ঢাবি ভর্তি বিজ্ঞপ্তি থেকে ট্রান্সজেন্ডার শব্দ প্রত্যাহারের দাবি


DU Correspondent | Published: 2023-12-30 23:14:31 BdST | Updated: 2024-05-03 05:04:55 BdST

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্ডারগ্র্যাজুয়েড প্রোগ্রামে (স্নাতক প্রথম বর্ষ) ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে ‘ট্রান্সজেন্ডার/হিজড়া’ কোটা থেকে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আগামী ১ জানুয়ারির মধ্যে সংশোধিত ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকশের আল্টিমেটাম দেয় তারা।

শনিবার (৩০ ডিসেম্বর) বিকেল ৪ টায় টিএসসিতে ঢাবি সাংবাদিক সমিততে (ডুজা) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সাখাওয়াত জাকারিয়া এ দাবি জানান।

লিখিত বক্তব্যে জাকারিয়া বলেন, গত ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় রেজিস্টার প্রবীর কুমার সরকার স্বাক্ষরকৃত ২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে কোটার অংশে হিজড়া বোঝাতে বিকল্প চিহ্ন দিয়ে উল্লেখিত ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটি শিক্ষার্থীদের প্রবলভাবে আহত করে। পরবর্তীতে সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে এই বিজ্ঞপ্তি ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ মারাত্মকভাবে ব্যাথিত হন। দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সামলোচনার জন্ম নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাই ভর্তি বিজ্ঞপ্তি থেকে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দের প্রত্যাহারের দাবি তুলে। যে দাবি জনদাবিতে পরিণত হলে গত ২১ ডিসেম্বর ২৩ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরের শিক্ষার্থীরা সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করে। মানববন্ধন শেষে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি থেকে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটির প্রত্যাহার জানিয়ে শিক্ষার্থীরা উপাচার্য বরাবর একটি স্মারকলিপি প্রদান করে।

কোনো সাড়া না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা আশা করেছিল এক সপ্তাহের মধ্যে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়া হবে এবং ভর্তি বিজ্ঞপ্তি থেকে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। কিন্তু এক সপ্তাহ অতিক্রম হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আমাদের দাবি মেনে নেওয়া হয়নি।

ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ে তিনি বলেন, হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার এক নয়। ট্রান্সজেন্ডার শব্দ দ্বারা শুধু হিজড়াদেরকেই বোঝানো হয় না। বরং যারা নিজের খেয়াল খুশিমত নিজেকে ছেলে/মেয়ে দাবি করবে তাদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করে। আমরা হিজড়া জনগোষ্ঠীর কোটার অধিকারের পক্ষে। আমাদের তিন দফা দাবির অন্যতম একটি হলো, হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বিঘ্নে পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। যদিও সম্মানিত ভিসি মহোদয় বলছেন ট্রান্সজেন্ডার শব্দ দ্বারা তারা শুধু হিজড়াদেরকেই অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কিন্তু যেহেতু ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি শুধু হিজড়া নয়; যারা ইচ্ছাকৃতভাবে লিঙ্গ পরিবর্তন বা নিজেকে খেয়ালখুশি মতো ছেলে/মেয়ে দাবি করে বসে তাদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করে। তাই এ ধরনের একটি বিতর্কিত শব্দকে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি অন্তর্ভুক্ত করা তথাকথিত ট্রান্সজেন্ডারদের সমাজ ও সংস্কৃতি পরিপন্থি বিকৃত এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করছে।

নীতি নির্ধারকদের প্রতি অনাস্থার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ভিসি স্যার ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুতে নীতি নির্ধারনের জন্য যাদের উপর নির্ভর করেছেন, আমরা তাদের উপর আস্থা রাখতে পারছি না। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে হিজড়াদের সাথে ট্রান্সজেন্ডার শব্দটিকে অন্তর্ভুক্ত করে ট্রান্স কালচারের মতো সমাজ ও সংস্কৃতি পরিপন্থি একটি বিকৃত সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করার চেষ্টা করছেন। তারা জেনে বুঝেই ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া শব্দকে এক করে ফেলার চেষ্টা করছেন।

হিজড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার স্বার্থে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি থেকে 'ট্রান্সজেন্ডার' শব্দটি বাতিলের দাবি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, মাননীয় উপাচার্য বলেছেন যে 'ট্রান্সজেন্ডার' শব্দ দ্বারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সুবিধাবঞ্চিত হিজড়া জনগোষ্ঠীকে বুঝিয়েছে। কিন্তু Oxford University Press থেকে প্রকাশিত A Dictionary of Gender Studies a 'Transgender' বলতে বুঝিয়েছে 'Transgender Refers to gender identity and includes people who identify as female or male but were born or assigned the other sex at birtth'

যা ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাপী একাডেমিক সংজ্ঞায়নে 'ট্রান্সজেন্ডার' শব্দটি এভাবেই প্রচলিত এবং পৃথিবীব্যাপী এভাবেই ব্যবহৃত হয়। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পৃথিবীব্যাপী প্রচলিত সংজ্ঞায়নের বিপরীতে নতুন সংজ্ঞায়ন দাঁড় করালে তা স্থায়ী হবে না। বরং "ট্রান্সজেন্ডার' শব্দটি ভুলভাবে ব্যবহৃত হওয়ার মাধ্যমে একটি ভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য সুযোগ তৈবি করবে। ফলশ্রুতিতে সুবিধাবঞ্চিত হিজড়া জনগোষ্ঠীর নিজেদের প্রাপ্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।

'ট্রান্সজেন্ডার' শব্দটি আমাদের দেশীয় শব্দ নয়। এমনকি বাংলা একাডেমির অভিধানে বিশেষ করে Bangla Academy Bengali-English Dictionary (32nd Reprint: Paush 1422/December 2015 Edited by: Mohammad Ali), Bangla Academy English-Bangla Dictionary (Revised & Enlarged 2nd Edition, Seventh Reprint: Magh 1421/January 2015, Edited by Zillur Rahman Siddiqui) ও বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান (পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণের দ্বিত আশ্বিন ১৪২৪/ সেপ্টেম্বর ২০১৭, সম্পাদক- জামিল চৌধুরী) এই তিনটি অভিধানের কোথাও ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটির কোনো উল্লেখ নেই। তবে হিজড়া শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে hermaphrodite eunuch এর উল্লেখ থাকলেও এগুলো ব্যতিত অন্যকোনো শব্দের উল্লেখ নেই। এমতাবস্থায় একটি বিতর্কিত শব্দকে কেন ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে যুক্ত করা হলো তা- আমাদের বোধগম্য নয়। আমরা মনে করি ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে এই শব্দ সংযুক্তির মাধ্যমে দেশীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির উপর আঘাত করা হয়েছে। আমাদের দেশজ সংস্কৃতি রক্ষায় প্রত্যাহার করা অত্যন্ত জরুারি।

ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু নিয়ে জাতীয় মানবধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ এর বক্তব্য উল্লেখ করে বলেন, তিনি তার বক্তব্যে জানিয়েছেন যে, "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু শিক্ষার্থী ট্রান্সজেন্ডার কোটা বাতিলের দাবি করেছে। কমিশন মনে করে এ ধরনের কর্মকাণ্ড অমূলক এবং এক্ষেত্রে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা প্রতীয়মান।" বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আমরা তার এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই তাঁর বক্তব্য সম্পূর্ণ অসত্য। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবি দাওয়া সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কখনোই হিজড়া জনগোষ্ঠীর কোটার বিরোধীতা করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হিজড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার জন্যই আন্দোলন করে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, মানবধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের এই অবিবেচনা প্রসূত বক্তব্য শিক্ষার্থীদের ক্ষোভকে আরও উস্কে দিবে। যা বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। সুতরাং দায়িত্বশীল জায়গা থেকে তার এই ধরণের বক্তব্য কখনোই কাম্য নয়।