ঢাবির প্রথম বাঙ্গালী মুসলিম উপাচার্যকে স্মরণ


ঢাবি টাইমস | Published: 2019-12-12 06:07:25 BdST | Updated: 2024-05-05 10:55:23 BdST

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বাঙালি মুসলিম উপাচার্য স্যার আহমেদ ফজলুর রহমানকে তার ৭৪তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ।

সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হল সংসদের উদ্যোগে এক স্মরণসভায আয়োজন করা হয়।

সভায় বক্তারা বলেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন একটি অসাম্প্রদায়িক বিশ্ববিদ্যালয়ের গড়ে তুলে গিয়েছিলেন। সে সময় তার কারণেই বিশ্ববিদ্যালয় শান্ত ও সুন্দর ভাবে পরিচালিত হয়েছে।

স্মরণ সভায় বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল, সুফি মিজানুর রহমান, ডঃ মোঃ আবু তারিক , এম এ কাশেম, কলা অনুষদের ডিন ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ডঃ আবু মো: দেলোয়ার হোসেন।

এতে সভাপতিত্ব করেন হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ড কে এম. সাইফুল ইসলাম খান।

বক্তব্যে এফ রহমান হল ছাত্র সংসদের ভিপি মোঃ আব্দুল আলীম খান বলেন , ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা উপমহাদেশের প্রথম বাঙালি উপাচার্য। তার হাত ধরেই হলগুলোতে সর্বপ্রথম ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে সহায়তা করেন।তাঁর স্মৃতি স্মরণে তার নীতি আদর্শ,নিঃস্বার্থ উদার নৈতিকতা বোধের চর্চা সাধারণ শিক্ষার্থীর মাঝে ছড়িয়ে দিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

ইংল্যান্ডের নামি-দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে সম্মানের সঙ্গে চাকরি করার সুযোগ ছিল তার। সেই সম্ভাবনাকে টেমস নদীর জলে ছুড়ে ফেলে তিনি ছুটে এসেছিলেন অবহেলিত বুঁড়িগঙ্গার তীরে। তিনি ছিলেন মৃদুভাষী ও শান্ত স্বভাবের। পারিবারিক আবহে তার বিদ্যা অর্জনের হাতেখড়ি। পড়ুয়া ও তুখোড় মেধাবী হিসেবে তিনি ১৯০৮ সালে জলপাইগুড়ি জিলা স্কুল থেকে থেকে এন্ট্রাস পরীক্ষায় অংশ নেন। পরীক্ষায় শুধু পাসই করেননি বৃত্তি পেয়ে হাসি ফুটিয়েছিলেন পিতা মৌলভী আবদুর রহমানের মুখে। কুঁড়িয়েছিলেন সবার প্রশংসা। এর পর তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি জমান। সেখান থেকে ১৯১২ সালে ইতিহাসে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পর তার ঝোঁক চাপে অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করার। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’ নিয়ে গবেষণা করেন।

দুই বছরের গবেষণা কাজ শেষে ১৯১৪ সালে বিলেত ত্যাগ করে তিনি ভারতবর্ষে এসে যোগ দেন তৎকালীন আলীগড় অ্যংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজে, যা আজকের আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে শুরু করেন অধ্যাপনা। বলছিলাম স্যার এ এফ রহমানের কথা। যার পুরো নাম আহমেদ ফজলুর রহমান। ১৮৮৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি শহরে জন্ম নেওয়া আহমেদ ফজলুর রহমানের আদি পিতৃ-ভিটা ফেনী জেলায়। যিনি ভারতবাসীকে উচ্চ শিক্ষিত করতে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে গেছেন।

পূর্ববঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা নিয়ে যখন নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছিল, নানা জনের কাছ থেকে বিরোধী মত আসছিল, তখন আহমেদ ফজলুর রহমান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সদস্য হিসেবে ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য পি জে হার্টসের অনুরোধে তিনি আলীগড়ের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। আলীগড় ছেড়ে রিডার হিসেবে (সহকারী অধ্যাপক) যোগ দেন সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। শিক্ষক ফজলুর রহমান শুধু শ্রেণি কক্ষে নয় শিক্ষার্থীদের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন বাইরেও।

তৎকালীন বাংলার গভর্নর সৈয়দ শামসুল হুদার সুপারিশে মুসলিম হলের (বর্তমান সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) প্রথম প্রভোস্ট মনোনীত হন। প্রভোস্ট হওয়ার পর তিনি হলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে শুরু করেন এক নতুন অধ্যায়ের। হলের ছাত্রদের মাঝে তিনি খুঁজে নেন ইংল্যান্ডে ফেলা আসা অক্সফোর্ডের আনন্দ। শুরু করেন ছাত্র সংসদ নির্বাচন ও হাতে নেন নানা ধরণের শিক্ষা বান্ধব কর্মসূচি। যা সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সহজেই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাতি অজর্ন করিয়ে দেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন থেকে প্রকাশিত সৌরভে গৌরবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (দ্বিতীয় খণ্ড) বইয়ের ৭৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে, “আলীগড় থেকে আসা এ.এফ রহমান ছিলেন এক সংস্কৃতি সচেতন অমায়িক উদারপ্রাণ ব্যক্তি। সকলেই তার প্রশংসায় প মুখ। আলীগড়ে ছাত্ররা সংস্কৃতির দিক থেকে ছিল অগ্রগামী। এখানে এসেও তারা এ.এফ রহমানের আনুকূল্য পেয়ে মুসলিম হলে অক্সফোর্ড-ক্যাম্ব্রিজ স্টাইলে হল ইউনিয়ন গঠন করলেন। আর এই হল ইউনিয়নের মাধ্যমেই সকল সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলার আয়োজন করা হত। কোন সংস্কৃতিক সংস্থা তখনও জন্মলাভ করেনি।”

ফজলুর অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ইতিহাস বিভাগের করিডোর ছাড়িয়ে তিনি ধীরে ধীরে যুক্ত হন রাজনীতির সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দানের দুই বছরের মাথায় ১৯২৩ সালে তিনি রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েটদের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে প্রথমবারের মত বেঙ্গল পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯২৭ সালে তিনি আরো একবার নীলফামারী সংসদীয় এলাকা থেকে গ্রাজুয়েট প্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বঙ্গীয় আইন সভায় যোগদান করে স্যার এ এফ রহমান তার প্রজ্ঞা ও বিজ্ঞতার স্বাক্ষর রাখেন। আইন সভার সদস্য হিসেবে তার কাজের মেয়াদ শেষ হলে ১৯৩২ সালে তিনি নিজেকে যুক্ত করেন বেঙ্গল ভোটাধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে। একই বছর তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সদস্য নিযুক্ত হন।

শুধু আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ই নয় তিনি শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা পালন করেছেন এ ফোরসেইড কলেজ প্রতিষ্ঠায়ও। কলেজটির প্রতিষ্ঠার পর সেটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরে যারা কাজ করেছেন সেই সব শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের সদস্য সচিব হিসেবে ছিলেন আহমেদ ফজলুর রহমান। তার বহুবিধ প্রতিভা, কর্মদক্ষতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সৃষ্ট নানা উদ্যোগ দেখে ব্রিটিশ সরকার প্রথম বারের মত বাঙালিদের মধ্য থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করে।

১৯৩৪ সালের ১ জুলাই ব্রিটিশ সরকার তাকে উপাচার্য হিসেবে নিযুক্ত করে। একই তারিখে বাংলা সরকার তাকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত করে। ১৯৩৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তাকে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সদস্য নিযুক্ত করা হয়। একই বছরের শেষ দিকে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাত্র দুই বছরের মাথায় স্যার এ এফ রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের নিকট আবেদন করেন ১ জানুয়ারি ১৯৩৭ থেকে তাকে ভাইস-চ্যান্সেলরের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য। আবেদন গৃহীত হলে ১৯৩৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর এই মহান শিক্ষক অধ্যাপনা জীবনের ইতি টানেন।

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখতে পাই বিদায়ী উপাচার্যের সঙ্গে পরবর্তী উপাচার্যের মধ্যে অনেকটা দা-কুমড়া সম্পর্ক থাকে। কিন্তু স্যার এ এফ রহমান উপাচার্যের দায়িত্ব থেকে অবসর নেওয়ার পর নতুন উপাচার্য তাকে সম্মানিত করেছিলেন। ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিতে ভূষিত করা হয়। সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারে স্যার এ এফ রহমানের অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাঙালির এই মহান শিক্ষককে ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ সরকার তাদের রাজকীয় খেতাব ‘নাইট’ উপাধী প্রদান করেন।

এই মহান শিক্ষাবিদ সম্পর্কে লেখক ও সাংবাদিক ইমদাদুল হক মিলন লিখেছেন, “তিনি বাঙালির স্বপ্নের মানব। তিনি কখনো হয়ে উঠেছেন মহাপুরুষ, কারো কাছে মহামানব, কেউ তাকে ডেকেছেন মহাপ্রাণ নামে, কারো কাছে মনে হয়েছে কিংবদন্তির জীবন্ত নায়ক, কেউ চিনেছে তাঁকে দানবীর হিসেবে। তিনি একজন সফল উদ্যোক্তাও।”

১৯৪৫ সালের ১০ ডিসেম্বর মাত্র ৫৬ বছর বয়সে স্যার আহমেদ ফজলুর রহমান সবাইকে কাঁদিয়ে পরপারে পাড়ি জমান। তার মৃত্যুর ৩০ বছর ৮ মাস পর ১৯৭৬ সালের ২১ আগস্ট সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার নামানুসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার এ এফ রহমান হল প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও তার স্মরণে স্যার এ এফ রহমান হল রয়েছে। একজন ছাত্র হিসেবে তিনি অক্সফোর্ডে, একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি শিক্ষাঙ্গনে এবং একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি সংসদে যে দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ ভূমিকা পালন করেছেন তা তাকে আমাদের মাঝে অমর করে রাখবে।

তিনি শুধু নিজেই উচ্চ আসনে আসিন হননি, তিনি বাঙালি জাতি সত্বাকে তুলে ধরেছেন বিশ্বদরবারে। নাইট উপাধী অর্জনকারী হিসেবে আহমেদ ফজলুর রহমানের নামের সঙ্গে বাঙালি জাতির নামটিও বিশ্বদরবারে পৌঁছে গেছে শ্রদ্ধার আসনে। শেষ কথায় বলব. তাকে স্মরণ ও তার নিঃস্বার্থ-উদার নৈতিকতাবোধের চর্চাই হোক বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের হাতিয়ার।