ছবিটি সংগৃহীত
বাবা কৃষক! টানা পোড়ার সংসারে মেট্রিকের গন্ডি পার হতে বার কয়েক হোচট খেতে হয়েছে আমার! আমার সাথের সবাই যখন ৯ম শ্রেণীর শুরু থেকেই গণিত, ইংরেজী আর হিসাব বিজ্ঞান প্রাইভেট পড়া নিয়ে ব্যস্ত, তখন আমি আমার বাবার সাথে বর্গা নেয়া ধান ক্ষেতে কাজ করি! তখন সবেমাত্র সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হয়েছে! সবাই যখন টেক্সট বুকের পাশাপাশি কয়েকটা রাইটারের লেখা গাইড কিনে পড়তে শুরু করেছে, তখন আমার টেক্সট বুক পর্যন্ত কেনা হয়নি! সামর্থ নেই! অথচ আমার বন্ধুরা লেকচার, পাঞ্জেরী সহ কয়েক সিরিজের গাইড কিনে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে! বন্ধুদের থেকে ধার করা বই পড়ে পরীক্ষা দিয়েছি প্রথম সাময়িকের! পরীক্ষা খুব একটা ভালো হয়নি! অন্যের জমিতে কাজ করে ২য় সাময়িকের আগে টেক্সট বুক গুলো কিনে নিলাম! সবাই যখন নিয়মিত ক্সুলের ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত, তখন আমি? হা হা হা! আমি আর কি করবো? থাক! কাজের ফাঁকে ফাঁকে স্কুলে যেতাম! স্যার আমাকে স্কুলে না আসার কারণ জানতে চাইতেন! আমি এই সেই বলে নিজেকে আঁড়াল করতাম কোনোরকম! ছাত্রও খুব ভালো ছিলামনা! নির্বাক গর্দভের মতো দাঁড়িয়ে স্যারের সকল ইনসাল্ট আর ক্লাস ম্যাটদের হাসি ঠাট্টা বরণ করে নিতাম! চোখের জল চোখেই শুকিয়ে নিয়ে অপরাধীর মতো পেছনের বেঞ্চ টাতে গিয়ে বসে পড়তাম! এভাবেই দিন যায়, মাস আসে, সময়ের গতি পাল্টায়, শুধু আমিই পারিনি আমাকে পাল্টাতে! গ্রামের এক দুঃসম্পর্কের বড় ভাইয়ের সহযোগীতায় টেস্ট পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকলাম! মায়ের আদরে পালা ছাগলটি বিক্রি করে দিয়ে এসএসসি'র ফর্ম ফিলাপ করলাম! ছোট বেলা থেকে স্বভাবগত ভাবেই কারো কাছে ছোট হতে পারতামনা! বাবার শিক্ষা! তাই কোনো টিচারকে আমার সমস্যার কথাও বলতে পারিনি মুখ ফোটিয়ে! এভাবেই শেষ হলো এসএসসি! রেজাল্ট ৪.৫০! আমাকে লেখা পড়া করানো বাবার পক্ষে সম্ভব নয়, তা আমি ঢের পূর্বেই বুঝেছিলাম! পাশের ঘরের কাকী, কত কিছুই না আমাকে বলতেন!
-বটে রে! সকাল বেলা পান্তার নুন আমি দিই, আর নবাব করে লেখা পড়া! ইত্যাদি, ইত্যাদি!
কারোর আপন কাকী এমন আচরণ করতে পারে তার সহোদর ভাতিজার সাথে, জানা ছিলোনা আমার! খোঁটা সহ্য করতে না পেরে মাকে বললাম, চাচার ঘর থেকে কিছু আনবানা আর! মা বললেন,
-বাবারে, তর চাচী তো দেয়! আর কেউ তো দেয়না! কথা না হয়য় ইকটু বলবেই! এগুলি ধরিসনা বাপ!
মায়ের টলটলে চোখ তখন আমাকে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলো! সেদিন সন্ধ্যায় চাচার নার্সারীতে আমাদের ছাগলটা কিভাবে যেন ঢুকে যায়! খুব একটা নষ্ট করেনি! মা সাথে সাথেই বেধে ফেলেছিলেন! এটাকে ইস্যু করে আমার চাচী যাচ্ছে তাই বকে গেছেন! মা টু শব্দটুকুও করেনি! ঘরে এসে কেঁদেছেন অনেক! ছোটটার কাছে সব শুনতে পেরে পর দিনই আমি ছাগলটা বিক্রি করে দিই! এদিকে বাবার ঋণ, সময় মতো সুদ দিতে না পারায় কড়া গলায় শাসিয়ে গিয়েছে কালাচাঁন বেপারী! টিওশানীর টাকায় ইন্টার পর্যন্ত যেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে আমায়! বাবা ও এখন আগের মতো কাজ করতে পারেন না! বুকব্যাথা! টিওশানীর জমানো কিছু টাকা দিয়ে ওনাকে ডাক্তার দেখিয়েছি! ঔষধ কেনার মতো টাকাটা পর্যন্ত পকেটে ছিলোনা! এভাবে ওভাবে ম্যানেজ করেছি! এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করে একদিন বাবাকে বললাম,
-ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য কোচিং করা দরকার! তোমরা অনুমতি দিলে আমি ঢাকায় রওনা হবো!
-টেহা? এত টেহা কই পাইবিরে বাজান?
আমি শুধু বললাম,
-তোমরা দোয়া কইরো! সব ম্যানেজ হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ্!
আর ঐদিকে আমার চাচী পুরো এলাকা জুড়ে ঢোল পেটালেন,
"অসুস্হ বাপরে ঘরে ফালায়া কেমনে ছ্যারা ঢাহা যা? কিমুন বাপের কিমুন পুত? থু, ইত্যাদি ইত্যাদি!"
সেদিনই প্রথমবার আমার মা ওনার কাউন্টারে গিয়েছিলেন! বললেন,
-আমার পুত কই যাইবো না যাইবো হেইডা আমি বুঝমু! আপনের অত্ত মাথা ধরা কেন?
প্রতিউত্তর হিসেবে মাকে অকথ্য ওয়াজ শুনতে হয়েছিলো সেদিন! আর খোঁটা তো আছেই! সেটা না হয় না ই বললাম! ফেরার পথে মা তার ছেলেকে তার সোনার নাকফুল খানি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
-আমার বিয়ের শেষচিহ্ন টুকু তরে দিলাম বাজান! এটা বেইচ্চা দিয়া ঢাহা যা! আর যদি পারিস, তর এই বাপরে মাঝে মাঝে দেখতে আইস!
সেদিন বাবা খুব করে কেঁদেছিলেন! মায়ের শেষ শোভা টুকু ও আজ শেষ হতে চললো! আমি মায়ের নূলক না নেয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি! কিন্তু পারিনি! সিদ্ধান্ত পাল্টালাম! পাল্টাতে বাধ্য হলাম! মনস্হীর করলাম, সামনে এগুতে আজ যদি ছোট হতে হয়, সংকোচ করবোনা! দেয়ালে পিঠ ঠেকে আছে! চাচা বড় অফিসার! ঢাকায় আসার কথা জানালে, এক রকম নিরুৎসাহিত ই করেন আমায়! কাজ হবেনা বুঝতে আর বাকী ছিলোনা! নিয়তি সেদিনও আমার পক্ষেই ছিলেন! ঘটনার একাংশ শুনা মাত্রই স্যার আমাকে অভয় দিলেন! আমার চরম দুঃসময়ে শ্রদ্ধেয় শাহাদাৎ স্যার আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন! ঢাকায় এনেছেন! খাবারের খরচ যোগিয়েছেন! মায়ের পেটের কোনো বড় ভাই নেই আমার, ওনি ছিলেন বলে কখনো অভাব ও বোধ করিনি! কখনো বাবার মতো শাসন করেছেন! কখনো ভাইয়ের স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়েছেন! নিজের খাবারটুকু পর্যন্ত আমার সাথে শেয়ার করেছেন! ওনার অপরিশোধিত সেই ঋণের বকেয়া আজও শোধ করিনি! সম্ভবও নয়! মায়ের সোনার নূলক বিক্রি করে ঢাকা আসলাম! এবার কোচিং এ ভর্তি হওয়া দরকার! ১২ হাজারের মতো টাকা লাগবে ভর্তি হতে, বই খাতা তো আছেই! এতগুলি টাকা এই মুহুর্তে...! স্যারকে কিছুই জানালামনা! ওনি যা করেছেন তা আজকের যুগে কোনো সহোদর ও করেনা! ওনাকে না জানিয়েই, সাদা কাগজে একটা ফ্রি এডমিশনের এপ্লিকেশন লিখে রাজধানীর নামকরা এক এডমিশন কোচিং এর অফিসে গেলাম! কে শুনে কার কথা! অথারিটি আমাকে ফ্রড মনে করে ফিরিয়ে দিয়েছে! এটা অস্বাভাবিক কিছু না! শহরে ফ্রড শরনার্থীর তো আর অভাব নেই! তাই, আসল চেনা দুষ্কর! ফার্মগেটের ব্যস্ত ওভার ব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে নিজের অন্ধকার ভবিষ্যৎ উপলব্ধি করে খুব কাদলাম! পীচ ঢালা সেই কালো জায়গাটি আমার চোখের গরম জলে একাকার হয়ে গেছে কয়েক মিনিটে! আকাশের সজোর গর্জন শুনে সেদিন মনে হয়েছে, আমার আর্তনাদ বুঝি আকাশ আমার হয়ে জানান দিচ্ছে! চোখের পানি ঢেলে দিয়েছি সব! মুখ-চোখ ফুলে একাকার হয়ে আছে আমার! সালাতুল হাজতের ২ রাকাত নফল নামাজ আদায় করে আকাশপতির দোয়ারে সিজদায় গিয়ে বললাম,
-এত মানুষকে খাওয়ায়া রাখস তুই, এতগুলি মানুষের ভরণ পোষণ করস, আমি কি তাদের একজন হইতে পারি নারে, খোদা? কত বড় বেইনসাফ তুই? আজ তর ইনসাফ পরীক্ষার সময় এসে গেছে! যদি বাড়িতেই ফেরত পাঠাস, তবে কাফন মুড়িয়ে পাঠিয়ে দিস! নয়তো অবাধ্য সন্তানের মতোই তর সাথে শুরু হবে আমার নতুন আচরণ!
মনের কষ্টে কথাগুলো বলতে বলতে খোদার কেবলা ভিজিয়েছিলাম সেদিন! রাগ ঝাড়ার মতো কেউ ছিলোনা সেদিন! খোদা ও আমাকে নিরাশ করেননি! সেদিনের পর থেকে আমার পকেট একটি বারের জন্যও খালি হয়নি আজ অবধি পর্যন্ত! ফার্মগেট ওভার ব্রিজের নিচে সেই জায়গাটিতে এখনো আমি মাঝে মাঝেই যাই! স্মৃতির বৃষ্টিতে আজও ভিজে একাকার সেই অচেনা পথ! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া প্রায় শেষের দিকে আমার! মাস্টার্স চলছে! এর মধ্যে টিওশানীর জমানো টাকা দিয়ে বাবার দেনার শেষ অংশ পরিশোধের চেষ্টা করছি! ইনশাআল্লাহ্ শেষ হবে, আমি বিশ্বাস করি! হত দরিদ্র অনেক ছেলে মেয়েকে আজ অল্প করে হলেও কিছু দিতে পারছি! ছোট গুলির মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্ঠা করেছি! পারিনি শুধু, আমার মায়ের সোনালী সেই নূলক টুকু ফিরিয়ে দিতে...
লেখাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার থেকে নেয়া
এমএসএল
Boro Chele | বড় ছেলে | Telefilm | Apurba | Mehjabin | রিভিও | Bangla New EID Natok 2017। Review