
দেশের প্রায় সব জাদুঘর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে হলেও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রত্নসম্পদ সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা ‘বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর’ পরিচালনা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)। ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত দুর্লভ ঐতিহ্যের ধারক জাদুঘরটি বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর। দীর্ঘদিন অব্যবস্থাপনার শিকার হলেও সম্প্রতি বিদেশি গবেষকদের আগ্রহ, রাষ্ট্রদূতদের পরিদর্শন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে চুক্তি ছাড়াও আধুনিক গ্যালারি, থ্রিডি প্রযুক্তি, কয়েন গ্যালারি ও ডরমিটরি নির্মাণের নানা উদ্যোগে জাদুঘরটি যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। এ নিয়ে গবেষণা করতে ব্যাপক আগ্রহী বিদেশিরা।
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের সরবরাহ করা ডকুমেন্টারি স্ক্রিপ্টে দাবি করা হচ্ছে, এ জাদুঘরের সংগ্রহে এমন কিছু নিদর্শন আছে, যা বাংলাদেশের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে নেই। এমনকি কিছু নিদর্শন সমগ্র বিশ্বে অতি দুর্লভ। এর মধ্যে পাল-সেন শাসনামলে নির্মিত দুই সহস্রাধিক বরেন্দ্র স্বতন্ত্র শিল্প ঘরানায় নির্মিত ভাস্কর্য বিশেষভাবে গুরুত্ববহ।
এছাড়া রয়েছে পাল-পরবর্তী যুগের সচিত্র অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা পুঁথি, লাইফ-সাইজ গঙ্গা মূর্তি, অর্ধনারীশ্বর শিব এবং বিভিন্ন ধ্রুপদি শিল্পকলার ভাস্কর্য। সংগ্রহে আছে প্রায় ছয় হাজার বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, খ্রিস্টাব্দ থেকে ব্রিটিশ শাসনামল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মুদ্রা, ১ হাজার ৩০০ পোড়ামাটির নিদর্শন, এক হাজারের অধিক ধাতব নিদর্শন এবং কয়েকশ অন্যান্য উপাদানে নির্মিত প্রত্নসামগ্রী। সংখ্যার বিচারে এটা দেশের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম সংগ্রহ।
জাদুঘর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, এ জাদুঘরে প্রস্তর ও ধাতব প্রত্নভাস্কর্য, টেরাকোটা, মুদ্রা, পাণ্ডুলিপি, ধাতবসামগ্রী ও শিলালিপি মিলিয়ে প্রায় ১৭ হাজার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে। তবে এর মধ্যে মাত্র ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ নিদর্শন প্রদর্শিত হয়। স্থান সংকুলান না হওয়ায় জাদুঘরের ৯০ শতাংশ প্রত্নসম্পদ রাখা হয়েছে তালাবন্দি পাঁচটি গুদামঘরে। ফলে প্রাচীন এ নিদর্শনগুলো দেখার সুযোগ থেকে অনেকাংশেই বঞ্চিত হচ্ছেন দর্শনার্থীরা। এছাড়া গবেষণা জাদুঘরে নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে কয়েক হাজার মূল্যবান পুঁথির পাণ্ডুলিপি। এসব পুঁথির ডিজিটাল কপিও নেই।
এদিকে প্রাচীন পুঁথির পাণ্ডুলিপিগুলো রাখা হয়েছে একটি ভাণ্ডারকক্ষে। যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে এগুলো নষ্টের পথে। কিছু কিছু পাণ্ডুলিপি এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। এর মধ্যে সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি আছে ৩ হাজার ৯০০টি। আর বাংলা আছে ১ হাজার ৭০০টি। ১২৭৩ খ্রিস্টাব্দ এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীর কোনো এক সময়ের তালপাতায় লিখিত ও রঙিন চিত্রকর্ম দ্বারা শোভিত দুটি পাণ্ডুলিপিও আছে জাদুঘরে। এগুলোর মধ্যে মাত্র ১২টি প্রদর্শিত হচ্ছে।
আবার বদ্ধ ঘরে রাখার ফলে নিদর্শনের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণ করা নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়। মূল্যবান এ জাদুঘর রক্ষায় রয়েছে নিরাপত্তারও ঘাটতি। এসব প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণ করার দাবি জানিয়েছেন ইতিহাসবিদরা। তাদের দাবি, এগুলোর অন্তত একটি করে ডিজিটাল কপি সংরক্ষণ করা দরকার।
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের নবনিযুক্ত পরিচালক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আগের চেয়ে বর্তমানে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে চার মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ দিয়েছে ব্রিটিশ কাউন্সিল। এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ইংল্যান্ডের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়েছে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়টির ইউনেসকো চেয়ার অন আর্কিওলজিক্যাল এথিকস অ্যান্ড প্র্যাকটিস ইন কালচারাল হেরিটেজ এ কর্মসূচির আয়োজন করে।’
তিনি আরো বলেন, এখন প্রতিটি দিবস পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জাদুঘর পরিদর্শনে যোগাযোগ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে—বিদেশি গবেষক, রাষ্ট্রদূত ও ভিআইপিদের আগমন বাড়ছে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও জাদুঘরের জনপ্রিয়তা বেড়েছে।
এছাড়া জাদুঘরে প্রতিনিয়ত নতুন নিদর্শন যুক্ত হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতি মাসেই আমরা নতুন নতুন নিদর্শন পাচ্ছি। গতকালও নাচোল রাজবাড়ি থেকে দুটি নিদর্শন নিয়ে এসেছি। এটা আমাদের জাদুঘরের সবচেয়ে বেশি ওজনের।’
স্থানাভাবে বাক্সবন্দি কিছু পুঁথি ও অন্যান্য প্রাচীন সাহিত্য নিদর্শন কী পরিস্থিতিতে আছে জানতে চাইলে ড. মোস্তাফিজুর বলেন, ‘আমাদের জাদুঘরে সিন্ধু সভ্যতার অনেক নিদর্শন রয়েছে যেগুলো কলকাতায়ও নেই। আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে এর আরো উন্নতি করা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা। আমরা চাচ্ছি জাদুঘরটিকে আলোকসজ্জা করে আরো আকর্ষণীয় করতে। পাশের দুটি পুরনো ভবন ভেঙে নতুন করে গড়া গেলেও অনেক নিদর্শনের প্রদর্শনী বাড়ানো যাবে। তবে এতে সময় লাগবে।’
অনেকটা আক্ষেপের সুরে পরিচালক কাজী মোস্তাফিজুর বলেন, ‘এখানে জনবল সংকট তো আছেই। যদিও গবেষকদের সংখ্যা খুবই কম, তবে তাদের থাকার ব্যবস্থা নেই। এজন্য জাদুঘরের পাশেই পুরনো বিল্ডিং ভেঙে তিনতলা ডরমিটরি করার পরিকল্পনা করছি। এছাড়া প্রদর্শনীর জন্য নতুন গ্যালারি লাগবে, থাকার জন্য নতুন বিল্ডিং লাগবে। তবে অনেকগুলো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, বিশেষ করে পুরো জাদুঘরটিকে আলোকসজ্জায় সুসজ্জিত করা হচ্ছে, এখানে থ্রিডি করার কাজ চলছে। আমরা বিশেষভাবে একটা উদ্যোগ নিয়েছি—সম্পূর্ণ একটি রুম ফাঁকা করে কয়েন গ্যালারি করতে চাচ্ছি। শিগগিরই এটি করা হবে। এছাড়া নিরাপত্তার জন্য সশস্ত্র নিরাপত্তাকর্মীও প্রয়োজন।’
সবশেষে পরিচালক জানান, রবিবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত জাদুঘরটি খোলা থাকে। দর্শনার্থীদের জন্য প্রবেশমূল্য ২০ টাকা, রাবি শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ টাকা। তবে গবেষণা ও লাইব্রেরি ব্যবহারের জন্য রাবি শিক্ষার্থীরা পরিচয়পত্র দেখিয়ে বিনামূল্যে প্রবেশ করতে পারেন।
সার্বিক বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, ‘বর্তমানে জাদুঘরটিতে ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে কর্মচাঞ্চল্য ও কার্যক্রমের পরিসর অনেক বেড়েছে। নতুন উদ্যমে প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহের কাজ চলমান রয়েছে। বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে সংগ্রহের উপযোগী সামগ্রী খুঁজে বের করা হচ্ছে।’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে উপাচার্য বলেন, ‘জাদুঘরটির আধুনিকায়নের জন্য একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। মূল যাদুঘরের প্রত্ননিদর্শনগুলো সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য আলাদা সম্প্রসারিত অংশ তৈরি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি গবেষকদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থাও রাখা হচ্ছে, তবে সেটি সময়সাপেক্ষ। বর্তমানে রাজশাহীতে বিদেশি রাষ্ট্রদূতসহ অনেক গবেষক আসছেন এবং তারা বরেন্দ্র জাদুঘরের গবেষণার প্রতি গভীর আগ্রহ প্রকাশ করছেন। বলা যায়, জাদুঘরটি যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।’