ফাগুনের কবিতায় তোমার পদচিহ্ন


রকিবুল ইসলাম ঐতিহ্য | Published: 2019-02-19 04:18:26 BdST | Updated: 2024-05-21 02:41:58 BdST

আলোর অন্তহীন পানে ছুটে চলতাম আমরা। দুজন প্রবল স্বতন্ত্র।
স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে সমবেত কন্ঠে জাতীয় সংগীত শেষ হওয়ার পূর্বাপর সময়ে আমাদের প্রথম দেখা।
তারপর বহুবার, বারংবার ভুরু কুঁচকানো কাজলা আঁখিযুগলের সাথে পরিচয় হয়েছিল।
ফাল্গুনের আগমনী গানে আমাদের কথা হয়েছিল। বেনি চুলে সাদা-রয়েল ব্লু ইউনিফর্ম, সাথে তোমার প্রজাপতি খেলা করা মুচকি হাসি।
দোলন-চাঁপার মতন চিকন উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের মুখখানি আজও সেদিনের মতই স্পষ্ট। সুগভীর।

আমি থাকতাম ছাত্রাবাসে। আর তুমি স্থানীয় হওয়ায় সঙ্গত কারনেই মনে হত তোমার দেশে অচিন পরবাসী। জেলা শহর গুলোতে ঠুনকো অহংকারে বেঁচে থাকা মানুষদের যা হয় আর কি!
বন্ধুদের কাছে শোনা, তোমার পরিবারের প্রতিপত্তি আর ভাইয়ের মাস্তানি ছিল নাকি প্রবাদপ্রতিম!
আমার কাছে আবার তোমার সেই চিরচেনা মুচকি হাসিই এসবের চেয়ে বেশি শক্তিশালী মনে হয়েছিল!

তারপর,
রিক্সার হুড উঠিয়ে নিস্পলক তোমার পিছু পিছু চলা ক্লান্তিহীন বাইসাইকেল আরোহী আমি কত পথ পেরিয়েছি? মিউনিসিপালের পিচঢালা পথ সে খবর রেখেছে নিশ্চই!
ক্লাসের ফাঁকে। টিফিনে। ছুটির ঘণ্টায় আমাদের দেখা হত। খানিকটা মুচকি হাসির বিনিময় হত। কখনো তোমার বান্ধবীদের সাথে আহ্লাদিপনায়, কখনো আবার টার্ম পরীক্ষা চালাকালীন সিরিয়াস মুহুর্তে, কখনো পাতা ঝরা বসন্তের পশ্চিমের হাওয়ায় আমাদের বয়ে চলা সময়।
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে আমরা যখন নতুন জীবনের উন্মুক্ততায় দিশেহারা। যখন আমরা জীবনের প্রয়োজনে ছুটছি অবিরাম। সেই সময়টা তে আমরা আলাদা হয়ে গেলাম।
স্কুলের সেই অ্যাসেম্বলি। তোমার বেনি চুল। সাদা-রয়েল ব্লু ইউনিফর্ম। ফাল্গুনের পাতা ঝড়া দুপুর। ছুটির ঘন্টা।
আর আমার অভ্যাসে পরিণত হওয়া তোমার চিরচেনা মুচকি হাসিতে ছন্দপতন ঘটল।
এমন না যে আমাদের মামুলি ফাগুনের সময়টাতে তুমুল প্রেম ছিল। আবার হতে পারে সেটা ছিল টিন এজার ভালোলাগা আর ভালোবাসার মধ্যবিরতি কোন একটা স্টেশন!

তারপর দেখা হত খুব কম। তোমার মহিলা কলেজে প্রবেশ ছিল সংরক্ষিত। মাঝে মাঝে দেখা হত চলন্ত রিক্সায়। কখনোবা বিকেলে তোমার প্রাইভেট টিউশন শেষে বাবার বাইকে। তুমিও আমাকে দেখতে। তোমার নির্নিমেষ চোখ কিছুটা উদাস। কিছুটা গভীর গাম্ভীর্যে পূর্ণ।
একদিন কে যেন এসে খবর দিল তোমার নাকি বিয়ে! আমি ভাবলাম নিছক কোন মশকরা। কিন্তু না। সত্যি সত্যি তোমার বিয়ে হয়ে গেল। খরব নিলাম,
ছেলে বুনিয়াদি ব্যবসায়ী। তোমার রাঙা মেহেদি হাত। লাল টুকটুকে বউ। এসব এখনকার ডিজিটাল জামানার মত ফেসবুক কিংবা ইন্সট্রাগ্রামে দেখা হয় নি। মনের নীল বেদনার ফেসবুকে সাজিয়ে নিয়েছিলাম। প্রতিটি ছবি। প্রতিটা দৃশ্য। তারপর কত বিষণ্ণ অমাবস্যা-চন্দ্রিমার রাত কেটে গেছে। সে সব আমার অন্তর্যামী জানে।

দিন চলে গেছে। বছর পেরিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন জীবনের আস্বাদনে ডুবে আছি। ক্লাস। পরীক্ষা। টিউটোরিয়াল। আড্ডা। গান। হরেক রকমফের জীবনের নব দিগন্ত।
বয়ে চলা সময়ে একদিন আমার মুঠোফোনে তোমার কন্ঠ। ওপাশ থেকে 'হ্যালো' বলতেই শুধু কান্নার শব্দ। তারপর অনেকক্ষণ আমরা দুজনই নিশ্চুপ। অবশেষ নিরাবতা ভেঙে শুনালে, তোমার অভিমানের সংসার। তোমার মেয়ের বেনি চুল বাঁধার গল্প। তোমার স্বামীর পরনারী আসক্তি। ইট, কাঠ আর কংক্রিটের বাড়িতে একঘেয়েমি জীবন। রবীন্দ্রনাথের 'হঠাৎ দেখা' কবিতার মতই আমাদের শেষ আলাপন।
মুঠোফোন রেখে আকাশের দিকে তাকালাম। সেই চিরচেনা ফাগুনের নীল আকাশ।
মনে হল বুদ্ধদেব বসুর কবিতার মত আমি এখনো আছি। সেই দু'হাজার পাঁচ কি ছয়। সেই জেলা শহরে। মিউনিসিপাল সড়কের মোড়ে।
স্কুলের অ্যাসেম্বলি। ছুটির ঘণ্টায় বেনি দুলিয়ে তোমার হেটে যাওয়া।
সব আজ স্বপ্নের মতো। সেই মেঘে ঢাকা সকাল।
সেই দুপুর। সেই বৃষ্টি।
সেই রৌদ্রজ্জ্বলের মত মুচকি হাসি।
সে-ই তুমি।
প্রিয় অনামিকা, আমি ছাড়া তোমাকে আর কে মনে রেখেছে!

লেখক: রকিবুল ইসলাম ঐতিহ্য
এম.ফিল শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।