বুক রিভিউ: লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে


Dhaka | Published: 2019-12-14 23:09:43 BdST | Updated: 2024-03-29 12:13:17 BdST

বইয়ের নামঃ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে
লেখকঃ রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম

স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম রচিত লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে গ্রন্থটি ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয়। তবে এর ইংরেজি সংস্করণ (A Tale of Millions) প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। বাংলা সংস্করণটি মূল ইংরেজি সংস্করণের বর্ধিত সংস্করণ। এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা লেখক সন্নিবেশিত করেছেন, যা আগের ইংরেজি সংস্করণে ছিল না। এর আগে স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ নিয়ে বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও সশস্ত্র যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে এই গ্রন্থটি প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত।

এ গ্রন্থের আগে যুদ্ধসংক্রান্ত প্রকাশিত বেশির ভাগ গ্রন্থই স্মৃতিকথা হিসেবে লিখিত। আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে এটিই কোনো সেক্টর কমান্ডারের লিখিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রথম গ্রন্থ। বেশির ভাগ সেক্টর কমান্ডার যুদ্ধের বিবরণ গ্রন্থিত করেননি, যে দু-একজন করেছেন তাঁরা তা করেছেন অনেক পরে।

বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে লেখক ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন, ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে গ্রন্থটির মূল অংশে সামরিক ও গেরিলা তৎপরতার বিবরণ এবং রাজনৈতিক অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।’ বইয়ের প্রথম প্রায় ৫০ পৃষ্ঠায় লেখক স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ বিশ্লেষণ করেছেন। এতে নতুন কোনো তথ্য না থাকলেও যুদ্ধের আবশ্যকতা প্রমাণ এবং পরবর্তী অধ্যায়গুলো বুঝতে সাহায্য করে। এরপর বাকি বইয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোর উল্লেখ আছে।

লেখক নিজে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব থেকে সংযুক্ত থাকা ও একটি সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন, তাই যুদ্ধের অনেক কিছুই প্রত্যক্ষ করেছেন। যুদ্ধের নীতিনির্ধারণ ও সম্পাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে তাঁর বর্ণনাকে অনেকটাই বস্তুনিষ্ঠ মনে করা যায় এবং দলিল হিসেবে গ্রহণ করা যায়। তবে কোথাও কোথাও সহনশীল পর্যায়ের আমিত্বও নজরে পড়ে। যুদ্ধের নয় মাসে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে তিনি যেভাবে দেখেছেন, গ্রন্থে তার মূল্যায়ন আছে, যা মুক্তিযুদ্ধের গবেষকদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হবে। যেমন শরণার্থী শিবিরের সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে খুব বেশি যোগ দেননি, ক্ষমতাসীন দল মুক্তিযুদ্ধকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে, যা যুদ্ধের সফলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

যুদ্ধের ময়দানে আদেশ-নির্দেশ অস্পষ্ট বা দ্বিধান্বিত হলে জীবনহানির আশঙ্কা থাকে। অথচ কখনো কখনো বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তর এবং ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের মধ্যকার আদেশ-নির্দেশ পরস্পরবিরোধী হতো। কিছু পরিশিষ্ট একান্তই ব্যক্তিগত, যা গ্রন্থের জন্য প্রয়োজনীয়তা মনে হয়নি এবং বইয়ের সঙ্গে খুব একটা সংশ্লিষ্টও মনে হয়নি।

স্বাধীনতা যুদ্ধের অংশীদার হওয়ার কারণে গ্রন্থটি শতভাগ নিরপেক্ষ হয়নি বা আত্মজীবনীর ছাপ লক্ষ করা যায় বলে লেখক নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আমি গভীরভাবে সম্পৃক্ত ও একাত্ম থাকার কারণে ইতিহাস রচনার নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিতে বইটি লেখা হয়ে ওঠেনি। তাই বইটির কোনো কোনো অংশে জীবনচরিত বা আত্মকথার ছোঁয়া অনুভূত হতে পারে।’

গ্রন্থটি প্রশংসনীয় উল্লেখ করার পর শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘মেজর রফিকুল ইসলাম তাঁর স্মৃতিকথায় অন্য সব প্রসঙ্গ উত্থাপনের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততার পরিচয় দিলেও জিয়াউর রহমানের ক্ষেত্রে যে তিনি কাল ও প্রেক্ষিতের সুযোগ গ্রহণ করেছেন—এ কথা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলতে হচ্ছে।’

লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতাযুদ্ধবিষয়ক একটি মৌলিক গ্রন্থ এবং ইতিহাসের ছাত্রের জন্য অবশ্যপাঠ্য।

//