হাসনাবানু


Dhaka | Published: 2022-05-06 07:22:10 BdST | Updated: 2024-12-14 02:46:25 BdST

১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট।পৃথিবীর বুকে এক অদ্ভুত রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। যার নাম পাকিস্তান। নয়া এই রাষ্ট্রের পশ্চিম এবং পূর্বের মধ্যে ১২০০ মাইল ব্যাপী বিশাল রাষ্ট্র ভারত। অর্থাৎ রাষ্ট্রের দুই অংশের মধ্যে বিদ্যমান ভারতবর্ষ। নব্য পাকিস্তানের পূর্ব এবং পশ্চিমের মধ্যে রয়েছে ভাষা ও সংস্কৃতিগত বিস্তর পার্থক্য। এই দুই জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করেছে ধর্মীয় ঐক্য। যার ভিত্তি হচ্ছে মুসলিম জাতীয়তাবাদ। নতুন মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাজধানী অবস্থিত লাহোরে। ভাটি বাংলার মানুষ তাদের রাজধানীতে যেতে হলে পাড়ি দিতে হবে প্রতিবেশী ভারতকে। পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবস্থার পূর্বে এই পূর্ব পাকিস্তান ছিল- এক সময়ের সুবা বাংলা , যা অতীত কালে গঙ্গারিড্ডা রাজ্যের অর্ন্তভুক্ত ছিল। জনশ্রুতি রয়েছে গ্রিক দ্বিগবিজয়ী মহাবীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এই গঙ্গারিড্ডা রাজ্য আক্রমণ থেকে বিরত ছিলেন। কারণ গঙ্গারিড্ডা রাজ্যের সেনাবহরে তিন হাজার হাতির বিশাল পদাতিক বাহিনী ছিল। যা ঐ সময়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অস্ত্র। সময় সময়ের গতিতে চলতে থাকে। রাজা যায়, রাজা আসে কিন্তু ভূমির পুত্রগণ তাদের বৈশিষ্ট্য কখনো মুছে ফেলে না।
পূর্ব পাকিস্তানের একটি জনবহুল জেলা ত্রিপুরা। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মদিনে ত্রিপুরার এক নিভৃত পল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন একটি শিশু। শিশুটির জন্ম পাকিস্তানের জন্মদিনে হওয়ায় তাঁর দাদা নাম রাখেন মুহাম্মদ আলী। মুহাম্মদ আলীর মাতার তাতে দ্বিমত ছিল না। কারণ শৈশবে মা-বাবা হারানো হাসনাবানু তাঁর শ্বশুরকে বাবার মতোই শ্রদ্ধা করেন।
হাসনাবানুর আতঙ্ক শুধু তাঁর স্বামীকে নিয়ে। কারণ তাঁর স্বামী পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে জড়িত। হাসনাবানু পাকিস্তান রাষ্ট্র বুঝে না বা বুঝতে চায়ও না। তাঁর কাছে শ্বশুর,শাশুড়ি ,স্বামী এবং সন্তানেরাই রাষ্ট্র। তাদেরকে নিয়েই সে শান্তিতে থাকতে চায়। পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় অনেক জল গড়িয়ে যায়। সেই সাথে হাসনাবানুর মুহাম্মদ আলী বড় হতে থাকে।
একসময় মুহাম্মদ আলী মা-বাবা,দাদা,বুবু ইত্যাদি ডাকা শুরু করে। মাঝে মাঝে মিষ্টি মিষ্টি আরও ডাক দেয়। অনেক মায়াবী তার চাহনি। হাসনাবানুর সুখের সংসারে একটা সূক্ষ্ম ভয় আছে যা নিয়ে তিনি মাঝে মাঝে ভয়ে অস্থির হয়ে উঠেন। কিন্তু তা কাউকে বুঝতে দেন না। হাসনাবানুর ভয়ের কারণ তাঁর স্বামী রহমত আলীর রাজনীতি। রহমত আলী শেখ সাহেবের রাজনীতি করেন। শেখ সাহেব পাকিস্তান আন্দোলনের সময় তাদের বাড়িতে একবার এসেছিল। লম্বা ও চিকন গড়নের একজন সুঠাম দেহের পুরুষ,যার চোখে-মুখে রয়েছে তেজোদীপ্ত কিরণ। হাসনাবানু তাঁর স্বামীর কাছ থেকে শেখ সাহেবের অনেক গল্প শুনেছে। শেখ সাহেব ভালো বক্তৃতা করতে পারেন। এমন কথা প্রচলিত আছে যে, মানুষ বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে শেখ সাহেবের ভাষণ শুনে। মন্ত্রমুগ্ধ করা ভাষণ। যে ভাষণে ফুটে উঠে শোষণ আর বঞ্চনার ইতিহাস ,সাথে প্রেরণা দেয় নতুন করে স্বপ্ন দেখার। সেই স্বাধীনতার স্বপ্নের ফেরিওয়ালা শেখ সাহেব আজ হাসনাবানুর ঘরে। মুহাম্মদ আলীকে কোলে নিয়ে বলেন এ হচ্ছে আমাদের আলী, যে দেশকে আলীর তরবারির মতো শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করবে।
সময় বয়ে যায়,মুহাম্মদ আলীর বয়স বাড়তে থাকে মহাকালের নিয়মে। অন্যদিকে হাসনাবানু তাঁর সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকে। শতব্যস্ততার মধ্যেও মায়ের মন সব সময় সন্তানের জন্য ব্যাকুল থাকে। স্বামীর কাছে বায়না ধরেন ছেলেকে মাস্টার রেখে পড়ানোর জন্য। যুক্তি দিয়ে বলেন ,আমাদের তো একটাই ছেলে তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে অফিসার বানাতে চাই,যে মানুষের সেবা করবে। হাসনাবানুর স্বামী তাতে অমত নেই। তিনি ছেলের বাল্য শিক্ষার জন্য একজন গৃহ শিক্ষকের ব্যবস্থা করেন। কোরান পাঠের মাধ্যমে শুরু হয় মুহাম্মদ আলীর শিক্ষা জীবন। পারবারিক ভাবেই চলতে থাকে মুহাম্মদ আলীর শিক্ষা।
সময় টা ১৯৫২ সাল।ঢাকার রাস্তা উত্তাল, চারদিকে শুধু মিছিল আর মিছিল। শুধু একটাই কথা রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই। একদিন খবর আসে ঢাকা শহরে ছাত্রদের গুলি করে মেরে ফেলা হইছে। ভাষার জন্য দাবী করার কারণে তাদের এই পরিণতি। হাসনাবানুর মন খারাপ, ২মাস যাবত তাঁর স্বামীর খবর নাই,আগেতো চিঠিও আসতো ,এবার সেটাও নাই। একদিন তাদের গৃহ শিক্ষকের কাছ থেকে খবর জানতে পারে পত্রিকায় শেখ সাহেবের সাথে রহমত আলীর নাম এসেছে। ঢাকায় যে ভাষার জন্য আন্দোলন চলছে তা দমন করার জন্য তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই খবর শুনে হাসনাবানুর খাওয়া-দাওয়া বন্ধ, গভীর চিন্তায় মগ্ন তিনি, তাঁর আশংকা সত্যি হতে চলছে। শ্বশুরের সাথে পরামর্শ করে ঢাকার পথে রওয়ানা হয়েছেন। কিন্তু অচেনা এই শহর। খুব বেশি দিন তো হয়নি দেশ স্বাধীন হয়েছে। তাহলে কেন আবার এই জেল? কেন ভাষার জন্য আন্দোলন? এটা তাঁর বুঝে আসে না। সে বুঝবেই কেমন করে-কারণ তাঁর স্বামীকে রাজনীতি করতে বারণ করা সত্ত্বেও তিনি সেটা করেন। ভালো ভাবেই করেন। হাসনাবানুর মতে তাঁর স্বামী রাজনীতিকে ছেলে আর স্ত্রীর চেয়েও বেশি ভালোবাসেন।
পথে পথে অনেক কথাই মনে পড়ছে। শৈশবে মা-বাবা হারানো হাসনাবানুর সাথে রহমত আলীর প্রথম পরিচয়। অনেক সাহসী রহমত আলী রাজনীতি করলেও মেয়েদের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারতেন না। কথা বলার সময় আমতা আমতা করতেন। এটা নিয়ে পাড়ার সইদের সাথে কত হাসা-হাসি। একসময় রহমত আলী তাঁর ভালোলাগার কথা হাসনাবানুর চাচাকে জানায়। তখন হাসনাবানুর চাচা রহমত আলীকে বলেন আমাদের বানুর কপাল ভালো তোমার মতো একজন ভালো মানুষ পছন্দ করেছে।
সময় কত দ্রুত বয়ে যায়, মানুষগুলো বদলে যাই ,থেকে যায় শুধু স্মৃতি।
মুহাম্মদ আলী,হাসনাবানু এবং মাস্টার বাবু ২দিন পর ঢাকার কোর্টে এসে জানতে পারে রহমত আলীকে সিলেটের জেলে পাঠানো হয়েছে। যাবার সময় আইনজীবীর কাছে একটা চিঠি দিয়ে গেছেন।
মাবুদে ইলাহী
বাবা সালাম নিবেন।মায়ের স্বাস্থ্যের কী অবস্থা? হাসনাবানু এবং মুহাম্মদ আলীর প্রতি খেয়াল রাখবেন। আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। পাকিস্তান যেই ভাবে আদায় করেছি তেমনি আমরা ভাষার অধিকার আদায় করবো।
ইতি
আপনার রহমত আলী।
চিঠি নিয়েই বাড়ির পথে রওয়ানা দিলেন হাসনাবানু। তাদের আর দেখা হলো না।এই ভাবে দিন কেটে যায়, তিন মাস পর খবর আসে জেলে রহমত আলী মারা গেছেন। খবরটি যে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো, সবাই বুঝতে পারলেও কেউ সাহস করে হাসনাবানুর কাছে বলতে পারছে না।
কিন্তু নিয়তি বড় কঠিন। ভাগ্যের লিখন মেনে নিতে হবে। প্রত্যেক সৃষ্টিকে মৃত্যুর স্বাদ বরণ করতে হয়। হাসনাবানুর শ্বশুর চিঠি পড়ে পুত্র বঁধূর দিকে এগিয়ে দেয়, তখন নির্বিকার ভাবে চিঠি হাতে নিয়ে পড়তে থাকে হাসনাবানু।
হাসনাবানুর হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে। অল্প বয়সে মা-বাবাকে হারিয়েছে ,এখন স্বামীটাও নাই। কী দরকার ছিল রাজনীতির? মনে হাজারো প্রশ্ন জন্ম নিচ্ছে। মাগরিবের নামাজের পর গঞ্জের ঘাটে রহমত আলীর লাশ আসে।
সমগ্র গ্রাম জুড়ে নীরবতা। কারো মুখে শব্দ নেই। মসজিদের ইমাম এসেছেন। কবর খননের আয়োজনের জন্য তদারকি করে যাচ্ছে। এশার নামাজের পর জানাজা।পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী বস্তু পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ। এই কষ্ট রহমত আলীর বাবা সালিম আলী বুঝতে পারছে কিন্তু ব্যথা বোঝানোর ভাষা নেই।
ছোট মুহাম্মদ আলী বারবার মায়ের চোখের পানি মুছে দিচ্ছে। আর বলছে বাবা সাদা চাদর গায়ে ঘুমিয়ে আছে, তুমি কাঁদছো কেন মা ? মুহাম্মদ আলীর এই সহজ কথায় হাসনাবানু ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নেয়।
হাসনাবানুর জীবনে মেঘের পর মেঘ আসে।
এশার নামাজের পর রহমত আলীর দাফন সম্পন্ন হয়। চিরদিনের মতো বিদায় নিয়ে চলে যায় না ফেরার দেশে।
তখন মুহাম্মদ আলী বুঝতে পারে তাঁর বাবা আর ঘুম থেকে উঠবে না।
মানুষের বিপদ যতোই কঠিন হোক না কেন ,প্রকৃতি তাকে মানিয়ে নিতে সাহসী করে তুলে।
ঘড়ির কাঁটা তার পথ চলতে থাকে। ছোট মুহাম্মদ আলী তাঁর দাদার হাত ধরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ভর্তির সময় বাবার নামের স্থানে লিখে মৃত রহমত আলী। যিনি ইতোমধ্যে সংগ্রামী রহমত আলী নামে পরিচিত হয়ে গেছেন। কেঊ কেঊ বলে শহিদ। কারণ মানুষের অধিকারের জন্য কথা বলতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। কোনটা আসলে ঠিক? ইতিহাস তা নির্ধারণ করবে। যদিও রাষ্ট্র তাদেরকে বিদ্রোহী বলছে।
মুহাম্মদ আলীর মেধার পরিচয় তাঁর বাল্যকালে প্রকাশ পায়।সফলতার সহিত সে প্রাইমারী শেষ করে মাধ্যমিক পাশ করে। উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকা চলে আসে। গ্রামে রেখে আসে দাদা ,দাদী আর তাঁর মাকে।
কলেজের বিভিন্ন গল্প করে মায়ের সাথে। যখনই মিছিলের গল্প করে তখন তাঁর মা অন্যরকম হয়ে যায়। এটা মুহাম্মদ আলী বুঝতে পেরে গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। একসময় মুহাম্মদ আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।
সময়টা তখন ১৯৬৯ সাল। চারদিকে মিছিল আর মিছিল। শুধু একটাই শব্দ “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো”।
মুহাম্মদ আলীর ছোট কালের উপাধির কথা মনে পড়ে যায়, যা তার দাদা বলেছিল।শেখ সাহেবের তাদের বাড়িতে আগমন, তাঁর বাবার পাকিস্তান রাজনীতি, ভাষার সংগ্রাম এবং জেলের মধ্যে মৃত্যু। মুহূর্ত্যের মধ্যে মুহম্মদ আলীর চোখ ভিজে যায়, কারণ তাঁর বাবার সাথে কোন স্মৃতি নেই যা আছে তা হলো তাঁর বাবার কিছু গুণ।
আর জিনগত ভাবেই পিতার মানবিকতার গুণ আছে তাঁর ক্রমোজোমে। চাইলেও সে মানুষের জন্য কাজ না করে থাকতে পারে না।এটাই তাকে শান্তি দেয়। তাদের গ্রামের প্রথম সন্তান হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় মুহম্মদ আলী। পর্দাথ বিজ্ঞান বিভাগের আবুল কাসেম স্যারকে কোন এক অজানা কারণে ভালো লাগে মুহাম্মদ আলীর।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়দফা নিয়ে আলোচনা হয়, এখন দাবি একটাই শেখ সাহেবের মুক্তি। তবে এটা অবশ্যই নিঃশর্ত হতে হবে।
এই ভাবে দিন চলতে থাকে , বাড়ি থেকে মায়ের চিঠি এসেছে, দাদার শরীর খারাপ , বাড়ি যাবার জন্য বলছে। কিন্তু এই দিকে শহরের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। মিলিটারি ছাত্রদের উপর হামলা করছে ,নির্বিচারে মানুষ মারছে। কিন্তু বীর বাঙালির তাতে আরও মনোবল বাড়াচ্ছে। বুকের রক্ত দিয়ে তাঁরা তাদের নেতার মুক্তির রাস্তা নির্মাণ করছে। অবশেষে শেখ সাহেবের মুক্তি দিয়েছে পাক সরকার।
এবার তাহলে বাড়ি যাওয়া যায়। মায়ের সাথে অনেক গল্প করা যাবে ,তবে মিছিলের গল্প নয়। এবার ক্লাসের কুসুমরাণীর গল্প করবো। যাকে তাঁর ভালো লাগে। কুসুমরাণী দেখতে মায়াবী,তাঁর চোখ জোড়া হরিণের মতো, চুল যেন শ্রাবণের কালো মেঘ যেখানে বিজলীর মতো ঝলক হচ্ছে মাথার সিঁথি , তাঁর নাক কখনো মনে হবে চৈনিক বা ইরানিদের মতো,তবে এটা একটা ধাঁধা মনে হয়। কুসুমরাণী কখনো শান্ত বালিকার মতো , আবার কখনো সে চঞ্চল। কিন্তু সে কুসুমরাণী পর্দাথবিজ্ঞানের সূত্র গুলো তাঁর মাথায় গেঁথে নিতে পারে অবলীলায়। মাদাম কুরীর সাথে কুসুমরাণীর চমৎকার একটা মিল রয়েছে ,সেটা হচ্ছে মাদামকুরী যেমন সব সময় সাথে ইউরোনিয়াম রাখতেন ,তেমনি কুসুমরাণী সাথে সবসময় বই রাখে। রাত্রেও নাকি বই সাথে নিয়ে ঘুমাতে যায়।
এই শান্ত কিন্তু চঞ্চল কুসুমরাণীর জন্য কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে কিন্তু পর্দাথবিজ্ঞানের ক্লাস আর ল্যাবের যন্ত্রণা, সাথে মিছিলের রোমাঞ্চকর আহবান সব কিছু ভুলে যেতে বাধ্য করে, তবে মিছিলের মধ্যে কুসুমরাণীর ছবি আমার মনের জোর বাড়িয়ে তুলে। সেটা একটা অদ্ভুত অনুভূতি। আর এই অনুভূতিটাই হচ্ছে মস্তিষ্কের বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার খেলা। যাকে প্রেম বলা যায়। এইতো বাড়ি আসার আগেরদিন সকালে কুসুমরাণী মায়ের জন্য একটা শাড়ি নিয়ে এসেছিল , আর বলছে আমি দিয়েছি এটা বলবে না। কুসুমরাণীর মায়ার বন্ধনে হয়তো আমি আটকে গেছি। কী এমন শক্তি আছে এই মেয়ের চাহনিতে?
এই বার বাড়ি এসে দেখি এলাহি সব কান্ড, মা কতো কিছু আয়োজন করেছে। একের পর এক খাওয়া। মনে হয় যেন খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। তবে আমার মায়ের কাছে যখন ভার্সিটির ডালের কথা বলছি তখন বলে সেটা তো ডাল নয় রে আলি, সেটা হলো পানি। আর এই ডালের পানি খেয়েই তোর মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে,কেমন রোগা হয়ে গেছিস। ভালো করে খা। খেতে খেতে মায়ের সাথে গল্প করে কখন যে রাত্রি ঘনিয়ে এলো টের পেলাম না। এশার নামাজের পর দাদার সাথে দেখা। দাদা শেখ সাহেব, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি নিয়ে আলাপ করলেন। আর মিছিলে যেতে বারণ করেছেন। এই প্রথম দাদা এমন বারণ করলেন। বুঝতে পেরেছি এটা মায়ের পরিকল্পনার অংশ।আমার মায়ের জীবনে অনেক মেঘ বয়ে গেছে।তাই উনার ভয় বেশি। এবার কুসুমরাণীর শাড়িটা দিয়েছি আর ছবি দেখিয়েছি। মায়ের কাছে কুমুসরাণীর নাককে ইরানি মনে হয়েছে। সত্যি এটা অনেক অবাক করা বিষয়,যা আমি ৩ বছর ধরে সমাধান করতে পারনি, আমার মা এক নিমিষেই করে দিলেন।
কিন্তু মায়ের কাছে সময় দ্রুত শেষ হয়ে যায়। এবার ঢাকা ফিরতে হবে। তবে তার পূর্বে গ্রামে আমার কিছু বাল্য বন্ধুদের সাথে ঢাকার সার্বিক অবস্থার বিবরণ দিতে হবে। মাস্টার মশাইয়ের সাথে দেখা করতে হবে। মাস্টার মশাইয়ের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে যারা ঢাকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গ্রামের মানুষের সাথে আলোচনা করে। কমিটির সদস্যের সাথে আলাপ করে তাদের মনোভাব বুঝতে পেরেছি। সবার একটাই দাবি সেটা হচ্ছে স্বাধীনতা।
এরই মধ্যে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে।
কিন্তু ১৯৭০ সালে ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে পূর্ব বাংলায় লক্ষ লক্ষ মানুষ সাগরের নীল জলে হারিয়ে গেছেন। সমগ্র বাংলা যেন একটা মহাশ্মশানে পরিণত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষ থেকে ত্রাণ নিয়ে ছুটতে হচ্ছে পটুয়াখালির দিকে। ১০ দিন কাজ করে ঢাকায় ফিরে আসি। এরই মধ্যে মায়ের চিঠি। বাড়িতে যাবার জন্য বলছে। মা-কে কেমন করে বোঝাই ঢাকার অবস্থা ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে। তারপর উত্তরে লিখেছি একদিনের জন্য আসবো।
কিন্তু এরই মধ্যে ৭ই মার্চ শেখ সাহেব ভাষণ দিলেন। নির্বাচনে জয় লাভ করার পরও পশ্চিমারা ক্ষমতা বদল করবে না। চতুর ভুট্টো তাঁর চাল চেলে যাচ্ছে কিন্তু হাটুর নিচের বুদ্ধি সম্পূর্ণ প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া তা মেনে নিচ্ছেন।
বাড়িতে গিয়ে মায়ের সাথে দেখা করার ইচ্ছে করছে ,কিন্তু ভাষণের পর পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। প্রতিদিনই বাঙালি-মিলিটারি সংঘর্ষে মানুষ মারা যাচ্ছে। সবার দাবি একটাই স্বাধীনতা। অবশেষে সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২৫ মার্চ রাত্রে নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে হানাদার পাক বাহিনী।
বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারি বাজার, তাঁতি বাজার ,ফার্মগেট ,রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমন করে। নিহত হয় ৫০ হাজার মানুষ। জ্বীবন্ত একটি শহরকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে।
শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। তাঁকে পাক বাহিনী এরেস্ট করেছে। কিন্তু কোথায় রেখেছে সেটা নিশ্চিত নয়।
হানাদার বাহিনী ঢাকা শহর সহ সকল বিভাগীয় শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। চারদিকে শুধু আতঙ্ক আর মৃত্যুর খেলা।
আমার বারবার শুধু মায়ের কথা মনে পড়ছে। দাদা-দাদি কেমন আছেন? মাস্টার মশাই, গ্রামের কমিটি তাদের কি অবস্থা তা চিন্তা করে কূল-কিনারা পাই না। আর কুমুসরাণীর সাথে দেখা নাই। সে কেমন আছে ?
যদি বেঁচে থাকি তাহলে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিব। কি সব উদ্ভট চিন্তা। এখন সময় দেশের জন্য । পাকিস্তানিদের বিদায় করতে হবে। তারপর কুসুমরাণীকে বিয়ে করবো।
কুসুমরাণী তার পরিবারের সাথে খুলনার গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। চলে যাবার সময় চিঠি লিখে গেছে।
প্রিয় আলী,
মিছিলে যখন যেতে তখন ভয় পেতাম, এখন আর ভয় নেই,ভয় মরে গেছে।অগনিত মানুষের মৃত্যু নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। স্বাধীন করে ফিরে আয়। গ্রামে চলে চাচ্ছি। আমার বড় ভাই ২৫ই মার্চ রাত্রের পর বাসায় ফিরেনি। বাবা-মা অসুস্থ। আমি তোর অপেক্ষায় আছি।
এরই মধ্যে ১৭ই এপ্রিল সরকার গঠন করেছে। আমি ছদ্মবেশে শহর ত্যাগ করেছি। সাথে আছে কুসুমরাণীর চিঠি।
বাড়িতে গিয়ে মায়ের মলিন মুখ দেখে মনে হয়েছে মায়ের বয়স অনেক বেড়ে গেছে।
দাদা-দাদি অসুস্থ। আমাদের বাড়িতে বিভিন্ন মানুষের আনাগোনা। মায়ের সর্তকতা। আমি যেন বাড়ি থেকে বের না হই। সব সময় কান্না-কাটি করে। একদিন একটা ঘটনা ঘটলো, গ্রামের মেয়েদের ধরে ধরে পাক বাহিনীর হাতে তুলে দিচ্ছে এই ভয়ে এক পরিবার আশ্রয় নিল আমাদের বাড়িতে। তাদের গ্রামের ৫জন মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে। এই ঘটনার পর মায়ের মনের পরিবর্তন ঘটে। শেখ সাহেবের খবর জানতে চায়, যুদ্ধের খবর জানতে চায়।
আমি ইতোমধ্যে মাস্টারের কমিটির সাথে আলাপ করে একটি দলকে বর্ডারের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছি। সময় বয়ে যায়। একদিন গ্রামের গঞ্জে পাক বাহিনীর লঞ্চ আসে। তাদের কাছে আমার নামের তালিকা আছে এমন খবর সারা গ্রামে ছড়িয়ে পরে।
বর্ষাকাল শুরু হয়েছে। চারদিকে পানি আর পানি।আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে বর্ডারের দিকে আশ্রয় নিয়েছি।
চলে আসার পর পাক বাহিনী আমাদের বাড়িতে গিয়ে দাদাকে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরে মসজিদের ইমাম উর্দুতে কথা বলে দাদাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। এই দিকে গ্রামের মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে পাক বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার কাজ শুরু করি। জুলাই মাসের দিকে আমাদের টিম পাক বাহিনীর আস্তানায় আক্রমণ করে। এতে তাদের হতাহত হয় অনেক। তখন থেকে পাগলের মতো হন্য হয়ে খুঁজতে শুরু করে ,পাশাপাশি আমার নামে পোস্টার বিতরণ করতে থাকে। বাড়িতে প্রতিদিন তাদের টহল চলতে থাকে।
এবার আমরা আর ব্যাপক পরিসরে আক্রমণ করি।এতে আমাদের দলের অনেক হতাহত হয় কিন্তু আমি আটকে পরি তাদের হাতে , তবে তার আগেই আলফা অপারেশনের তথ্য ও মালামাল পৌঁছে দেই।অপারেশন আলফা সফল হলে ঢাকা শহরে তাদের কোমড় ভেঙে যাবে।
পাক বাহিনীর নানা অত্যাচার নেমে আসে আমার উপর। কখনো অন্ধকার ঘরে, কখনো আলোতে আটকে রাখে। খবর পেয়ে মা,দাদা ছুটে আসে। শত শত অনুরোধ করা হয়। কিন্তু পাষাণের হৃদয় বলে কিছু নেই।
আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। কোন তথ্য দেওয়া যাবে না। যেকোনো মূল্যে অপারেশন আলফা সফল করতেই হবে। মাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে , আর কুসুমরাণীর কথা ভেবে ভেবে শক্তি পাই।
এবার আমাকে গোমতী নদীর তীরে নিয়ে যাওয়া হয়। পাকিস্তানি মেজর শত চেষ্ঠা করে, কোন তথ্য বের করতে না পেরে,আমাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আমি শান্ত স্থির হয়ে আছি।
মেজর আমাকে সর্বশেষ প্রস্তাব দেয়। যদি তাদেরকে সাহায্য করি তাহলে আমাকে ছেড়ে দিবে।মায়ের কাছে,দাদার কাছে ফিরতে পারবো। কিন্তু আমি বলি জয় বাংলা। পাকিস্তানি মেজরের প্রস্তাবে আমার জবাব,
এই বাংলায় আমার জন্ম, এই বাংলায় আমার মৃত্যু হবে। আমার বাবা ভাষার জন্য শহিদ। আমি হবো রাষ্ট্রের জন্য। জয় বাংলা। গুলির শব্দ......
চারদিকে নীরবতা।
বিকালের দিকে হাসনাবানু এবং মাস্টার মিলে মুহাম্মদ আলীর নিথর দেহ বাড়িতে নিয়ে আসে। হানাদার বাহিনী মুহাম্মদ আলীর শরীর ক্ষত বিক্ষত করে।
মহান এই বীরের মৃত্যুতে এবার হাসনাবানুর হৃদয় পাথরের চেয়েও শক্ত হয়ে গেছে। কারণ তাঁর আদরের মুহাম্মদ আলী ,আলীর মতো রাষ্ট্রকে রক্ষা করেছে। ভাষার জন্য তাঁর স্বামী জীবন দিয়েছিল, এবার দেশের জন্য তাঁর ছেলে শহিদ হয়েছে। বৃদ্ধ দাদা তাঁর বীর নাতির নামাজের জানাযার ইমামতি করেছেন। বাবার পাশে সমাহিত করা হয়েছে বীর বাবার বীর সন্তানকে।

মোঃমেহেদী হাসান
প্রভাষক (রসায়ন বিভাগ)
৩৬তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা)
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ।