'আবদুস সামাদ আজাদীর ইচ্ছে পূরণ হোক-এইটুকুই চাই আমরা'


Dhaka | Published: 2019-11-19 03:27:33 BdST | Updated: 2024-05-04 12:23:45 BdST

আজ থেকে প্রায় পাঁচ মাস আগের এক শুক্রবার দুপুরে আজিমপুর থেকে হলে ফেরার পথে এই দুইজনের সঙ্গে আমার পরিচয়! সম্পর্কে তারা স্বামী-স্ত্রী। অন্য সব ভিক্ষুকদের মত এই দুইজনও আমার সামনে এসে হাত পাতলো।বৃদ্ধ স্বামীর দুই চোখের কোনোটাতেই দৃষ্টি নেই। আর স্ত্রীর এক চোখ পুরোপুরি নষ্ট , আরেক চোখে দেখতে পায়। আর সেই এক চোখ দিয়েই রাস্তা পার হয় , একহাত দিয়ে অন্ধ স্বামীর হাত ধরা, আরেক হাতে ভিক্ষার থলেটা!

বৃদ্ধের কথাবার্তা শুনে বেশ শিক্ষিত মনে হলো। একশো বিশ টাকা দেয়ার কৃতজ্ঞাতায় কথা বলতে গিয়ে দু'জনেরই দু'চোখ বেয়ে পানি ঝরতে লাগলো। হাতে ফোন আছে কিন্তু নাম্বার জানে না। আমিই আমার ফোন নংটা দিয়ে বলেছিলাম যাতে দুইদিন পর আমাকে কল দেয়।
মাঝেমধ্যেই দেখা করেছি আজিমপুর মসজিদের সামনে।
কথা বলতে বলতে জানতে পারলাম বৃদ্ধ চাচা বহু আগের বিএ পাশ। বহু বছর বিভিন্ন মাদরাসায় শিক্ষকতা ও ইমামতি করেছেন। আর্থিক অবস্থাও ভালো ছিলো।ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করিয়েছেন। কিন্তু গত তিনবছর আগে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ইমামতি সহ অন্য যেকোনো কাজ করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।
যেহেতু নিজে উপার্জন করতে পারছেন না, ধনসম্পদও জমা নেই সেহেতু ছেলেমেয়েরাও এখন এই মা-বাবাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করে না।
পেট চালানোর দায়ে ভিক্ষাবৃত্তির পথই বেছে নিলেন!
একদিন কথা বলতে বলতে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম তাদের ঘর ভাড়া সহ মাসে সবমিলিয়ে কত টাকা খরচ হয় এবং তারা এরকম ভিক্ষা করে কত টাকা পান!
এও বললাম যেহেতু আমি নিজেও একজন শিক্ষার্থী , নিজের চলার জন্য কিছু রোজগার করি। আমি আপনাদের পুরো মাসের চলার খরচ দিতে পারবো না, তবে প্রতি মাসে তিন হাজার করে টাকা দিবো যাতে আপনাদের ভিক্ষা করার দিনের পরিমাণ কমে যায়!

এরপর অলাভজনক প্রতিষ্ঠান 'বিস্তার ট্রাস্ট' এর মিটিংয়ে আমি এই ব্যক্তিগত ঘটনাটি শেয়ার করি ।
কিন্তু ঘটনা শোনার পর 'বিস্তার ট্রাস্ট ' এর প্রতিষ্ঠাতা শহীদুজ্জামান স্যার নিজেই ভীষণ উদগ্রীব হয়ে খুব চাচ্ছিলেন যাতে এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সঙ্গে একদিন আলোচনায় বসে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যে তাদের মঙ্গলের জন্য সর্বোত্তম কী করা যায়। স্যার এও বললেন , "তুমি ছাত্র । এখন থেকে এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে তুমি আর্থিকভাবে সাহায্য করবে না।এই দায়িত্ব পুরোপুরি বিস্তার ট্রাস্টের । এদের জন্য কিছু করা মানে আমার নিজের মা-বাবার জন্য করা।"

স্যারের কথার ভিত্তিতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সঙ্গে আমরা দেখা করি৷
সিদ্ধান্ত হয় - যেহেতু চাচা চোখে দেখেন না সেহেতু আমাদের প্রথম কাজ হলো তাকে ভালোমানের একজন ডাক্তার দেখিয়ে চোখে আলো ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা এবং এ কাজটি অতিদ্রুতই করতে হবে!

দ্বিতীয়ত - যদি তার চোখ ভালো হয় তাহলে তো ভালো ! আর তা না হলে তাদেরকে ভালো একটা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ব্যবস্থা করা (যেহেতু তারা বৃদ্ধ এবং যেকোনো সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। অসুস্থ হলে তাদের দেখার মত কেউই নেই। অতএব বৃদ্ধাশ্রমই তুলনামূলক উত্তম জায়গা)
এবং বৃদ্ধাশ্রমে দেয়া হলে তাদের সঙ্গে আমরা মাঝেমধ্যে দেখা করতে যাবো।
এবং তারা আর একদিনও ভিক্ষা করতে পারবেন না।আপাতত তাদের দুইজনের চলতে মাসে যেই পনেরো হাজার টাকা প্রয়োজন তা শহিদুজ্জামান স্যারই দিবেন।

এরই প্রেক্ষিতে শহিদুজ্জামান স্যার তাঁর বন্ধু ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক (বর্তমানে ইউনাইটেড হাসপাতালে কর্মরত) ড.ফরিদুল হাসান স্যারের সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেন।
ড. ফরিদুল হাসান স্যার তার প্রাইভেট চেম্বারে রোগী প্রতি দুই হাজার টাকা ভিজিটের এত এত রোগী দেখার মাঝখানে, শত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের জন্য সময় বের করেছেন যা সত্যিই শ্রদ্ধার যোগ্য ।

আজ সন্ধ্যায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে সহ উবার নিয়ে সোজা গুলশান চলে যাই স্যারের চেম্বারে।
যাওয়ার পথে কত গল্প।কীভাবে তার সঙ্গে বর্তমান রাষ্ট্রপতির কথাবার্তা হতো, কীভাবে সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার পরিচয় ইত্যাদি ইত্যাদি বহু বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতার গল্প!

চা খাওয়া শেষে টিএসসি থেকে রিক্সায় তুলে দেয়ার সময় 'চাচা' বলে সালাম দেয়ায় বললেন, "আমাকে চাচা বলে সম্বোধন করো না। আমার জন্মের বারো ঘন্টা পর মা মারা গেছে। তাকে আমি দেখিনি। আমি তোমাকে 'মা' হিসেবে মেনে নিয়েছি। আমার নাম আবদুস সামাদ আজাদী। আমাকে আবদুস সামাদ বলেই ডেকো"

আহা!কী সুন্দর করে কথা বলেন!কিন্তু আফসোস নিজের সন্তানরা এরকম একজন মানুষের কদর করতে জানলো না!

যাই হোক ডাক্তার পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখলেন এক চোখ অনেক আগেই পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে, ওইটা আর ভালো হবে না! কিন্তু ডান চোখে আলো ফিরিয়ে আনার জন্য অপারেশন করতে হবে।

এবং আজ সকাল আটটায় ওনার ব্লাড সুগার টেস্ট করাতে নিয়ে গিয়েছিলাম একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে । বুধবারে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে বৃহস্পতিবার অপারেশন হবে।
আশা করি খুব দ্রুতই আবার চোখে দেখতে পাবেন।
আবদুস সামাদ আজাদীর কথায়, "আমি তোমাদেরকে চোখ দিয়ে দেখতে চাই, বই-পুস্তক পড়তে চাই। I don't want anything else in my life"

আর এই সবকিছুর জন্য শহীদুজ্জামান স্যারের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা।

লেখক: ফাতিমা তাহসিন, এজিএস, শামসুন নাহার হল, ঢাবি