যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডির স্বপ্ন

জন্ম থেকেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তবুও স্বপ্ন জয়ের পথে রাবির নাঈম


Shoeb Shuvro | Published: 2024-02-22 15:20:42 BdST | Updated: 2024-05-02 17:43:39 BdST

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়ে জন্মগ্রহণ করায় অনেকের কাছেই শুনতে হয়েছে কটুকথা। গ্রামের পাড়াপ্রতিবেশি আমার বাবাকে বলতেন, তোমার অন্ধ ছেলেকে দিয়ে ভবিষ্যতে কিছুই হবে না। এমনসব কটূকথায় কখনোই কষ্ট পাইনি বরং চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। সবসময় ভাবতাম সফল হয়ে সমাজকে একটা জবাব দিবো, যে আমরাও পারি। সেই থেকে বুকভরা সাহস আর মনের জোরে শুরু করেছিলাম পড়াশোনা। আমার কঠোর অধ্যাবসায় ও সংগ্রামের ফলে আমি আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছি। চোখে দেখতে পাইনা বলে কি আমি স্বপ্ন দেখতে পারবো না?—এভাবেই দাপটের সাথে নিজের সংগ্রামের কথাগুলো  বলছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) এক অধম্য মেধাবী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ওই শিক্ষার্থীর নাম নাঈম হোসাইন। তিনি লক্ষ্মীপুর জেলার সদর উপজেলার পশ্চিম লক্ষ্মীপুর গ্রামের মো. কবির হোসেনের ছেলে। দুই ভাই একবোনের মধ্যে নাঈম হলেন সবার ছোট। বিভিন্ন প্রতিকূলতা পার করে গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি ও লক্ষ্মীপুর পৌর আইডিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় ৪.২৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হোন নাঈম। নিজের সাথে সংগ্রাম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত আসতে হয়েছে তাকে।

নাঈম হাসানের তিন ভাইবোন সকলেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। শারীরিক প্রতিকূলতা পিছনে ফেলে তিনজনেই ছুটে চলেছেন তাদের স্বপ্ন পূরণে। তিনজনই পড়াশোনা করছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। বড় ভাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। অন্যদিকে বোন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ২০-২১ সেশনে পড়াশোনা করছেন। জন্মের পর থেকেই কেউ কাউকে দেখতে পায়নি তারা।

তার বাবা কবির হোসেন ছিলেন সৌদি প্রবাসী। গত দুই বছর আগে তিনি দেশে ফিরে আসেন। বর্তমানে তিনি দিনমজুর হিসেবে কর্মরত। এখন তিন সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে তবুও সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবেন এমন স্বপ্নে বিভোর তিনি।

নাঈম হোসাইন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ১৫১ নম্বর রুমের আবাসিক শিক্ষার্থী। নাঈম জন্ম থেকেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুদের সহযোগিতার চলে ফেরা করতে হয় তাকে। মোবাইলে স্ক্রিন রিডার অ্যাপসের মাধ্যমে সবার সাথে যোগাযোগ করেন এবং মোবাইলে পিডিএফ বই পড়ে থাকেন। একবার কোনো জায়গা দেখিয়ে দিলে দ্বিতীয়বার আর দেখাতে হয়না এই অধম্য মেধাবীকে। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে সকল কাজ তিনি একা করতে পারেন। কারো সহযোগিতাও প্রয়োজন পড়ে না তার। তবে নতুন কোনো স্থানে গেলে তাকে প্রথমে একবার দেখিয়ে দিতে হয়।

চোখে দেখতে পাননা তবুও কিভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আমি মোবাইলে স্ক্রিন রিডার অ্যাপসের মাধ্যমে পড়াশোনা করে থাকি। আর পরীক্ষাগুলোতে বিভাগের জুনিয়র কিংবা অন্য বিভাগের বন্ধু বা জুনিয়র কাউকে শ্রুতিলেখক হিসেবে নিয়ে আসি। আমি তাদের মুখে বলি, আর তারা লিখে দেয়। আমার বই পড়তে খুব ভালো লাগে। তাই আমি মোবাইলে পিডিএফ এর বইগুলো পড়ে থাকি। কিন্তু পিডিএফে সকল বই পাওয়া যায়না, এ বিষয়টি আমাকে খুব কষ্ট দেয়"।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার স্বপ্ন সম্পর্কে তিনি বলেন," আমার মা আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিলো এবং আমার শিক্ষাগুরু বোরহান উদ্দিন ভূইয়া, যিনি আমাকে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। পাশাপাশি এখনো আমি স্যারের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে উপদেশে নিয়ে থাকি। তিনি নিজেও একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। আমার এক বড়ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিলো, তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। তখন থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করি এবং আমার লক্ষ্যই ছিলো কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে পড়তে হবে। ভবিষ্যতে নিজেকে একজন কলেজের শিক্ষক হিসেবে দেখতে চাই। পাশাপাশি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করার স্বপ্ন দেখছি। আল্লাহ সহায় হলে আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করবো ইনশাআল্লাহ"।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আসতে কখনো কটূকথা শুনতে হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "গ্রামের পাড়াপ্রতিবেশীরা আমার প্রতিবন্ধকতার কারনে, আমার বাবাকে বলতেন আমাদের দিয়ে ভবিষ্যতে কিছুই হবে না। এমনসব কথায় আমি কখনোই কষ্ট পায়নি, বরং চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। মনে মনে ভাবতাম আমাকে কিছু একটা করতে হবে। আমার কাজের মাধ্যমে সমাজকে দেখাবো, যে আমরাও পারি"।

সফল হওয়ার পর পিছিয়ে পড়া মানুষদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, "আমি যদি কখনো প্রতিষ্ঠিত হতে পারি, তাহলে আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগে সমাজে যারা পিছিয়ে পড়া মানুষ আছে, তাদের নিয়ে কাজ করতে চাই। পিছিয়ে পড়া মানুষদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমি তাদের একটা কথাই বলবো, ভেঙে পড়ার কোনো কারণ নেই। আপনার সৃষ্টিকর্তা আপনার পাশে আছে"।

নাঈম হোসাইনের বাবা কবির হোসেন বলেন, "আমার ছেলেকে নিয়ে আমি গর্ববোধ করি। আজ আমি একজন সফল বাবা। আমার নাঈম এখন বাংলাদেশের সব থেকে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আমার ছেলে এখন আমার এলাকার গৌরব। তার এই সফলতা অন্য পিছিয়ে পড়া ব্যক্তিদের এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আমি আশা করি"।

নাঈম হোসাইনের রুমমেট রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম বলেন, "প্রতিদিন সকালে ক্লাসে যাওয়ার সময় আমরা তাকে হল গেইটে রিকশায় তুলে দিয়ে আসি। হলের ডাইনিং-ক্যান্টিন থেকেও তার জন্য খাবার নিয়ে আসি। নাঈমের বন্ধু-বান্ধব ও জেলা সমিতির সদস্যরা প্রতিনিয়তই তার খোঁজ খবর নিতে রুমে আসেন। পরীক্ষার আগে তার নোটগুলো, আমরা মোবাইলে রেকর্ড করে দেই এবং সে এগুলো শুনে শুনে আয়ত্ত করে সে পরীক্ষা দেয়। পিছিয়ে পড়া মানুষরাও পারে তার বড় উদাহরণ নাঈম"।

ইতিহাস বিভাগের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মাহমুদা খাতুন বলেন, "নাঈম হোসাইন অসম্ভব মেধাবী একটি ছেলে। জন্ম থেকেই সে অন্ধ তবুও আল্লাহ তাকে অনেক মেধা দিয়েছেন। বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করি। আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে ক্লাসের বাহিরেও তাকে নার্সিং করে থাকি। আমি বিশ্বাস করি নাঈম একদিন ভালো কিছু করবে। আমি তার বিভাগের শিক্ষক হিসেবে তাকে নিয়ে গর্ব করি।