নীলা থে‌কে সুন্দরী


ফা‌হিমা আকতার | Published: 2019-01-28 10:57:47 BdST | Updated: 2024-05-21 03:23:59 BdST

মেয়েটির বয়স তখন সাত কি আট। কালো গড়নের ছিপছিপে দেহ। পেট টা বেশ বড় আকৃতির। কৃমি হয়েছিল মনে হয়। মেয়েটাকে জন্ম দেওয়ার সময় তার মা মারা যায়। সেই থেকে গ্রামের সবাই তাকে অপয়া বলে ডাকে। মা মারা যাওয়ার কিছুদিন পরেই তার রিক্সাওয়ালা বাবা আবার বিয়ে করে। ঘরে আসে সৎ মা। এর পর থেকে কবে একবেলা ভাত পেট পুরে ভাত খেয়েছে মনে নেই মেয়েটির। অনেকেই মেয়েটিকে রত্না নামে ডাকতো।কিন্তু কেন যেন মেয়েটি শুধু অপয়া নামেই সাড়া দিত। হয়তো সবার দেয়া অপয়া নামটাই তার বেশি পছন্দ হয়েছিল।

একদিন দুপুরবেলা রত্না উঠানে বসে খেলা করছিল। সারাগায়ে মাটি লেগে আছে। হঠাৎ করে এক মধ্যবয়সী মহিলা আর পঞ্চাশ কি ষাট বছরের এক মহিলা আসলো। রত্নাকে দেখেই মধ্যবয়স্কা মহিলাটি কোলে তুলে আদর করতে থাকলো। একটু পর তারা রত্নাদের টিনের দোচালা ঘরে ঢুকলো। রত্নার সৎ মা তাদেরকে দেখে ভ্রু কুচকে ভিতরের ঘরে চলে গেল। ভিতরের ঘরে রত্নার বাবা ঘুমিয়ে ছিল।একটু পর সে ভিতরের ঘর থেকে চোখ কচলাতে কচলাতে বেরিয়ে আসলো।

মহিলাগুলোর সাথে কথা বলে সে বুঝতে পারলো যে তারা রত্নাকে দত্তক নিতে চায়। এবং সাথে সাথেই সে রাজি হয়ে গেল। ভিতর এর ঘর থেকে রত্নার সৎ মা সব শুনছিলো।দত্তক এর কথা শুনে সেও খুব খুশি হয়ে গেল।মনে মনে হয়তো ভেবেছে, এতদিনে তার আপদ বিদায় হচ্ছে। কিন্তু রত্না কিছুই বুঝছে না। কথাবার্তা শেষে মহিলা দুটি রত্নাকে নিয়ে খুশি মনে বাড়ি চলে গেল।

শুরু হল রত্নার নতুন জীবন।নতুন মায়ের সাথে ভালই আছে সে। নতুন মায়ের সাথে সে একজন নতুন বাবা ও পেয়েছে। নতুন মা তাকে খুব যত্ন করে। নতুন নাম ও দিয়েছে তার, "নীলা"।ভাল ভাল খাবার খাওয়ায়, নতুন জামা কাপড় কিনে দেয়। দিব্যি তার ছিপছিপে দেহে মেদ দেখা দিল। নতুন মা তাকে নিয়ে স্কুলে ভর্তি করে দিল। নতুন জীবনে বেশ ভাল মানিয়ে নিয়েছে সে এবং বেশ ভালোই আছে। তার বয়স যখন এগারো তখন তার নতুন মায়ের একটি ছেলে হয়। অর্থাৎ তার একটি ভাই হয়েছে। নতুন ভাই পেয়ে নীলা খুব খুশি।সারাক্ষণ দেখে রাখে তাকে।কথা বলার চেষ্টা করে ভাইয়ের সাথে।

আস্তে আস্তে তার ভাইও বড় হতে থাকে। নীলাও অনুভব করতে থাকে তার মা বাবাও অনেকটা বদলে গেছে। আগের মত খাইয়ে দেয় না, কথায় কথায় বকা দেয়, পড়তে বসলেই এটা সেটা করতে বলে। নীলা অবশ্য এতকিছু ভাবে না। মায়ের কথা মত সব কাজ করে।তারপরেও কথায় কথায় তার মা খুব বকাঝকা করে।বেশকিছুদিন হল কথায় কথায় গায়েও হাত তোলে। দেখতে দেখতে নীলার বয়স বিশ বছর হয়ে গেছে। ক্লাস এইটের পর তার আর পড়া হয় নি।ঘরের সবকাজ তাকে দিয়ে করায় তার মা।

একদিন দুপুরে নীলার মা তাকে ভাল জামাকাপড় পড়তে বললো। মায়ের কথামত সে জামা পড়লো। ঘন্টাখানেক পরে কিছু অচেনা মানুষ আসলো তাদের বাসায়। তার বুঝতে ভুল হল না।নীলাকে দেখতে এসেছে। নীলার মা তাদের সাথে কথা বলছে।কিছু সময় পর নীলার বাবা তাকে মেহমানদের রুমে নিয়ে গেল। তারা নীলাকে খুব খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো। কিছু জিজ্ঞাসা করার পরে নীলাকে অন্যরুমে পাঠিয়ে দেয়া হল। মেহমানরা যাওয়ার পর নীলার মা বাবাকে বেশ খুশি দেখা গেল। রাতে ঘুমানোর আগে তারা নীলার হাতে একটি ছেলের ছবি দিয়ে বললো যে আগামী মাসে এই ছেলেটির সাথে নীলার বিয়ে। এই বলেই তারা চলে গেল।নীলার ইচ্ছার কথা একবারও জানতে চাইলো না তারা।বুক ফেটে কান্না এলো তার।তাও সে কিছু বলে নি কাউকে। মা বাবা যা করছে হয়তো তার ভাল থাকার কথা ভেবেই করছে।

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলে এসেছে। মোটামুটি পারিবারিক একটি বিয়ে হয়। একটা জিনিস নিয়ে নীলা খুব অবাক হয়, বিয়ের আগে যেই ছেলের ছবি তাকে দেখানো হয় সেখানে প্রায় ফর্সা গোছের একটি ছেলে ছিল।কিন্তু বিয়ের দিন যার সাথে তার বিয়ে হয় সে ছিল একদম কাল। অবশ্য এটা নিয়ে তার তেমন কোনো অভিযোগ নেই।কারণ সে নিজেও কালো। নতুন সংসার হয়েছে তার। প্রথম কিছুদিন নতুন পরিবারের সবাই খুব ভাল ব্যবহার করছিল তার সাথে। নীলাও তাদের সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিল।কেননা বিয়ের সময় তার মা তাকে বলে দিয়েছিল নতুন ঘরে যেন সে সবার সাথে মানিয়ে নেয়।

কিন্তু এই ভালো ব্যবহার বেশিদিন রইলো না। কারণ তার স্বামী কোনো কাজ করে না।সারাদিন বাসায় শুয়ে বসে থাকে। এবং অকারণে নীলার সাথে খারাপ আচরণ করে। ওইদিকে নীলার বাবা ও মা বিয়ের পর নীলার সাথে আর কোন যোগাযোগ করেনি।হয়তো বিয়ে দিয়েছে এক নীলাকে একপ্রকার ঘর থেকে বিদায় করার জন্য।

বিয়ের ছয় মাস ও পেরোলো না দিন দিন নীলার উপর শুধু অত্যাচার বাড়তে থাকলো। সে নীরবে সব সহ্য করে এবং মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। একদিন খবর আসে যে তার স্বামী এক্সিডেন্ট করেছে। দৌড়ে হাসপাতাল যায় সে। গিয়ে স্বামীর লাশ দেখতে পায়।খুব কান্নাকাটি করে। শশুরবাড়ি সবাই তাকে অপয়া ডাকতে শুরু করে। অপয়া নামটা মনে হয় তার আর পিছু ছাড়বে না। স্বামীর মৃত্যুর পর তার মা বাবা এসেছিল অবশ্য। কিন্তু তাকে না বলেই আবার চলে গেল। অত্যাচার দিনকে দিন মাত্রাতিরিক্ত বাড়ছে। একদিন এমন ও হয়েছে মেরে তাকে সারারাত দরজার বাইরে ফেলে রেখেছে। পরেরদিনই তার জ্বর চলে এসেছে। অথচ সামান্য খাবার দেয়ার মানুষ ও নেই।

অনেক ভেবে চিন্তা করে নীলা সিদ্ধান্ত নিল সে দূরে কোথাও চলে যাবে। সাথে কিছু টাকা নিয়ে একদিন সকালে সে কাওকে কিছু না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে এল। বাসস্ট্যান্ড এ গিয়ে দূরপাল্লার একটি বাসে উঠে ঘুমিয়ে গেল। ঘুমের মধ্যে শুনতে পেল যে, কেউ একজন ধমকাচ্ছে তাকে। চোখ খুলতেই দেখলো যে গাড়ি সম্পুর্ণ খালি এবং গাড়ির হেল্পার ভাড়া চাইছে। কখন যে রাত পার হয়ে গেল টের পেল না সে।ভাড়া দিয়ে নেমে গেল গাড়ি থেকে নীলা। গাড়ি থেকে নেমে সে দেখলো অনেক লোকজন চারপাশে। বাজারের মত একটা জায়গা। বাজার পার হতেই বড় বড় দালান দেখতে পেল। এলাকা ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। থাকার কোন জায়গা না পেয়ে বাজারের এক কোণে ঘুমিয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর একজনের ডাকে তার ঘুম ভাংলো। বেশ মোটাসোটা এক মহিলা, পান খাচ্ছে আর তাকে ডাকছে।দুইদিন না খাওয়ার জন্য নীলা অনেক দূর্বল হয়ে পড়েছে। মহিলাটি নীলাকে তার বাসায় নিয়ে গেল। খাবার ও খেতে দিল।পরেরদিন সকালে নীলা অনেকটা ভাল বোধ করলো। মহিলাটি নীলাকে বেশ কয়েকদিন খুব যত্ন করলো। নীলাও তাকে তার মায়ের মত ভালবাসতে লাগলো।
কিন্তু এই ভালবাসা খুব বেশিদিন তার কপালে সইলো না। নতুন মা তাকে নিয়ে একটি যৌনপল্লী তে বিক্রি করে দিল।
সেখানে তাকে শিখানো হল কীভাবে খদ্দের কে খুশি করতে হয়। গায়ের রঙ কালো হওয়ার কারণে সবাই খদ্দের পেলেও তার ভাগ্যে সবার মত এত বেশি খদ্দের জোটে না। ফলে এখানেও তাকে অপয়া ডাকা হয়।তবে পরে আস্তে আস্তে সে এই পরিবেশের সাথে মিশে গেল। বছর পনেরো পর সে এই যৌনপল্লীর সর্দারনী হয়ে উঠলো।

নীলা নাম পরিবর্তন হয়ে সুন্দরী হল।এখন তার নিজের বড় একটি দল আছে। নতুন নতুন মেয়ে নিয়ে আসে এবং প্রশিক্ষণ দেয় তাদের কিভাবে কাজ করতে হয়। মাঝে মাঝে সুন্দরীর মাঝে পুরনো নীলাকে খুজে সে.......

লেখকঃ ফা‌হিমা আকতার, শিক্ষার্থী-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়