লক্ষ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মাদ্রাসার তাঁরা


টাইমস অনলাইনঃ | Published: 2018-03-24 05:45:48 BdST | Updated: 2024-05-08 22:18:39 BdST

মাদরাসাপড়ুয়া প্রথম মেয়ে হিসেবে কাছিরা সুলতানা চামেলী পেয়েছে স্কাউটের সর্বোচ্চ সম্মান প্রেসিডেন্টস অ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়া তার আছে আরো শত শত অর্জন। 

‘জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা-২০০৮’ চলছে। ‘ক’ গ্রুপের প্রতিযোগীরা এবং তাদের সঙ্গে আসা লোকজন একটা কামরায় অপেক্ষা করছিল। একপর্যায়ে ঘোষণা দেওয়া হলো অংশগ্রহণকারী ছাড়া অন্যদের কক্ষের বাইরে চলে যেতে হবে। তার পরও ছোট্ট একটা মেয়েকে ওখানে থাকতে দেখে সবাই অবাক। তাকেও চলে যেতে বলা হলো। ছোট্ট এই মেয়েটি যে একজন প্রতিযোগী এটা কেউ বিশ্বাস করতে চাইছিল না। অবশেষে কাগজপত্র দেখানোর পর বিশ্বাস করল কর্তৃপক্ষ। ‘ক’ গ্রুপে অংশ নিতে পারে প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরা। তবে দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ উপজেলার মুরারীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে পড়া চামেলীর চেয়ে ছোট আর কোনো অংশগ্রহণকারীই ছিল না। সেবার সবাইকে চমকে দিয়ে উপস্থিত অভিনয়ে ‘দজ্জাল বউ’ ও ‘ফেরিওয়ালা’র চরিত্র করে সে প্রথম স্থান অর্জন করল জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে। শুধু তাই নয়, কবিতা আবৃত্তিতেও উপজেলা পর্যায়ে প্রথম হলো ছোট্ট চামেলী। কিন্তু পরে চিকেন পক্সে আক্রান্ত হওয়ায় আর বিভাগীয় পর্যায়ে যাওয়া হয়নি।

এভাবে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়ই স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া উৎসব, সাংস্কৃতিক উৎসব ও জাতীয় পর্যায়ের নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে চামেলী। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় ‘জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে উপস্থিত অভিনয়ে দ্বিতীয় হয় আর কবিতা আবৃত্তিতে জীবনের প্রথম জাতীয় পুরস্কারটি ঘরে তোলে। ওই বছরের (২০১১) সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি অবশ্য ছিল আরেকটি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এক কবিতা আবৃত্তি উৎসব আয়োজন করা হয় রংপুরে, যেখানে চামেলী রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটি আবৃত্তি করে রংপুর বিভাগের সেরা আবৃত্তিকারের খেতাব পায়! পঞ্চম শ্রেণিতে পিএসসি পরীক্ষা থাকার পরও কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ বাদ যায়নি; বরং তার অর্জনে আরেকটি পালক যোগ হয়, পিএসসিতে গোল্ডেন এ+ প্রাপ্তি এবং বোঁচাগঞ্জ থানায় প্রথম হয়ে ট্যালেন্টপুলের বৃত্তি লাভ।

কয়েকটি ভালো স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় টিকলেও বাবা চেয়েছিলেন চামেলী মাদরাসায় পড়াশোনা করুক। সে-ও বাবার কথা রেখে ভর্তি হয়ে গেল দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ কামিল মাদরাসার ষষ্ঠ শ্রেণিতে। তবে এতে তার নানা সৃজনশীল বিষয়ে আগ্রহ বা প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া আটকে গেল না। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রতিযোগিতা ‘সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ-২০১৩’তে উপজেলা পর্যায়ে সে প্রথম হয়। শিশু একাডেমি আয়োজিত ‘জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা’য় আবৃত্তিতে বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম ও উপস্থিত অভিনয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে। আবার ইসলামিক ফাউন্ডেশন আয়োজিত, ‘জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা’য় হামদ-নাত, কিরাত, বক্তৃতা ও কবিতা আবৃত্তিতে জেলায় হয় ‘সেরা’।

সপ্তম শ্রেণিতে ‘সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ-২০১৪’তে জেলা পর্যায়ে প্রথম স্থান পায় চামেলী। আর ‘জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা’, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ‘জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা’ ও স্কুলের নানা প্রতিযোগিতায় অংশ তো নিয়েছিলই, সঙ্গে পুরস্কারও ছিনিয়ে এনেছে প্রত্যেকবারই। অষ্টম শ্রেণিতেও ‘সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ’ প্রতিযোগিতায় আবারও জেলা পর্যায়ে প্রথম হয়।

কাছিরা সুলতানা চামেলী 

অর্জনের ঝুলি বড় হতেই লাগল মেয়েটির। অষ্টম শ্রেণির জেডিসি পরীক্ষায় উপজেলা মাদরাসা কেন্দ্রে একমাত্র গোল্ডেন এ+ পাওয়া শিক্ষার্থী ছিল চামেলী। আর ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি তো ছিলই। নবম শ্রেণিতেও প্রায় সব প্রতিযোগিতায়ই অংশ নিয়েছিল। পুরস্কার তো জিতে ছিলই। স্কুলে হাতের লেখা, কবিতা আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা, একক অভিনয়, দলীয় অভিনয়, বিস্কুট দৌড়, অঙ্ক দৌড়, দেশাত্মবোধক গানে পুরস্কার পাওয়ার পাশাপাশি ক্লাসেও প্রথম স্থান ধরে রাখে চামেলী। স্টেজে উঠতে উঠতে সে যেমন ক্লান্ত, তেমনি উপস্থাপকও ক্লান্ত তার নাম ডাকতে ডাকতে!

২০১৭, দশম শ্রেণিতে তার জীবনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটে। সেটা হলো স্কাউটিংয়ে প্রেসিডেন্টস অ্যাওয়ার্ড লাভ। ২০১৩ সালের ২২ জানুয়ারি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় বাংলাদেশ স্কাউটে যোগ দেয় চামেলী। মাদরাসায় পড়ে স্কাউট করা চাট্টিখানি কথা নয়। অনেক বলে কয়ে কিছু ছাত্রীকে একত্র করে গড়ে তোলে সেতাবগঞ্জ কামিল মাদরাসা স্কাউট ইউনিট। খুব দ্রুতই বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে সিনিয়র প্যাট্রল লিডার হয়ে যায় চামেলী একটি দলের। দিনাজপুর শহর থেকে একটু দূরে তাদের নেওয়া হতো ক্যাম্পেইন করতে। ওই ক্যাম্পেইনের ফলে তাঁবু টাঙ্গানো, গাছে ওঠা, সাঁতার, রান্না, বাঁশ, কাঠের ব্যবহার ইত্যাদি অনেক কিছু শিখেছে। ‘রাজনীতি থেকে রাজমিস্ত্রির কাজ, সবই জানতে হয়েছে এই স্কাউটিংয়ের ফলে’—জানালো চামেলী। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে স্বেচ্ছাসেবী হয়ে কাজ করেছে চামেলী ও তার দল। তার দিকে, তাদের দিকে সবাই তাকিয়ে থাকত; কারণ মাদরাসার ছাত্রী হওয়ায় তারা হিজাব পরত। কিন্তু এসব কিছুকে কখনো পাত্তাই দেয়নি চামেলী। একজন স্কাউট লিডারের দায়িত্ব পালন করে গেছে সব সময়। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় দিনাজপুর জেলায় তার দল প্রথম হয়। এরপর এক বছর ধরে ১২টি পরীক্ষা ও ভাইভা দিয়ে পাস করে চামেলী। জুলাইয়ের ১৩ তারিখে অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার দিনক্ষণ ঠিক হয়। কিন্তু হিজাব পরে স্টেজে উঠে পুরস্কার নিতে পারবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আত্মবিশ্বাসী চামেলী দৃঢ়কণ্ঠে জানায়, হিজাব পরেই সে পুরস্কার নেবে। অবশেষে হিজাব পরা চামেলী ঢাকার ওসমানী মিলনায়তনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের হাত থেকে গ্রহণ করে স্কাউটের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘প্রেসিডেন্টস অ্যাওয়ার্ড’। চামেলীই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথম মাদরাসায় পড়া নারী স্কাউট, যে স্কাউটের সর্বোচ্চ এই মর্যাদাটি পেয়েছে। চামেলী জানায়, তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় দিন ছিল এটি।

নিজের মতো করে সময় কাটাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সে। বই পড়ার অভ্যাসটা বড় আপুর কাছ থেকে পেয়েছে। ইংরেজি, বাংলা সব রকম বই পড়া হয়। এসএসসির পর এই বিশাল ছুটির সঙ্গী হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মার্ক টোয়েন ও হুমায়ূন আহমেদের বই। চামেলী লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতাও লেখে। আজ অবধি কাউকে তার কবিতা দেখায়নি। তবে তার ধারণা, এই লেখাটা ছাপা হওয়ার পর না দেখিয়ে উপায়ও থাকবে না।

রান্নার হাত চমৎকার! শুধু বাঙালি ডিশ নয়, বিরিয়ানি, পাস্তা, ইতালিয়ান আর থাই ফুডও রান্না করতে পারে সে। তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু সাইকেল ‘দোলা’। বাবা জন্মদিনে সাইকেলটি তাকে উপহার হিসেবে দেন। চামেলীর সনদের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। আলাদা একটি শোকেস আছে শুধু তার ক্রেস্ট ও পুরস্কার রাখার জন্য। সনদগুলো সযত্নে রাখা আছে মোটা মোটা ফাইলে।

মা হাসনাহেনা বেগমের উৎসাহ পেয়েছে সব সময়। বাবা একটু শক্ত প্রকৃতির হলেও ভালোবাসা ও অনুপ্রেরণা কম দেননি। ‘আমার বাবা আমাকে নিয়ে খুব গর্ব করেন’ বলে চামেলী। বন্ধুর মতো পাশে আছে তার বড় বোন মিম আয়মান। অনুপ্রেরণাদাতাদের আরেকজন শাকিল রেজা ইফতি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় জেলা পর্যায়ে তার কাছেই হেরে গিয়েছিল। সেই-ই এখন চামেলীর বন্ধু অথবা বড় ভাই। রাতে খুব দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়ে এবং ভোরে ফজরের আজানের শব্দে ঘুম ভাঙে। পড়াশোনা, আবৃত্তি প্র্যাকটিস, বই পড়া—সব কিছুর জন্য সময় ভাগ করা আছে। আশ্চর্য মনে হলেও চামেলী তার স্কুলে একাডেমিক জীবনে কখনো প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি। সব কিছুতেই একটা টার্গেট করে এগোয় সে। এর ফলে পড়া কখনো জমে থাকে না, সময়ের কাজ সময়েই হয়ে যায়।

চামেলী ঢাকার কোনো কলেজে পড়াশোনা করতে চায়। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বা সমাজবিজ্ঞান অনুষদের কোনো একটি বিষয়ে পড়াশোনা করে শিক্ষক হতে চায়। পাশাপাশি সে যেসব অঙ্গনে সক্রিয় রয়েছে তা তো থাকবেই, সঙ্গে নারীদের নিয়েও কাজ করতে চায়।--কালেরকন্ঠ 

বিদিবিএস