যৌন নিপীড়নের হাতিয়ার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ক্রাশ এন্ড কনফেশন' পেইজগুলো


রাবি | Published: 2019-04-05 10:59:11 BdST | Updated: 2024-04-19 21:29:35 BdST

বুধবার (০৩ এপ্রিল) মধ্যরাত। হঠাৎ ‘Ru Crush & Hate Confession’ পেজ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) এক ছাত্রীর ছবিসহ পোস্ট আপডেট করা হয়। যেখানে ওই ছাত্রী সম্পর্কে অশ্লীল, অশ্রাব্য, কুরুচিপূর্ণ এবং যৌন হয়রানিমূলক তথ্য প্রকাশ করা হয়।মূহুর্তেই পোস্টটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত সাড়ে পাঁচ হজার শিক্ষার্থী ভিউ করেন। কমেন্টের স্থলেও শুরু হয় ‘বিদ্বেষমূলক’ মন্তব্য।

কেউ কেউ স্ক্রিন শর্ট নিয়ে তাতে আরও ‘বিদ্বেষমূলক’ মন্তব্য জুড়ে দিয়ে শেয়ার করতে থাকেন ফেসবুকে। রাতভর সামাজিক মাধ্যমে ওই ছাত্রীকে নিয়ে চলে নেতিবাচক আলোচনা, সমালোচনা ও ‘হয়রানিমূলক মন্তব্য’। বৃহস্পতিবার (০৪ এপ্রিল) সকালে বিভিন্ন জনের আপত্তির মুখে দুপুরে পোস্টটি সরিয়ে ফেলেন পেজের অ্যাডমিন।

ততক্ষণে সামাজিক মাধ্যমে ওই ছাত্রীর বন্ধু-বান্ধব, বিভাগের সিনিয়র-জুনিয়র, শিক্ষক, হলমেটসহ সবাই দেখেছেন পোস্টটি। কেউ কেউ বলছেন, ‘একেবারে এসব কাজ না করলে কেউ এমনিতেই লিখে নাকি?’, কেউ বলছেন, ‘এভাবে মিথ্যাচার করে মানুষের হয়রানি করা একজন মানুষ হিসেবে অনুচিত।’ তবে সব সমালোচনা শুনতে হচ্ছে ওই ছাত্রীকেই! কারণ পোস্টদাতার নেই কোনো নাম-পরিচয়!

ভয়ংকর বিষয় হলো- চাইলেও এসব ঘটনা সত্যি কিনা, তা জানার উপায় নেই ছাত্রীর বন্ধু বা শুভাকাঙ্খী বলে পরিচিত কোনো ব্যক্তির। খোদ ভুক্তভোগী ছাত্রী যখন ওই পেজের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে জানতে চেয়ে টেক্সট করেছেন, তখন প্রতিউত্তর এসেছে, ‘এতে আমাদের কোনো দায় নেই! যে, যা দেই; আমরা তা পাব্লিশ করি।’

বুধবার মধ্যরাতে এই পেইজেই যৌন নিপীড়নমূলক পোস্ট শেয়ার করা হয়। পরে চাপের মুখে ডিলিট করে এই পোস্ট করা হয়

ওই ছাত্রীর কাছে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছুদিন ধরে একটি ছেলে আমার সঙ্গে সম্পর্ক করার জন্য চেষ্টা করছিল। সম্পর্কে আমার বন্ধু হয়। তবে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকলেও রিলেশনে জড়ানোর মতো ইচ্ছে ছিল না। তবে বিভিন্নভাবে সে আমাকে ডিস্টার্ব করতো। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে আমি তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি। তখন সে আমাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। এর কয়দিন পরই এমন পোস্ট করে আমার সম্মান নষ্টের চেষ্টা করছে।

ভুক্তভোগী ছাত্রী আরও বলেন, রাতে পোস্টটি দেখার পরপরই আমি পেজের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে তাকে পোস্টটির সরানোর জন্য রিকোয়েস্ট করি। তবে তারা এটা নিয়ে হাস্যরসাত্মক রিপ্লাই দিতে থাকে। পরে আমি আইনের আশ্রয় নেওয়ার কথা বললে, তারা উত্তর দেয়- ‘যা করতে চান করেন। আপনার সঙ্গে এতো কথা বলার সময় আমাদের নেই।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে ওই ছাত্রী বলেন, আমি মানসিকভাবে ভয়ংকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমার বাবা-মা বা এলাকার কোনো মানুষ যদি পোস্টটি দেখে থাকে, তবে তাদেরকে বিশ্বাস করানো কঠিন হবে; যে এমন কোনো কাজে আমি যুক্ত নই।

একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রীকে চরমভাবে হয়রানি করার জন্য দেওয়া পোস্ট নিজেদের পেইজে প্রকাশ করেও ‘তাদের কোনো দায় নেই’ বলে হেসে উড়িয়ে দিচ্ছেন পেজ চালানো অ্যাডমিন প্যানেলের সদস্যরা। তাহলে দায়টা কার? মতিহার থানার ওসি জানালেন, তাদের কাছে ভুক্তভোগী বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অভিযোগ না করলে তারা জানবেন কীভাবে?

যৌন নিপীড়নমূলক সেই পোস্টটি

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী বলছে? রাবি ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাাপক লায়লা আরজুমান বানু বলছেন, ‘এমন পেজ সম্পর্কে আমার জানা-শোনায় নেই। কেউ কোনো অভিযোগও করেনি। তবে যেহেতু জানলাম, খতিয়ে দেখা হবে।’ প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমানকে পোস্টটির স্ক্রিন শর্ট দেখানোর পর তিনি পেজের অ্যাডমিনদের কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। প্রক্টর জোর দিয়ে বলেন, ‘এ ব্যাপারে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

অথচ এটাই ‘আরইউ ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশন’ নামের কথিত বিনোদনমূলক পেজ থেকে দেওয়া প্রথম যৌন হয়রানি ও বিদ্বেষমূলক পোস্ট নয়। এরআগেও এসব ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে প্রক্টর, ছাত্রউপদেষ্টার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠন। এরমধ্যে অন্যতম রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ল ফাইন্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন (রুয়ালফ)।

সংগঠনটির নেতাকর্মীরা ২০১৮ সালে মাঝামাঝি সময়ে প্রক্টরকে লিখিত অভিযোগ দিয়ে পেজগুলো বন্ধ করা এবং যারা পেজগুলো চালান; তাদের চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছিলো। দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাসও দিয়েছিল প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরাও। তবে তাদের সেই আশ্বাস, আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে।

রুয়ালফ’র তৎকালীন নেতা কেএএম সাকিব বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে এভাবে মনগড়া কথা লিখে প্রকাশ করা হয়। তা ভাইরাল হয়। অথচ সেটা সত্য নাকি মিথ্যা তা খতিয়ে দেখারও প্রয়োজন নেই। কেউ ফেক আইডি ব্যবহার করে আজে-বাজে কথা লিখে পেজে ম্যাসেজ করলেই তা ছবিসহ প্রকাশ করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।’

‘ভয়ংকর বিষয় হলো- যাকে নিয়ে এমনটি করা হয়, তার ছবিসহ মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে অথচ যে প্রকাশ করছে; তার নাম-পরিচয় দিতে পেজের অ্যাডমিনদের চরম অনীহা। যা ক্রাইম বলেই আমি মনে করি’ বলেন তিনি।

সাকিব আরও বলেন, ‘সেসময় আমরা লিখিত দিয়েছিলাম, তবে প্রশাসন এ ব্যাপারে আর কোনো পদক্ষেপ নিয়েছি বলে আমার জানা নেই। আমার মনে হয়- এখনি সময়, বিষয়টি স্টপ করানোর। নতুবা এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইংরেজি অদ্য অক্ষরে ‘আরইউ ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশন’, ‘ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশনস আরইউ’, ‘আরইউ ক্রাশ এ্যান্ড হেটস কনফেশনস’সহ অন্তত ৮/১০টি পেজের সন্ধান পাওয়া গেছে। যেগুলোর মধ্যে দু’টি পেজে ২০ হাজারেরও বেশি ফলোয়ার। যাদের অধিকাংশ রাবির সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের অনেক ব্যক্তিও সামাজিক মাধ্যমে এই পেজে যুক্ত। সবমিলিয়ে এসব পেজে অর্ধ লাখের বেশি সক্রিয় ফলোয়ার রয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পেজগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকেনো ছাত্র-ছাত্রীর ছবিসহ তার সম্পর্কে তথ্য বা তাকে ভালো লাগার কারণ বা প্রেম করতে চাওয়ার অভিপ্রায় প্রকাশ করা হয়। যে কেউ ফেক আইডি ব্যবহার করে ছবিসহ তথ্য সরবরাহ করলেই মূহুর্তেই তা প্রকাশ করা হয়। যা পৌঁছে যায় ফলোয়ারদের নিউজফিডে।

তবে কে এই তথ্য দিলো তার কোনো পরিচয় সেখানে উল্লেখ করা হয় না। এমনকি পোস্ট দেওয়ার পর ভুক্তভোগী (যার নামে পোস্ট করা হয়) যদি পেজের অ্যাডমিনদের কাছে ম্যাসেজ করে তথ্য চান, তবুও তাকে কোনো তথ্যই দেওয়া হয় না। অনেক ছাত্রী এ ব্যাপারে আপত্তি তুললেও বেশিরভাগই লোক-লজ্জার ভয়ে এড়িয়ে যান। ফলে ক্রমেই বাড়ছে এ অপরাধ প্রবণতা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭ সালের জুলাইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের একজন বিবাহিত ছাত্রীর সম্পর্কে পেজে পোস্ট দেওয়া হয়। চাকরি সূত্রে খুলনায় অবস্থান করা তার স্বামীর কাছে পৌছে যায় ওই পোস্টটি। সেখান থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শুরু হয় পারিবারিক কলহ।

যা তিন মাস পর বিবাহবিচ্ছেদে রূপ নেয়। ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেও ঘটেছে এমন ঘটনা। অসংখ্য শিক্ষার্থীর অভিযোগ রয়েছে, এখানে সামাজিক মর্যাদা খাটো করা হয়। তবে এই পেজগুলো বন্ধ করা বা এদের কার্যক্রম নজরদারি করার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

ফেসবুকে সার্চ করলেই রাবির ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশন  পেজের ছড়াছড়ি

বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ সেলের সাবেক আহ্বায়ক মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবা কানিজ কেয়াকে বিষয়টি অবগত করা হলে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, ‘আমি যখন সেলের দায়িত্বে ছিলাম, তখন নিয়ম ছিল- কোনো যৌন হয়রানিমূলক ঘটনা ঘটেছে, সেটার ব্যাপারে ভুক্তভোগী অভিযোগ করেনি; তবুও সেলকে বিষয়টি খোঁজ-খবর নিতে হবে। তাকে আশ্বস্ত করে অভিযোগ করতে বলা হবে। অভিযোগ না করলেও ঘটনার সত্যতা থাকলে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

মনোবিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘একজন ছাত্রীর সম্পর্কে যখন নেতিবাচক তথ্য প্রকাশ হয়, সে যত স্ট্রং মানসিকতারই হোক না কেন; স্থির থাকতে পারবে না। আমাদের সমাজে তো আরও নয়ই! এখানে মেয়েদের সম্পর্কে মিথ্যা বানিয়ে বললেও তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং সবচেয়ে কাছের মানুষ বা অভিভাবকরাও তা বিনাবাক্যে সত্য মনে করে। ফলে ভুক্তভোগীর পক্ষে এ ধরনের ধাক্কা কাটিয়ে উঠে পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়াটা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।’

এ ধরনের অরপাধ বিষয়ে জানতে চাইলে রাবির আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসিবুল আলম প্রধান বলেন, কেউ ইন্টারনেট ব্যবহার করে সামাজিক মাধ্যম বা কোনো ওয়েবসাইটে মানহানিকর বা বিভ্রান্তিমূলক কিছু পোস্ট করলে, ছবি বা ভিডিও আপলোড করলে, কারও নামে অ্যাকাউন্ট খুলে বিভ্রান্তমূলক পোস্ট দিলে, কোনো স্ট্যাটাস দিলে কিংবা শেয়ার বা লাইক দিলেও সাইবার অপরাধ হতে পারে।

তিনি বলেন, এটা ২০১৮ সালে অনুমোদন হওয়া ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে গুরুতর অপরাধ। আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, অভিযোগ প্রমাণ হলে আসামির ৩ বছর জেল ও ৫ লাখ টাকা জরিমানা এবং পরবর্তীতে একই অপরাধ সংঘটিত করলে ৫ বছর জেল এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানার দন্ড হবে।

জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র সিনিয়র সহকারি পুলিশ কমিশনার ইফতেখায়ের আলম বলেন, সাইবার অপরাধ বিষয়ে একটি টিম কাজ করছে। যদি তাদের দৃষ্টিগোচরের বাইরে কোনো ঘটনা সংঘটিত হয়, সেটা যে কেউ অবগত করলেই ওই টিম খতিয়ে দেখেন। এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. লুৎফর রহমান বলেন, ‘শুনেছি ফেসবুক পেজে ছাত্রীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা হয়েছে। যারা এমন কাজ করেছে এবং যারা তা প্রকাশ করেছে, কোনোভাবেই তাদেরকে ছাড় দেওয়া হবে না। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও সম্মানের স্বার্থে এবং নিরাপদ তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’