সামিয়া রহমানকে নিয়ে 'জবানবন্দি' লিখলেন পিতা মাহমুদুর রহমান


ঢাকা | Published: 2021-02-08 18:56:56 BdST | Updated: 2024-03-28 16:11:18 BdST

বহু দিন ধরে আমরা চুপ করেই ছিলাম। প্রায় চারটি বছর। আইনগত কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল। অনেকে বারবার বলেছেন সামিয়া রহমান এতদিনেও চুপ করে আছে কেন? একবার ক্ষমতাধর ষড়যন্ত্রকারীদের খপ্পরে পড়ুন তো, আইনগত জটিলতায় পড়ুন, তারপর বুঝবেন কখন কথা বলা যায়, আর কখন নয়! রাষ্ট্রের আইনের প্রতি আমার কন্যা শ্রদ্ধাশীল বলেই তার প্রতি এত চরম অন্যায় হওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত কোনো জবানবন্দি দেয়নি।

তদন্তাধীন বিষয়ে সামিয়ার পক্ষে নিজে থেকে এই লেখা সম্ভব নয় বলেই, আমি নিজে তার পিতা হয়ে কলম ধরতে বাধ্য হয়েছি। অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয় এক মাসের তদন্তকে টেনেহিঁচড়ে প্রায় চার বছরে এনে রায় দিয়েছে। এমনকি এই সিন্ডিকেট ট্রাইব্যুনালের একটা সিদ্ধান্তও মানেনি। কারণ সামিয়াকে যে শাস্তি দিতেই হবে। ২০১৯ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনজীবী মেজবাহ সাহেবকে বিষয়টি স্ক্রুটিনি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তার সিদ্ধান্তও সিন্ডিকেট মানেনি।

অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রশাসনের কাছ থেকে এই রায় প্রতীক্ষিতই ছিল। তদন্ত শুরুর আগে থেকেই ক্ষমতাধরদের কেউ কেউ যেভাবে আমার কন্যা সামিয়া রহমানকে গালমন্দ এবং হুমকি দিচ্ছিলেন তাতে বোঝাই যাচ্ছিল তাদের মোটিভ। সর্বত্র সেই ক্ষমতাধর চরিত্র আমার মেয়ের চরিত্র, আমার মেয়ের পোশাক, আমার মেয়ের চেহারা নিয়ে সরবে বিনোদনমূলক আলোচনা করতেন। বিভিন্ন পত্রিকা টেলিভিশন আমার মেয়ে সামিয়া রহমানের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে তার বিরুদ্ধে নিউজ করার জন্য, একবারও তার কোনো বক্তব্য না নিয়ে। এই নাকি আমাদের সাংবাদিকতা। যদিও ঘটনার ২/৩ দিন পর দু-তিনটি হাতেগোনা পত্রিকা ফোনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমার মনে হয় এবার সময় এসেছে, বক্তব্য খোলাসা করার।
আমার কন্যা সামিয়া রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। কোনো বাবা, চাচা, শ্বশুর সূত্রে যোগদানে সহায়তা নেয়নি। সামিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে ১৯৯৫ সালে সম্মান এবং ১৯৯৬ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে দু-দুবার প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে তার কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ দুবার স্বর্ণপদক অর্জন করে।

দলীয়করণের রাজনীতি বোধহয় তখন এত প্রবল ছিল না বলেই সর্বোচ্চ স্থান পেয়েছিল আমার মেয়েটি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু মেধার জোরে চাকরিও হয়েছিল তার।
“A New Dimension in Colonialism and Pop Culture: A Case Studz of the Cultural Imperialism” প্রবন্ধটিতে সামিয়ার নাম লেখক হিসেবে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো জার্নালে কোনো নিবন্ধ জমা দেওয়ার সময় লেখকের স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়। উক্ত নিবন্ধটি প্রকাশনার জন্য এডিটোরিয়াল বোর্ডে দাখিল করা থেকে প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত কোনো ধাপেই সামিয়ার কোনো স্বাক্ষর, সম্পৃক্ততা এবং উপস্থিতি ছিল না, যা তদন্ত কমিটিও খুঁজে পায়নি। ট্রাইব্যুনালের রিপোর্টেও এটা স্পষ্টাক্ষরে লেখা আছে। এবং মারজান তদন্ত কমিটির কাছে লিখিতভাবে স্বীকারও করেছে লেখাটি সেই জমা দিয়েছে। এবং সাইটেশনের ভুলটিও ছিল মারজানের অনভিজ্ঞতাবশত ভুল (তদন্ত কমিটির কাছে মারজানের দেওয়া তথ্য অনুয়ায়ী)।

রিভিউয়ারের লেখাও মারজান গ্রহণ করে, সামিয়াকে দেখায়নি পর্যন্ত। প্রমাণস্বরূপ এ সংক্রান্ত মেইলটিও তদন্ত কমিটির কাছে সামিয়া জমা দিয়েছিল। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী লেখক কোনো নিবন্ধ জমা দেওয়ার পর সেই নিবন্ধটি এডিটোরিয়াল বোর্ড যাচাই-বাছাই করে প্রকাশের যোগ্য মনে করলে একজন রিভিউয়ারের কাছে পাঠান, রিভিউয়ার সেটি সংশোধন করে তাঁর ইতিবাচক বা নেতিবাচক মতামত লিখিতভাবে এডিটোরিয়াল বোর্ডকে জানান। অতঃপর রিভিউয়ার এর রিপোর্টের আলোকে, এডিটোরিয়াল বোর্ড নিবন্ধটি পুনরায় লেখকের কাছে সংশোধনের জন্য পাঠান। লেখক সংশোধন করে দিলে এডিটোরিয়াল বোর্ড নিবন্ধটি পুনরায় পর্যালোচনা করে যথাযথ ও মানসম্মত বিবেচনা করলে তা জার্নালে প্রকাশিত হয়। বর্ণিত নিবন্ধটি সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান ডিন অফিসে জমা দিয়েছিল মর্মে তদন্ত কমিটির কাছে স্বীকার করেন। অতঃপর রিভিউয়ারের প্রতিবেদন প্রাপ্তি, নিবন্ধের সংশোধিত কপিতে স্বাক্ষর এবং সম্পাদনা পরিষদ কর্তৃক অ্যাকসেপ্টেন্স লেটার ইস্যু কোনো ক্ষেত্রেই সামিয়ার কোনো অবগতি ও সম্পৃক্ততা ছিল না।


প্রকৃতপক্ষে তর্কিত নিবন্ধটির আইডিয়াসহ ইতিপূর্বে প্রকাশিত আরও কিছু নিবন্ধের আইডিয়া আমার কন্যা সামিয়া রহমান মারজানকে দিয়েছিল। মারজানের অনুরোধে Cultural Imperialism এর বিষয়ে Edward Said এবং Michel Foucault এর দুটো নিবন্ধের কিছু নির্বাচিত অংশ ২০১৫ সালে সামিয়া মারজানকে ই-মেইলের মাধ্যমে প্রেরণ করে। তার প্রদত্ত আইডিয়াটি ছিল, Edward Said এর কালচারাল ইম্পিরিয়ালিজমকে তুলে ধরে ভারতীয় সংস্কৃতি কীভাবে বাংলাদেশের সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন করছে এবং ফুকোর প্রিজনকে তুলে ধরে গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের আচরণকে ব্যাখ্যা করা। ২০১৫ সালের ওই ই-মেইলে সামিয়া মূলত Edward Said এবং Michel Foucault-এর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ মারজানকে প্রেরণ করে এবং ভারতীয় সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের বিষয়ে ব্যাখ্যা করে লেখাটি সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব মারজান নিয়েছিল। পরবর্তীতে তৎকালীন সোশ্যাল সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন ড. ফরিদউদ্দীন এবং ক্রিমিনোলজির অধ্যাপক ড. জিয়ার সঙ্গে মারজান বেয়াদবি করায়, তারা আমার কন্যা সামিয়াকে বিষয়টি অবহিত করলে, সামিয়া মারজানকে প্রশ্ন করে। উল্টো মারজান সামিয়ার সঙ্গেও উদ্ধত আচরণ করে। মারজানের সঙ্গে সে সময় আমার কন্যার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত আমার বড় কন্যার স্বামীর মৃত্যুসংবাদে সামিয়াকে তাৎক্ষণিক সেখানে যেতে হয়। ওই সময় ঢাকা বিমানবন্দরে থাকা অবস্থায় সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অফিস থেকে সামিয়াকে ফোন করে জানানো হয়, সামিয়ার এবং মারজানের যৌথ একটি নিবন্ধের কপি তারা হারিয়ে ফেলেছে এবং কপিটি পুনরায় তাদেরকে পাঠানো যাবে কিনা। উক্ত সংবাদে সামিয়া আশ্চর্য হয় এই কারণে যে, সাম্প্রতিককালে প্রকাশনার জন্য সে কোনো লেখা ডিন অফিসে জমা দেয়নি। তার ওপর ডিন অফিস থেকে একই সঙ্গে কোনো লেখার হার্ড কপি এবং সফট কপি কীভাবে হারায়? সামিয়া তাৎক্ষণিকভাবে মারজানকে ফোন দিলে সে সামিয়াকে জানায়, ২০১৫ সালে তাকে দেওয়া সামিয়ার তথ্য সমূহের ওপর নির্ভর করে সে একটি লেখা সম্পূর্ণ করেছে এবং তা “Social Science Review” Journal-এ প্রকাশের জন্য জমা দিয়েছে। লেখাটির চূড়ান্ত ভার্সন সামিয়াকে না দেখানোর কারণে সামিয়া তাকে ভর্ৎসনা করলে মারজান প্রতিউত্ত্যুরে উদ্ধতভাবেই জানায়, রিভিউয়ার লেখাটি গ্রহণ করেছেন। যেহেতু লেখাটিতে সাঈদ ও ফুকোর লেখার উদ্ধৃতি ছিল, সামিয়া মারজানকে সেই উদ্ধৃতি সঠিকভাবে দিয়েছে কিনা, বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিতে গবেষণা করেছে কিনা বারবার জিজ্ঞাসা করে। মারজান সামিয়াকে বারবার আশ্বস্ত করেছিল যে, সে প্রবন্ধটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করেছে এবং রিভিউয়ার কিংবা সম্পাদনা পরিষদ রেফারেন্সের বিষয়ে কোনো আপত্তি করেননি। বরং অ্যাকসেপ্ট করেছেন।


সামিয়া মারজানকে ডিন অফিসে যোগাযোগ করতে বলে এবং সামিয়া ফিরে না আসা পর্যন্ত লেখাটির বিষয়ে কোনো রকম সিদ্ধান্ত নিতে মানা করে। কিন্তু বিদেশে থাকাকালীন সময়েই লেখাটি ছাপা হয়ে যায়। অফলাইন জার্নাল বলে সেটা জানার সুযোগ সামিয়ার ছিল না।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারির ২ তারিখে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের তৎকালীন ডিন জনাব অধ্যাপক ড. ফরিদউদ্দীন আহমদ-ফোন করে সামিয়াকে জানান, সামিয়া এবং মারজানের যৌথ নামে যে নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে সে ব্যাপারে সামিয়া অবগত আছে কিনা? পূর্বে উল্লিখিত বিষয়টি সামিয়া সংক্ষিপ্তভাবে উনাকে জানালে, ড. ফরিদউদ্দীন জানান নিবন্ধটিতে রেফারেন্সের ঘাটতি আছে এবং এ বিষয়ে সামিয়ার বিভাগের দুজন শিক্ষক তাঁর কাছে অভিযোগ করে সামিয়ার শাস্তি দাবি করেছেন। তখনো জার্নালটির কোনো কপি সামিয়া হাতে না পাওয়ায় মারজানকে ফোন দিলে সে বলে সবকিছু ঠিক আছে। সামিয়াকে না দেখিয়ে লেখাটি জমা দেওয়ার জন্য সামিয়ার সঙ্গে মারজানের বাদানুবাদ হয়। সামিয়া অনতিবিলম্বে ডিন অফিসে এসে অধ্যাপক ড. ফরিদউদ্দীন-এর কাছ থেকে জার্নালটি নিয়ে লেখাটি দেখে এবং সঙ্গে সঙ্গেই উক্ত লেখাটি অত্যন্ত দুর্বল এবং তাতে পর্যাপ্ত ফুট নোটের অভাব দেখতে পায়। যেহেতু নিবন্ধটির লেখক হিসেবে সামিয়ার নামও প্রকাশিত হয়েছে, তাই তাৎক্ষণিকভাবে জার্নাল থেকে নিবন্ধটি প্রত্যাহারের জন্য ০৫/০২/২০১৭ তারিখে সামিয়া আবেদন করে। তৎকালীন ডিন অধ্যাপক ফরিদউদ্দীন নিজ স্বাক্ষর যুক্তে সামিয়ার ওই আবেদন গ্রহণ করেন এবং ওই আবেদনপত্রের কপি তদন্ত কমিটির কাছে সামিয়ার লিখিত বক্তব্যের সঙ্গে দাখিল করে। যেক্ষেত্রে সামিয়া নিজেই সব পারিপার্শ্বিক বিষয় বর্ণনা করে Social Science Review-তে প্রকাশিত নিবন্ধটি দুর্বল ও নিজস্ব পর্যালোচনাবিহীন এবং প্রতি পাতায় ফুট নোটের অভাব লক্ষ্য করে ৫ ফেব্রুয়ারি সেটা প্রত্যাহারের আবেদন করেছিল, সেক্ষেত্রে সাত মাস পর ওই নিবন্ধটির বিষয়ে জনৈক Alex Martin নামীয় একজন ব্যক্তির একটি কথিত ই-মেইলের সূত্র ধরে সামিয়াকে Plagiarism এর অভিযোগে অভিযুক্ত করা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলক। যদিও বর্তমান তদন্ত কমিটি এই বিষয়টিকে আমলেই নেয়নি যে সামিয়া ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতেই লেখাটি প্রত্যাহারের আবেদন করেছিল। উপরন্ত তৎকালীন ভিসি ড. আরেফিন সিদ্দিককে তাৎক্ষণিকভাবে লেখাটি দেখালে তিনি নিজেও বলেন, এটি প্লেজারিজম নয়, এটি সাইটেশন এরর। এবং সবচেয়ে বড় কথা এখানে সামিয়ার কোনো স্বাক্ষরই নেই, তাই এখনই যেন ডিন ড. ফরিদউদ্দীন এ বিষয়টি সিন্ডিকেটে তোলেন। সামিয়া বিষয়টি ডিন মহোদয়কে জানালে তিনি বিষয়টি চেপে যান। সামিয়ার বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি ড. আরেফিন সিদ্দিকের সিন্ডিকেটে বিষয়টি তুলতে রাজি হন না। এর ঠিক সাত মাস পর ড. ফরিদউদ্দীন সামিয়াকে ফোন দিয়ে বলেন, এবার তিনি নতুন ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের সিন্ডিকেটে বিষয়টি তুলবেন। এই প্রশাসন সামিয়াকে ড. আরেফিনের অনুসারী মনে করে এবং এরা সামিয়ার বিরুদ্ধে। এবার তিনি মারজানকে শাস্তি দেবেন। কারণ মারজান তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। ড. আরেফিন সিদ্দিক নাকি ড. ফরিদউদ্দীনকে ১০ মিনিটের মাথায় ডিন পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন, এটি হবে তাদের প্রাপ্য শাস্তি। আমার কন্যা শুধু বারবার প্রশ্ন করেছিল এখানে সে কীভাবে জড়িত হচ্ছে। ড. ফরিদউদ্দীনের বক্তব্য ছিল, সামিয়া রহমান ড. আরেফিন সিদ্দিকের অনুসারী এবং সামিয়ার বিভাগের দুজন শিক্ষক সামিয়ার বিরুদ্ধে শিকাগো ইউনিভার্সিটির কাছে অনুরোধ করে লিখেছে, যেন সামিয়ার শাস্তির জন্য শিকাগো ইউনিভার্সিটি চিঠি লেখে। এটি নাকি হবে ড. ফরিদউদ্দীনের জন্য ন্যাচারাল জাস্টিস। সামিয়া তাকে প্রশ্ন করেছিল তবে তিনি কেন সাত মাস আগে ড. আরেফিন সিদ্দিক ভিসি থাকার সময় বিষয়টি তুললেন না? কেন কালক্ষেপণ করলেন? ড. ফরিদউদ্দীনের বক্তব্য ছিল, ড. আরেফিনের প্রশাসন এটিকে প্লেজারিজম মনে করে না। ড. আরেফিন সিদ্দিক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একজন সিনিয়র নারী শিক্ষকের প্লেজারিজমের বিষয়টি সিন্ডিকেটে মাফ করে দিয়েছিলেন। ওই নারী শিক্ষক তার বিভাগের একজন শিক্ষকের লেখা হুবুহু কপি করেছিলেন। আর বর্তমান প্রশাসন সামিয়ার বিরুদ্ধে, তাই তাদের কাছেই তিনি সামিয়ার শাস্তি কার্যকর করতে পারবেন। তিনি শুধু বোঝাতে চেয়েছিলেন, তার টার্গেট সামিয়া নয়, বরং মারজান। তিনি এও জানালেন, তার কাছে সমুদয় কপি আছে ডিন অফিসের, যেখানে জমা দেওয়া থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত কার্যকলাপের সঙ্গে মারজান যুক্ত। যদিও অদ্ভুত বিষয় হলো তদন্ত কমিটি তাদের রায়ে জানিয়েছে ডিন অফিসে কাগজ পত্র লেনদেন কে করেছে, সেটি অস্পষ্ট। দালিলিক প্রমাণ নাকি পাওয়া যায়নি। অথচ মারজান নিজে তদন্ত কমিটির কাছে স্বীকার করেছে সে সব কাগজপত্র জমা দিয়েছে। রিভিউয়ারের কপিও সে নিয়েছে। সে জমা দিয়েছে। তারপরও ডিন অফিস এবং তদন্ত কমিটি কেন দালিলিক প্রমাণ অস্পষ্ট জানাল সেটি বরং আমাদের কাছে সন্দেহজনকভাবে অস্পষ্ট হয়ে আছে।

ট্রাইব্যুনালের প্রেরিত কারণ দর্শানোর নোটিসে প্রথমবারের মতো সামিয়া জানতে পারে যে, ‘এই প্রবন্ধটির রিভিউয়ার স্পষ্টতই এতে মৌলিক অসংগতি রয়েছে বলে নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন। ’ রিভিউয়ারের এরকম নেতিবাচক মন্তব্যের পরও তর্কিত নিবন্ধটি সামিয়ার কোনো সংশোধন, স্বাক্ষর কিংবা সম্মতি ছাড়া জার্নালে কীভাবে প্রকাশিত হলো সে বিষয়ে বরং তদন্ত করার জন্য সামিয়া অনুরোধ করেছিল। কিন্তু সে বিষয়ে তদন্ত কমিটি বরাবরের মতো নিশ্চুপ। আর সিন্ডিকেট এ বিষয়গুলোকে আমলেই নেয়নি। কেন সামিয়াকে শুরু থেকে একবারও অবহিত করার প্রয়োজন মনে করলেন না এডিটোরিয়াল বোর্ড, সেটি রবং আমাদের কাছে বড় একটি প্রশ্ন হিসেবে রয়ে গেছে। বরং আমি পিতা হিসেবে মনে করি সামিয়ার বিরুদ্ধে চলমান ষড়যন্ত্রের এটি ছিল প্রথম একটি ধাপ। ডিন অফিস থেকে একই সঙ্গে সফট কপি এবং হার্ড কপি হারিয়ে যায় কেমন করে? কেমন করে মূল লেখকের স্বাক্ষর ছাড়া লেখা প্রকাশ হয়? কেমন করে রিভিউয়ারের কপি মূল লেখকের কাছে পৌঁছানোর কোনো তাগিদ এডিটোরিয়াল বোর্ড মনে করেন না? কেমন করে রিভিউয়ারের নেতিবাচক মন্তব্যের পরও কোনো রকম সংশোধন ছাড়া লেখা প্রকাশিত হয়? কেমন করে এডিটোরিয়াল বোর্ড দুই বছরেও কোনো রকম বার্ষিক সভা ছাড়া লেখা অনুমোদন করেন? তবে কি সোশ্যাল সায়েন্স রিভিউতে যে কেউ গরুর রচনা লিখে পাঠিয়ে দিলে সেটাও অ্যাকসেপ্ট হয়ে যাবে? কেননা এডিটোরিয়াল বোর্ড তো কে লেখক, তার স্বাক্ষর কোথায়, রিভিউয়ার কী মন্তব্য করছেন, রিভিউয়ারের মন্তব্য লেখকদের কাছে পাঠানোর প্রয়োজন আছে কি না? লেখাটি ছাপার যোগ্য কি না- তার তোয়াক্কা করেননি।

আমার মেয়ে সামিয়া রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। ছাত্রজীবন থেকে তার সাফল্য এবং পরবর্তীকালে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির কারণে তার বিভাগের শিক্ষকদের একটি অংশ তার প্রতি ভয়ঙ্কর ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সামিয়ার বিরুদ্ধে আনীত ভিত্তিহীন অভিযোগের ভিত্তিতে যে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল তাদের কর্মকান্ড পক্ষপাতদুষ্ট এবং তদন্ত কমিটি সঠিক ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেননি। উক্ত পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটিকে তদন্ত সমাপ্তির জন্য এক মাস সময় দেওয়া হলেও তদন্ত কমিটি তিন বছরের বেশি সময় ধরে তদন্ত কার্য দীর্ঘায়িত করেছেন এবং এ সময়ে তদন্ত কমিটির কোনো কোনো সদস্য বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সামিয়ার বিরুদ্ধে প্রায়শই বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা, ভুয়া, উসকানিমূলক ও মানহানিকর তথ্য সরবরাহ করেছেন। তদন্ত কমিটির কার্যক্রম গোপনীয় হওয়া সত্ত্বেও প্রতি মিটিংয়ের তথ্য, মিটিং সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়ায় সরবরাহ করা হয়েছে।

ক্ষমতা মানুষকে সর্বোচ্চ শক্তিমান ভাবতে ধারণা দেয়। কিন্তু ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। আদালত আছে, আইন আছে। তারা নিশ্চয়ই দালিলিক প্রমাণ দেখবেন। শিক্ষক রাজনীতির প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার চেষ্টায় কারও বিরুদ্ধে শত্রুতায় ব্যস্ত থাকবেন না, এটুকুই শুধু আমার প্রত্যাশা।

যারা প্রতিহিংসার রাজনীতিতে সামিয়ার ক্ষতিতে আনন্দ করছেন, তাদের জন্য আমার করুণা। কারণ মানুষ হিসেবে তারা অতি নিকৃষ্ট, ক্ষুদ্র। তাদের প্রতি করুণা ছাড়া আর কোনো অনুভূতি আমার অন্তরে নেই। প্রমাণ নিশ্চয়ই একদিন হবেই হবে। যারা সামিয়ার ওপর বিশ্বাস রাখেননি, তাদের প্রতি আমার কোনো বক্তব্য নেই, আল্লাহ খোদা বলে যদি কেউ থাকেন, তবে তিনিই প্রমাণ দেবেন। আর যারা বিশ্বাস করে পাশে আছেন, ভরসা রাখুন, আইন নিশ্চয়ই প্রমাণ দেখবে, নষ্ট শিক্ষক রাজনীতির প্রতিহিংসা দেখবে না।

লেখক : সাবেক ঊর্ধ্বতন পরিচালক, বাংলাদেশ বেতার, সামিয়া রহমানের পিতা।

লেখাটির জাতীয় দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে

//