নিষিদ্ধ অথচ জনপ্রিয় ৮টি বইয়ের গল্প


Dhaka//Prothomalo | Published: 2020-06-17 04:55:08 BdST | Updated: 2024-12-11 00:38:03 BdST

নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি নাকি মানুষের সহজাত আকর্ষণ। বইয়ের ক্ষেত্রেও তাই। কোনো বই নিষিদ্ধ বা সমালোচিত হলে তার চাহিদা রাতারাতি বেড়ে যায় কয়েক গুণ। বিক্রেতারাও এই সুযোগে চড়া দামে সেগুলো বিক্রি করেন। বিশ্বের ইতিহাসে ১৫৫৭ সালে প্রথম কোনো বই বাজেয়াপ্ত বা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সে সময় খ্রিষ্টান ক্যাথলিক মতের সঙ্গে অমিল থাকায় তৎকালীন পোপ বেশ কিছু বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এর মধ্যে অবশ্য কয়েকটি বিজ্ঞানবিষয়ক বইও ছিল। এর পর থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কয়েক শ বই নিষিদ্ধ হয়েছে বিভিন্ন কারণে। কোনোটা নিষিদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় কারণে, কোনোটা রাজনৈতিক কিংবা কোনোটা ভায়োলেন্স বা অশ্লীলতার দায়ে। কিন্তু এমন কিছু বইও আছে, যেগুলো আসলে ওপরের কোনো কারণের মধ্যে পড়ে না। তার পরও সেগুলো বিভিন্ন দেশে প্রকাশনা বা বিক্রি নিষিদ্ধ হয়েছে। নিচে সে রকম নিষিদ্ধ হওয়া কয়েকটি জনপ্রিয় বইয়ের কথা জানাচ্ছেন শারমীন আফরোজ-

জে কে রাউলিংয়ের ‘হ্যারি পটার সিরিজ’

২০০১ সালের ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের লুইস্টোনে বিক্ষুব্ধ একদল অভিভাবক একজোট হয়ে রাস্তায় নামেন। তাঁদের চোখে বাজে কিছু বই পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন তাঁরা। তাঁদের দাবি, এই বইগুলো শিশু-কিশোরদের সহিংস হতে, জাদুবিদ্যা আর শয়তানি শেখাচ্ছে। অবশ্য বইগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার আগেই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সেগুলো উদ্ধার করেন। পরে বিক্ষুব্ধ অভিভাবকদের সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই বইগুলো ছিল হ্যারি পটার সিরিজ -এর। জে কে রাউলিংয়ের হ্যারি পটার সিরিজ সারা বিশ্বের শিশু-কিশোরদের কাছে জনপ্রিয়। ছোটদের জন্য জাদুমন্ত্র, দৈত্য-দানব নিয়ে রূপকথার মতো কাল্পনিক এক আজব জগৎ তৈরি করেছেন লেখিকা। এসব বিষয়ই স্কুলশিক্ষক ও অভিভাবকদের মূল আপত্তির কারণ। তা ছাড়া, সিরিজের মূল চরিত্রগুলো বয়েসে ছোট কিন্তু বুদ্ধিমান। এমনকি তাদের বুদ্ধি অনেক সময় বড়দেরও ছাড়িয়ে গেছে। এসব কারণে সিরিজটি নিয়ে বিশ্বজুড়ে অভিযোগের অন্ত নেই শিক্ষক আর অভিভাবকদের। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশের স্কুলে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সিরিজটির বইগুলো।

অ্যানি ফ্রাঙ্কের ‘দ্য ডায়েরি অব আ ইয়াং গার্ল’

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। হিটলার তখন বিশ্বজয়ের নেশায় উন্মত্ত। ইউরোপের দেশগুলোতে একের পর এক অভিযান চালিয়ে তা দখল করে নিচ্ছিলেন। অমানবিক নির্যাতনের ভয়ে দিশেহারা হয়ে ইহুদিরা তখন পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। এ সময় নেদারল্যান্ডসের এক পরিবার নাজি সেনাদের ভয়ে টানা দুই বছর এক বাড়িতে লুকিয়ে ছিল। এ সময়টাতে অ্যানি ফ্রাঙ্ক নামে এই পরিবারের ছোট্ট এক মেয়ে সময় কাটানোর জন্য ডায়েরি লিখেছিল। যুদ্ধের পর সেই ডায়েরি বই আকারে প্রকাশিত হয়। দ্য ডায়েরি অব অ ইয়াং গার্ল নামের বইটি বিশ্বে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে যায়। অথচ বইটি যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে একসময় নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তাদের অভিযোগ, এটিতে অ্যান্টি-সেমিজম এবং নাজি সেনাদের ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা রয়েছে, যা শিশু-কিশোরদের জন্য উপযোগী নয়। এ বই তাদের কোমল অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে।

মার্ক টোয়েনের ‘দি অ্যাডভেঞ্চার অব টম সয়্যার’

দুষ্টের শিরোমণি টম সয়্যারের কথা হয়তো অনেকেরই জানা। সব সময় সমস্যা তৈরিতে ওস্তাদ টম। ইচ্ছে হলেই রাতবিরাতে বন্ধুর সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। ডাকাতের দল গড়তে গভীর রাতে মিটিং করে, ডাকাতিরও চেষ্টা করে সে। শাস্তির তোয়াক্কা না করে পাজি স্কুলশিক্ষককে শায়েস্তা করতে পিছপা হয় না। পাশাপাশি বুদ্ধির ঝিলিকও দেখা যায় টমের মধ্যে। এসব কারণেই ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত মার্ক টোয়েনের এ বইটি শিশু-কিশোরদের কাছে খুব জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু ঠিক একই কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ও কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের লাইব্রেরিগুলোতে বইটি নিষিদ্ধ হয়েছিল। তাদের অভিযোগ, টম এক বিতর্কিত চরিত্র। এ বই পড়ে শিশু-কিশোরেরা অবাধ্যতা আর দুষ্টুমি ছাড়া আর কিছু শিখতে পারবে না।

মার্ক টোয়েনের ‘দি অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন’

১৮৮৪ সালে প্রকাশিত মার্ক টোয়েনের আরেক জনপ্রিয় উপন্যাস হাকলবেরি ফিন । টম সয়্যারের বন্ধু হাক ফিন। মাতাল বাপের কবল থেকে বাঁচতে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল হাক। সঙ্গে ছিল নিগ্রো দাস জিম। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নদীপথে আমেরিকা পার হয়ে কোনো আরব দেশে চলে যাবে। যেখানে নিগ্রোরা দাস হিসেবে নয়, অন্যান্য মানুষের মতোই সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারে। আর এ কারণেই ১৮৮৫ সালে বইটি যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ হয়েছিল। আরেকটি কারণ হিসেবে কর্তৃপক্ষ জানায়: বইটিতে প্রচুর অকথ্য শব্দ আছে, যা শিশু-কিশোরদের জন্য অনুপযোগী। এমনকি বইটি বস্তিবাসীর উপযোগী বলেও মত দেয় তারা।

হ্যারিয়েট বিচার স্টোর ‘আঙ্কল টমস কেবিন’

১৮৫২ সালে প্রকাশিত আঙ্কল টমস কেবিন প্রকাশের পরপরই বিতর্কিত হয়ে ওঠে। কারণ, বইটি সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত দাসপ্রথার ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছিল। বিপরীতে তৈরি করেছিল এক মানবিক আবেদন। বইটি প্রকাশের পর প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের সঙ্গে একবার লেখক হ্যারিয়েট স্টোর দেখা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত গৃহযুদ্ধের দিকে ইঙ্গিত করে প্রেসিডেন্ট স্টোকে বলেছিলেন, ‘আপনার বইয়ের কারণেই আজ এই যুদ্ধ বেধেছে।’ তবে বইটি নিষিদ্ধ করার কারণস্বরূপ ভাষার ব্যবহারকে দায়ী করা হয়।

গ্রিম ব্রাদার্সের ‘দ্য কমপ্লি­ট ফেয়ারি টেলস অব দ্য গ্রিম ব্রাদার্স’

ছোটবেলায় গ্রিম ভাইদের রূপকথা পড়েনি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। জার্মানির দুই ভাই জ্যাকব গ্রিম ও উইলহেম গ্রিমের রূপকথা সারা বিশ্বের মানুষের কাছেই জনপ্রিয়। তবে এখন তাদের যেসব রূপকথা আমরা পড়ি বা বড়দের মুখে শুনি, সেগুলো ছোটদের উপযোগী করতে অনেকবার ছুরি-কাঁচি চালানো হয়েছে বলে শোনা যায়। তাদের লেখা আসল রূপকথাগুলোতে অনেক রক্তারক্তি কাণ্ড আর আপত্তিকর বিষয় ছিল। এ ছাড়া, অধিকাংশ রূপকথা ছিল বিয়োগান্তক। এসব কারণে একসময় অভিভাবকদের চিন্তার কারণ হয়েছিল গ্রিম ভাইদের রূপকথা। তাই ১৮০০ সালে প্রকাশিত দ্য কমপ্লি­ট ফেয়ারি টেলস অব দ্য গ্রিম ব্রাদার্স বইটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল অনেক দেশে।

মার্টিন হ্যানফোর্ডের ‘হোয়ারস ওয়ালডো’

শিশু-কিশোরদের জন্য ব্রিটিশ আঁকিয়ে মার্টিন হ্যানফোর্ডের অনবদ্য সৃষ্টি ওয়ালডো সিরিজ । সিরিজের বইয়ের পাতায় পাতায় রঙিন ছবিতে ভরা থাকত। আর তার ভেতরেই মার্টিনের সৃষ্ট ওয়ালডো চরিত্রটি বিভিন্ন লোকের ভিড়ে লুকিয়ে থাকে। সেখান থেকে ওয়ালডোকে খুঁজে বের করার দায়দায়িত্ব পাঠকদের। শিশু-কিশোরদের কাছে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সিরিজটি। সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তার কারণে পরবর্তী সময়ে এটি নিয়ে টিভি সিরিজও নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এই নির্দোষ সিরিজও নোংরামির অভিযোগে নব্বইয়ের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান ও নিউইয়র্কে নিষিদ্ধ করা হয়।

রে ব্রাডবেরির ‘ফারেনহাইট ৪৫১’

বিখ্যাত বিজ্ঞান কল্পকাহিনির মার্কিন লেখক রে ব্রাডবেরির উপন্যাস ফারেনহাইট ৪৫১ প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। জনশ্রুতি আছে, তিনি একটি লাইব্রেরির পাতাল (নিচের) ঘরে বসে কোনো বিরতি না নিয়ে একটানা বইটি লিখেছিলেন। কিন্তু তাঁর সাধের বইটি প্রকাশের পর দারুণ সমালোচনার মুখে পড়ে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে স্কুলের লাইব্রেরিতে বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সালে বইটির প্রকাশক ব্রাডবেরিকে না জানিয়ে অনেক অংশ কাটছাঁট করে পুনরায় প্রকাশ করা হয়, যাতে সমালোচনা এড়িয়ে স্কুলের লাইব্রেরিতে বইটি সহজে স্থান করে নিতে পারে। ব্রাডবেরি তা জানার পর বাদ দেওয়া অংশগুলো আবারও সংযোজন করে প্রকাশ করেন। এ কারণে ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপির একটি স্কুল বইটি আবারও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।