অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ভিসি নিয়োগেও গোয়েন্দা প্রতিবেদন!


ঢাকা // ঢাকা পোস্ট | Published: 2021-03-12 13:28:58 BdST | Updated: 2024-04-27 05:14:46 BdST

সরকারের সচিব, ডিসি (জেলা প্রশাসক) নিয়োগের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগেও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের দ্বারস্থ হচ্ছে সরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ভিসি নিয়োগে এখন গোয়েন্দা প্রতিবেদনকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো প্রস্তাবিত ভিসিদের তালিকার সঙ্গে এখন থেকে গোয়েন্দা প্রতিবেদনও যুক্ত হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

তবে বিষয়টি আনঅফিশিয়াল (অনানুষ্ঠানিক) হওয়ায় এ বিষয়ে কেউ বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

উপাচার্য হতে আগ্রহী শিক্ষকদের আমলনামা গোয়েন্দাদের মাধ্যমে সংগ্রহ করে তা সরকারের সর্বোচ্চপর্যায়ে পাঠানো হবে। সম্প্রতি বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, নিয়োগে স্বজনপ্রীতি এড়াতে এমন উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

একজন উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সব একাডেমিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। তার কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়টি কেমন চলবে। আমরা চাই, ভালো ইমেজের ব্যক্তি উপাচার্য হোক
মো. মাহবুব হোসেন, সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ

সম্প্রতি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। তবে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, ‘আমি শিক্ষামন্ত্রীর ষড়যন্ত্রের শিকার।’

ওইদিনই (৪ মার্চ) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবুল খায়েরের পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইউজিসি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এ প্রক্রিয়ার কোনো পর্যায়ে মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রীর পক্ষ থেকে প্রভাব বিস্তারের কোনো সুযোগ নেই। নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ সাহেবের অভিযোগ অসত্য, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’

বেরোবি উপাচার্যের বিরুদ্ধে আসা এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে— এমনটি মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সরকার একজন সিনিয়র অধ্যাপককে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার আগে তার অতীত আমলনামা ও পারিবারিক তথ্য যাচাই-বাছাই করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চাকরিজীবনে তিনি কোন ধরনের চরিত্রের অধিকারী ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি করতে গিয়ে কোন ধরনের ভূমিকা নিয়েছেন, বিরোধীদলীয় শিক্ষকদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন কিনা— তদন্ত প্রতিবেদনে এসব বিষয় অগ্রাধিকার পাবে।

  • শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ শতাংশ সিনিয়র অধ্যাপকের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে যোগ্য, সরকারের নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী তিনজনের শর্ট লিস্ট করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়
    ড. ফেরদৌস জামান, সচিব, ইউজিসি

প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে তিনি কোনো আর্থিক অনিয়মে জড়িয়েছেন কিনা— গোয়েন্দাদের মাধ্যমে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এছাড়া আগ্রহী অধ্যাপকের পুরো ক্যারিয়ারের একটি খণ্ডচিত্র সেখানে থাকবে।

জানা গেছে, গত বছর ১২ আগস্ট দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ ১০ শতাংশ অধ্যাপকের তালিকা চায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে দেওয়া চিঠিতে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠতা অনুসারে ১০ শতাংশ অধ্যাপকের জীবনবৃত্তান্ত পাঠাতে বলা হয়। ইউজিসি ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।

ওই তালিকা থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করে। সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শূন্য হওয়া উপাচার্য পদে আগ্রহীদের তথ্য সংগ্রহ করতে গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারস্থ হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব আকারে যাদের নাম পাঠাবে তার সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনও যুক্ত করে দেওয়া হবে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমার জানা নেই’

সূত্র জানায়, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ডিনকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্যানেলে এক নম্বর করে প্রস্তাব পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ফেরত আসে। তার সম্পর্কে আরও অধিকতর যাচাই-বাছাই করে পুনরায় প্রস্তাব পাঠাতে বলা হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ওই শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে প্রভাবশালী হলেও তিনি বিরোধী শিক্ষক রাজনীতি করেন এমন শিক্ষকদের নানাভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন এবং বিভিন্ন লেখায় প্লেজারিজম (চৌর্যবৃত্তি) করেছেন। এমন অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাওয়ার পর তা ফেরত আসে। তার বিষয়ে অধিকতর যাচাই-বাছাই করে পুনরায় ফাইল তুলতে বলা হয়েছে।

জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘একজন উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সব একাডেমিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। তার কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়টি কেমন চলবে। আমরা চাই, ভালো ইমেজের ব্যক্তি উপাচার্য হোক।’ গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

যেভাবে ভিসি প্যানেল তৈরি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ ফাঁকা হলে শূন্য পদ পূরণে দুই মাস আগে থেকেই কাজ শুরু করে মন্ত্রণালয়। জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের মধ্য থেকে তিনজনের নাম প্রস্তাব করে সারসংক্ষেপ পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে।

সেখানে তিনজনের মধ্যে সিনিয়র অনুযায়ী তালিকা তৈরি করা হয়। এ তালিকা তৈরিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একজন অধ্যাপকের একাডেমিক ও প্রশাসনিক যোগ্যতা, সরকারের নীতি ও আদর্শে বিশ্বাসী— এসব বিষয়ে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তবে শর্ট লিস্ট তৈরির আগে কখনও কখনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও নাম পাঠানো হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাঠানো তালিকা থেকেই উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে হয়তো ক্রমানুসারের এদিক-ওদিক হয়। তবে ওই তালিকার বাইরে গিয়ে ভিসি নিয়োগের ঘটনা বিরল।

৩০ জুন পর্যন্ত ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ শূন্য হচ্ছে। এর মধ্যে বর্তমানে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ ফাঁকা। এগুলো হলো- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ড. ফেরদৌস জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ শতাংশ সিনিয়র অধ্যাপকের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে যোগ্য, সরকারের নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী তিনজনের শর্ট লিস্ট করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়। এতটুকু আমি জানি।’ গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমার জানা নেই।’

১২ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির খোঁজে শিক্ষা মন্ত্রণালয়

আগামী জুন মাসে ফাঁকা হবে, এমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি নিয়োগের জন্য এখনই প্রক্রিয়া শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বলছে, ৩০ জুন পর্যন্ত ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ শূন্য হচ্ছে। এর মধ্যে বর্তমানে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ ফাঁকা। এগুলো হলো- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

মার্চ মাসে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ ফাঁকা হচ্ছে। এর মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমানের মেয়াদ শেষ হবে ২০ মার্চ এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়ার পদ ফাঁকা হচ্ছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুস সোবহানের মেয়াদ শেষ হবে ৬ মে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. গিয়াস উদ্দিন মিয়ার ১০ জুন, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের ১৯ মে, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর ১৩ জুন এবং রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষের ১০ জুন। নতুন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার হবিগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ দেওয়া হয়নি।