স্বেচ্ছায় এবরশন: হাসতে হাসতে খুন করার অপর নাম


টাইমস অনলাইনঃ | Published: 2018-12-21 21:37:02 BdST | Updated: 2024-06-16 23:58:14 BdST

গত শুক্রবার। যতটা নয়, তারচেয়ে বেশি উৎকন্ঠা নিয়ে এক দম্পতি ঢুকলেন। মধ্য তিরিশের। বেশ লম্বাটে দুজনই। পোষাক যদি স্বচ্ছলতার মাপকাঠি হয় তবে এরা স্বচ্ছল। তবে খুব অস্থিরতা চোখে মুখে লেগেছিলো।

: কি সমস্যা?

: ম্যাডাম বাচ্চা নষ্ট করতে এসেছি।

উত্তরে কিছু বল্লাম না, শুধু চোখ তুলে তাকালাম। সে তাকানোতে কী ছিলো জানিনা রোগী গড়গড় করে বলতে শুরু করল।

:আসলে আমার আগের দুইটা বাচ্চা আছে। একটা ছেলে একটা মেয়ে। ছোট বাবুটার বয়স মাত্র তিন বছর। বাচ্চা পেটে আসলে আমি এক মুহূর্ত সুস্থ থাকিনা, সারাক্ষণ বমি করি। এই আপদ থেকে আমাকে বাঁচান ম্যাডাম। এই বাচ্চা আমি রাখতে পারবোনা। তাহলে আমার বড় বাচ্চা দুইটা মরে যাবে একদম।

: কত মাস?

: ঠিক বলতে পারবনা। তবে দুই মাসের বেশি হবেনা। ম্যাডাম ঔষধ দেন। আমরা এই বাচ্চা কোনো মতেই রাখতে পারবনা। বারবার একই কথার পুনরাবৃত্তি করছেন একটু পর পর।

: নিলেন কেনো তাহলে?

: নিতে চাইনি, ভুলে রয়ে গেছে।

মনে মনে বললাম, কী আজব! তো ভুল করবে এক পক্ষ, আর জীবন দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করবে আরেকজন। এ কেমন বিচার! মনের কথা মন রেখে অতিরিক্ত শান্ত কন্ঠে বললাম, আগে কনফার্ম হোন কত সপ্তাহর বাচ্চা তারপর দেখি কী করা যায়।

আল্ট্রাসনোতে দেখা গেলো বাচ্চার বয়স প্রায় দুই মাস। এত্তটুকুন একটা মানব ভ্রুণ। অথচ কী জীবনী শক্তি! প্রবলভাবে নিজের হৃৎপিন্ডকে পাম্প করে যাচ্ছে। যেনো ভ্রুকুটি করছে তার অবিবেচক বাবা মায়ের আচরণকে। যেনো বলছে, মানব জাতী তো পাগল কিসিমের! এরা নিজের রক্তকে ভুল বলে ফেলে দিতে চায়। আবার কেউ কেউ নাকি সেই ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্টে জীবনের আলো জ্বেলে দিতে সর্বোত্তম চেষ্টা করে। দেখি আমার ক্ষেত্রে কী হয়?

: ম্যাডাম বলছিলাম না দুই মাস। দেখলেন তো! শুনছি শুধু ঔষধ খাইলেই এই সময়ে কিলিয়ার হইয়া যায়। ওহ্হ! আল্লাহ বাঁচাইছে। ঔষধ দ্যান। খুব তাড়াহুড়া। যেনো একটা ঔষধের প্রেসক্রিপশনেই লেগে আছে মুক্তির বার্তা, অতঃপর পালতোলা নৌকায় ভেসে বেড়ানো চিন্তহীন।

: আচ্ছা তাহলে ফাইনাল, বাচ্চা রাখবেন না?

: জ্বী ম্যাডাম। আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি এই সময়ে। কিচ্ছু খাইতে পারিনা। সারাক্ষণ বমি করি। বিছানায় পড়ে যাই। বাচ্চাকাচ্চার একদম যত্ন নিতে পারিনা।

মনেমনে ভাবছি, কী আজব সাইকোলজী মানুষের! এক বাচ্চার শুশ্রূষার জন্য অন্য বাচ্চা মেরে ফেলতে চাচ্ছে! এটাতো কোনো অযুহাত হতে পারেনা বাচ্চা নষ্ট করার জন্য। জীবন মরন সমস্যা হলে এক কথা ছিলো।

: শুধুমাত্র এই অযুহাতে আপনি আপনার সন্তানকে হত্যা করবেন?

: না মানে এখনো তো হয়নাই। তাছাড়া...

: তাহলে পেটের ভিতরের টা থাক। বরং বড় দুই বাচ্চার যে কোন একটাকে মেরে ফেলেন।

: কী বলেন ম্যাডাম?

: আঁৎকে ওঠলেন কেনো? একই তো। মারবেন যখন যে কোনো একটা হলেই তো হয়।

এবার একটু চুপ করে বসলেন যেনো। হয়তো বা ভেবেও থাকবেন, ম্যাডাম এভাবে কথা বলল!

: দেখুন আপনাদের বাচ্চা আপনারা নষ্ট করতেই পারেন। আমি শুধু বলছি আপনারা একটু ভেবে দেখেন বাচ্চাটা রাখতে পারেন কিনা। এরপর আর নিবেন না প্রয়োজনে। চাইলেই নিলাম, চাইলেই নষ্ট করলাম এটা ঠিক না।

কৈফিয়তের সুরে আরো বললাম, দেখুন আমি বাচ্চা নষ্ট করিনা। এ ব্যাপারে কোনো রকম পরামর্শ ও দিই না। তবে যদি এমন হতো যে, আপনার বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে তাহলে আমি আপনাকে যথাযোগ্য চিকিৎসা দিতাম। আপনি অন্য কাউকে দেখাতে পারেন। স্যরি।

নিজের স্থির এবং দৃঢ় কন্ঠে নিজেই অবাক হলাম। এবং কথা কটা বলে একধরনের স্বস্তি পেলাম যেনো। মনেমনে বলি, আমিতো এমন করে কথা বলি না। তাছাড়া এবরশনতো এখন লিগ্যাল। এর ঔষধ তো মুড়ি মুড়কির মতো বিক্রি হয় বলে শুনছি। ইনফ্যাক্ট ফার্মেসিম্যানই নাকি প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বিক্রি করে।

এক মন বলছে, এতটা রিজিড না হলেও পারতে। আরেক মন বলছে, কী করব বাচ্চাটার হার্টবিট এত রিদমিক ছিলো যে, মনে হচ্ছিলো আমাকে বলছে, প্লিজ সেভ মি ডক্টর। প্লিজ!
তাছাড়া আমার সেই সময়ের কথা মনে পড়ে গেলো।

: কোন সময়ের?

: কেনো ভুলে গেলে?

: আশ্চর্য্য! মনে নেই একটা বাচ্চার জন্য আমাদের সে কী আকুলতা? বাচ্চার হার্টবিট নেই জেনে আকাশ পাতাল ভাসিয়ে আমার নীরব কান্না? তুমিই বলো একটা জীবন্ত বাচ্চাকে মেরে ফেলার সহযোগী আমি কেমন করে হই?

: তাদের বাচ্চা তারা এবর্ট করতেই পারেন। এটা আইনত বৈধ।

: যতই বৈধ হোক, এটা আমি করতে দিতে পারিনা। আমি কখনোই করি না, করবো না। যখন আমার জান বাচ্চারা আমার কোলে আসার আগেই ইশ্বরের কাছে পাড়ি জমিয়েছিলো, তখনই এটা আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমি আমার প্রতিজ্ঞার প্রতি দায়বদ্ধ।

: কিন্তু রোগী কি তোমার কথা শুনলো?

: না শুনুক আমি আমার কাজ করেছি, অন্তত চেষ্টা তো করেছি।

'ম্যাডাম আপনার কথায় আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করলাম।'

রোগীর হাজবেন্ডের কথায় সম্বিৎ ফিরল। খুশিতে চোখে পানি আসার মতো ব্যাপার। চোখের কোনায় পানি নিয়ে ঝাপসাচোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। মনে হলো ভ্রুণটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে কৃতজ্ঞতা!