাগ রোগীকেই ছাড়পত্র (রিলিজ) দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মেডিকেল বোর্ড।
মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা চলে যাওয়ার পর জরুরি বিভাগের সামনে আবাসিক চিকিৎসকের (আরএস) রুম থেকে হইহুল্লোড় শোনা যায়। এগিয়ে গিয়ে দেখা যায়, জুলাই আহতরা চিকিৎসকদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় লিপ্ত।
এর মধ্যেই নিরাপত্তাজনিত কারণে আবাসিক চিকিৎসকসহ উপস্থিত কয়েকজন চিকিৎসক হাসপাতাল ত্যাগ করেন। ভারপ্রাপ্ত পরিচালককে তাদের দাবির প্রতি সম্মতি দিয়েই পুলিশ প্রটোকলে বের হতে হয়। জুলাই আহতরা সাফ জানিয়ে দেন, ‘নানান কারণে আমাদের ঢাকায় আসতে হয়। ঢাকায় এসে থাকবো কোথায়? এজন্য আমাদের পক্ষে হাসপাতাল ছাড়া সম্ভব নয়।’ এসময় জুলাই আহতরা তাদের রিলিজের যাবতীয় কাগজ ছিঁড়ে ফেলেন।
এ নিয়ে হাসপাতালটির একাধিক চিকিৎসক জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, সরকারের ৬০০ কোটি টাকার সরঞ্জাম সমৃদ্ধ অত্যাধুনিক এ হাসপাতালটি এত দিন বন্ধ। প্রতিদিন পাঁচ হাজার মানুষ সেবাবঞ্চিত হচ্ছে। এ নিয়ে তাদের (জুলাই আহতদের) কোনো মাথাব্যথা নেই। তাদের কথা হলো, ‘আমরা ঢাকায় এসে কোথায় থাকবো?’ তাদের থাকার জায়গা সরকার ভিন্ন কোথাও দিতে পারে। কিন্তু হাসপাতাল তো আবাসিক হোটেল বা লিল্লাহ বোর্ডিং হতে পারে না। এখানে জরুরি প্রয়োজনে রোগী ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
চিকিৎসকদের ভাষ্য, ‘জুলাই আহতদের কেউ কেউ এত দিন বলেছে, আমাদের চিকিৎসা ভালো নয়। সরকার এখন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিভাগের চেয়ারম্যান, ঢাকা মেডিকেল কলেজের চক্ষু বিভাগের প্রধান, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) চক্ষু বিভাগের প্রধান এবং ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং ঢাকার বিভাগীয় প্রধানের সমন্বয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে দিলো। দেশসেরা এই চিকিৎসকরা তাদের চিকিৎসার বিষয়ে মতামত দিলেন। কিন্তু তারা এটাও মানে না।’
“অবশ্য, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে এসেও একজন জুলাই আহত হাসপাতালের পরিচালকের সামনে বলেন, ‘ওটা (মাউন্ট এলিজাবেথ) ভুয়া হাসপাতাল। আমাদের আমেরিকা বা ইউরোপ পাঠান’।”
কী বলছে মেডিকেল বোর্ড
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোস্তাক আহমেদ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আব্দুল ওয়াদুদ, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) চক্ষু বিভাগের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাঈল হোসেন এবং ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান ডা. মোমিনুল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের যৌথ স্বাক্ষরিত প্রতিবেদন গত ৪ জুন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব বরাবর জমা দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে চারটি মতামত তুলে ধরা হয়
১. রোগীদের প্রদত্ত চিকিৎসা এবং চলমান চিকিৎসা সন্তোষজনক; ২. আপাতত রোগীদের ছাড়পত্র দিয়ে প্রয়োজনে নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগের জন্য উপদেশ দেওয়া হলো; ৩. বিশেষ ক্ষেত্রে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ), ইস্পাহানি ইসলামিয়া আই ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হসপিটাল, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করার জন্য উপদেশ দেওয়া হলো এবং ৪. তাদের অতিসত্বর যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার জন্য জোর সুপারিশ করা হলো।
প্রতিবেদন মোতাবেক মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্ত প্রতিপালনে কাজ করতে গিয়ে সেদিন (৪ জুন) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অবরুদ্ধ ছিলেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. জানে আলম।
জানতে চাইলে ডা. জানে আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত বুধবার (৪ জুন) মেডিকেল বোর্ড এসেছিল। তখন হাসপাতালে ভর্তি ৫৫ জন জুলাই আহতের মধ্যে ৩০ জন বোর্ডের ডাকে সাড়া দেয়। চিকিৎসাপত্র ও নানাবিধ রিপোর্ট দেখে বোর্ড সিদ্ধান্ত দেয়, তাদের হাসপাতালে থাকার দরকার নেই। তারা বাড়ি চলে যাবে। সমস্যা হলে ফলোআপ করবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা সব কাগজপত্র রেডি করেছিলাম। কিন্তু তারা মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্ত মানেনি। তারা তাদের মতো থাকবে। কোনো অর্ডার মানবে না। তাদের কথা হচ্ছে, এখানে বসে ওরা ওদের বার্গেনিং করবে। সরকার থেকে নানান দাবি আদায় করে নেবে।’
ডা. জানে আলম বলেন, ‘ওইদিন তো তারা (জুলাই আহতরা) আমাকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অবরুদ্ধ করে রেখেছে। পরে আমি তাদের দাবির প্রতি সহমত প্রকাশ করে পুলিশের সহায়তায় বেরিয়ে এসেছি।’
‘তারা কিন্তু এরই মধ্যে বেশিরভাগ বাড়ি চলে গেছে। এখন (৬ জুন রাত পর্যন্ত) মাত্র সাত-আটজন আছে। তাদের কেউ রিলিজ নেয়নি। যে যার মতো আবার এসে থাকবে, এমনটাই তাদের চাওয়া। তাই হাসপাতাল থেকে তারা রিলিজ নিতে চায় না’- যোগ করেন ভারপ্রাপ্ত পরিচালক।
মেডিকেল বোর্ড সিদ্ধান্ত দিলো, জুলাই আহতদের হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই। আবার হাসপাতালে থেকেও তাদের চিকিৎসা হচ্ছে না, যেহেতু হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম বন্ধ। তাহলে তারা এখন কী হিসেবে সেখানে থাকছে? আবাসিক হোটেল বা লিল্লাহ বোর্ডিং হিসেবে কি না—জানতে চাইলে ডা. জানে আলম বলেন, ‘ওই রকমই। তাদের ঢাকায় থাকা দরকার। এখন হাসপাতালকে বেছে নিয়েছে থাকার জন্য।’
চক্ষু হাসপাতালে থাকা জুলাই আহতদের মধ্যে একজনের নাম হিল্লোল। তাদের দাবি-দাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভাই, এই গ্যাঞ্জামটা আমাদের ছিল না। আমাদের দাবি-দাওয়া অনেকবার দিয়েছি। আমার মনে হয়, আহতরা আর দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলবে না। সারা বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মানুষের খালি দাবি দাবি দাবি। দেশটা আমার আপনার সবার ভাই। মানবতার দিক দিয়ে কেউ না কেউ ছাড় না দিলে দেশটা আগাবে কী করে ভাই? আর কত দাবি দেব ভাই? চিকিৎসা, পুনর্বাসন, এ ও বলে বলে, আপনারা নিজেরাও তো জানেন। প্রত্যেকটা জায়গায় তো একই কথা। আমরা এ ব্যাপারে আর কথা বলব না এ রকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সরকার, দেশ যেটা ভালো মনে করে করুক।’
নেপথ্যে পাঁচ কারণ
জুলাই আহতরা কেন চিকিৎসা শেষ হওয়ার পরও হাসপাতাল ছাড়ছেন না—এ নিয়ে অনুসন্ধানে উল্লেখযোগ্য পাঁচটি কারণ উঠে এসেছে।
১. সেটেল হওয়ার জন্য ইউরোপ-আমেরিকা যাওয়া অথবা যথাযথ পুনর্বাসনের আশায় তারা হাসপাতালে থাকছেন। তাদের ধারণা, হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেলে সরকার বা কর্তৃপক্ষের নজর তাদের দিকে থাকবে না।
২. জুলাই আহতদের মধ্যে দু-একজন অর্থের বিনিময়ে অন্য রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি, অপারেশনের সিরিয়াল এগিয়ে দেওয়াসহ নানান তদবিরে জড়িয়ে পড়েছেন। আবার কেউ কেউ সেখানে বসে ওই হাসপাতালসহ ঢাকার অন্য হাসপাতালগুলোর নিয়োগ ও টেন্ডারে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছেন। জোটবদ্ধ হয়ে হাসপাতাল ও বিভিন্ন দপ্তরে যাচ্ছেন।
৩. হাসপাতালে অবস্থান করা দু-একজনের যাওয়ার মতো জায়গাও নেই। তারা বউ-বাচ্চা নিয়ে হাসপাতালে থাকেন। একজনের নামে দুই থানায় মাদক মামলা আছে, অভিযোগপত্র দাখিলও হয়ে গেছে। হাসপাতাল থেকে চলে গেলে গ্রেফতারের ভয় আছে তার।
৪. বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের আহ্বানে তাৎক্ষণিক যে কোনো কর্মসূচিতে সবার আগে দৌড়ে গিয়ে যোগ দেন এই হাসপাতালে অবস্থান করা আহতরা। যে কারণে তাদের বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্তে যাচ্ছেন না ছাত্র সমন্বয়ক ও এনসিপি নেতারাও।
৫. জুলাই আন্দোলনে এই আহতদের অনেকের বাড়ি ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায়। তাদের জুলাই ফাউন্ডেশনসহ নানান জায়গার কাজে ঢাকায় আসতে হয়। ঢাকায় তাদের থাকার জায়গা নেই। তাই হাসপাতালটিতে দখলে রাখা সিট তারা ছাড়তে চায় না। এখানে যখন-তখন যেন এসে থাকা যায়, খাওয়াও পাওয়া যায়—এটিই তারা চান।
এরকম অন্তত পাঁচটি কারণে হাতেগোনা কয়েকজন অন্য জুলাই আহতদের নানাভাবে বুঝিয়ে হাসপাতাল দখলে রাখতে উদ্বুদ্ধ করছেন। আহতদের মধ্যে যারা বাড়িতে আছেন তাদেরও এই হাসপাতালে এসে সিট দখল নেওয়ার প্রলোভন দেখাচ্ছেন। এক্ষেত্রে তারা অন্যদের বলছেন, সরকার জুলাই আহতদের দুই হাজার ৬০০ ফ্ল্যাট দেবে। ঢাকায় থাকলে ফ্ল্যাট পাওয়া যাবে। চলে গেলে দেবে না।
এই জুলাই আহতরা অন্য সুযোগ-সুবিধাও একে অন্যের মধ্যে ভাগ করে নিচ্ছেন। বিভিন্ন সহযোগিতার অর্থ ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে তাদের মধ্যে গ্রুপ, সাব-গ্রুপও হয়েছে। মাঝেমধ্যে হাসপাতালের ভেতরে নিজেরাই মারামারিতে জড়িয়ে পড়ছেন।
একজনেরও হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই: পরিচালক
ছুটিতে থাকা হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা স্বীকার করি যে, তারা (জুলাই আহত) অনেক বড় স্যাক্রিফাইস করেছে। তাদের অনেকের দুই চোখ ক্ষতিগ্রস্ত, অনেকের এক চোখ ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা সাধ্যের পুরোটা দিয়েই চিকিৎসা দিয়েছি। এমনকি যাদের প্রয়োজন তাদের বিদেশে পাঠিয়েছি। বিদেশ থেকে বিখ্যাত ডাক্তারদের এনেও চিকিৎসা করিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘তাদের এখন প্রয়োজন পুনর্বাসন। সেটিও মন্ত্রণালয়সহ সব জায়গায় বলেছি। সমন্বিত প্রচেষ্টা চলমান। এরই মধ্যে পরপর কয়েকটি ঘটনা তারা ঘটিয়েছে। যেসব ঘটনায় আমরা বিব্রত। তারপরও তাদের মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছিলাম। সর্বশেষ গত ২৮ মে তারা যেভাবে চিকিৎসক ও স্টাফদের গায়ে হাত তুলেছে, এতে তারা (ডাক্তার-স্টাফ) অনিরাপদ বোধ করছেন। হাসপাতালে আসতে চাইছেন না।’
‘জুলাই আহতদের চিকিৎসাটা এখন মূলত ফলোআপ বা চলমান চিকিৎসা। এজন্য তাদের এনআইওর (জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতাল) মতো বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। যার যার এলাকায় ফেরত যেতে পারে। তাদের অসুস্থতার সিমটম দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট এলাকার মেডিকেল কলেজগুলোর চক্ষু বিভাগে যাবে, সেখানে তাদের সেবা দিতে পারবে।’
অধ্যাপক ডা. খায়ের আরও বলেন, ‘যদি ওই হাসপাতাল মনে করে অস্ত্রোপচার লাগবে বা বিশেষায়িত কোনো সেবা লাগবে, তারা এনআইওতে রেফার করবে। আমরা সেটা করে দেবো। অথবা সরকার যদি মনে করে তাদের ঢাকার হাসপাতালে রেখেই সেবা দেবে, তাহলে অন্য হাসপাতালে শিফট করতে হবে।’
জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাসপাতালে যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটা স্বাভাবিক করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটা কীভাবে চালু করা যায়, চেষ্টা হচ্ছে। আহতদের বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া এবং পুনর্বাসনের দাবির বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট। আমরা চেষ্টা করছি, যাদের বিদেশ যাওয়া প্রয়োজন, যাবে। পুনর্বাসন কমন দাবি, কিন্তু একেকজনের একেকভাবে পুনর্বাসন করতে হবে, কাজটা সহজ নয়। আমরা চেষ্টা করছি।’
মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তও তো জুলাই আহতরা মানে না, এখন কী করবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিষয়টি সময় নিয়ে ভাবছি। যেহেতু ঈদের ছুটিতে তারা বেশিরভাগ চলে গেছে। এ মুহূর্তে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছি। এটা খুবই সংবেদনশীল ব্যাপার। গত ৪ জুনের ঘটনা আপনারা জানেন, আমরাও জানি। আমরা চেষ্টা করছি, ঈদের পর পরিস্থিতি যেন স্বাভাবিক করা যায়।’
প্রয়োজন সম্মিলিতভাবে কঠিন সিদ্ধান্ত
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের বিষয়টি খুবই বিব্রতকর। এ ঘটনায় সারাদেশে মানুষের কাছে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে। মাত্র কয়েকজন আহতের বিশৃঙ্খল আচরণের কারণে সারাদেশে জুলাই আহত ও পঙ্গুদের ত্যাগ বিতর্কিত হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকার, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং ছাত্র সমন্বয়কদের সমন্বয়ে সম্মিলিতভাবে কঠিন সিদ্ধান্তে আসা দরকার। এভাবে চলতে পারে না। চলতে দেওয়া যায় না।’
ঈদের আগের দিন (৬ জুন) খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি জুলাই আহত ৫৫ জনের মধ্যে মাত্র চারজন এখনো অবস্থান করছেন। তাদের সঙ্গে ভর্তি ছাড়া বহিরাগত আছেন তিনজন। অন্যরা বাড়ি চলে গেছেন। কিন্তু বাড়ি গেলেও তারা রিলিজ নেননি। তারা তাদের সুবিধামতো সময়ে এসে আবার এখানে থাকবেন।
যেভাবে হামলা-মারধরের সূত্রপাত
কর্মস্থলে নিরাপত্তার দাবিতে গত ২৮ মে কর্মবিরতি পালন করেন চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। জরুরি বিভাগ ছাড়া নিয়মিত অস্ত্রোপচার থেকে শুরু করে সব চিকিৎসাসেবা বন্ধ ছিল। যে কারণে সকাল থেকেই হাসপাতালে আসা সাধারণ রোগী ও সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে কর্মীদের কথা কাটাকাটি হয়। বেলা সাড়ে ১১টার পর চিকিৎসক ও রেজিস্ট্রার মাহফুজ আলম বিষয়টি ব্যাখ্যা করে সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।
যাদের পূর্বনির্ধারিত অস্ত্রোপচারের তারিখ ছিল, তাদের পরে ফোনে ডেকে এনে অস্ত্রোপচার করে দেবেন বলে জানান। এতেও সেবাপ্রার্থীরা নিবৃত হননি। তারা হইহুল্লোড় ও হট্টগোল করতে থাকেন। চিকিৎসক ও নার্সদের দিকে তেড়ে যান। এসময় আনসার সদস্যরা নিবৃত করতে গেলে হাতাহাতি হয়। হাসপাতালের কর্মী ও সেবাপ্রার্থীদের মধ্যে মারামারিও হয়।
এরপর পুরো হাসপাতালে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে ভেতরের সব ওয়ার্ডের কলাপসিবল গেট আটকে তালা দিয়ে দেন নিরাপত্তারক্ষীরা। বিষয়টি নিজেদের জন্য আতঙ্কের বা আক্রমণাত্মক হতে পারে—এমন আশঙ্কায় উল্টো তালা ভেঙে জুলাই আহতরা লাঠিসোঁটা ও রড হাতে চিকিৎসক, কর্মী ও সেবাপ্রার্থীদের এলোপাতাড়ি পেটানো শুরু করেন। তাদের সঙ্গে এসে সেই হামলায় যোগ দেন পঙ্গু হাসপাতালে থাকা জুলাই আহতরাও।
এ ঘটনায় চিকিৎসকসহ ১৫ জন আহত হন। এরপর আতঙ্কে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মীদের বেশিরভাগ দ্রুত হাসপাতাল ছেড়ে যান। তাদের কেউ কেউ ভেতরে আটকা পড়লে সেনাসদস্যরা গিয়ে উদ্ধার করেন। এরপরই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম। কার্যত ওইদিন থেকে পুরো হাসপাতাল জুলাই আহতদের দখলে চলে যায়। এরপর থেকে হাসপাতালে যাচ্ছেন না চিকিৎসক-নার্সসহ অন্য কর্মীরা। সেখানে এখন শুধু জুলাই আহতরা অবস্থান করছেন। সরকার রুটিনমাফিক তাদের জন্য খাবার সরবরাহ করছে।