বিজ্ঞানের এক অনন্য অর্জন কোয়ান্টাম কম্পিউটার


Dhaka | Published: 2022-03-04 11:04:56 BdST | Updated: 2024-04-23 21:51:51 BdST

জি.এম তাহসিন হামিমঃ

কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নিয়ে আলোচনা শুনলে মনে হবে এটা একটা সায়েন্স ফিকশন। কিন্তু আমরা কম্পিউটার প্রযুক্তির চরম শিখরে পৌঁছেছি, যা যুক্তিকে অস্বীকার করে এবং কল্পনাকে পরাজিত করে। আজকের কম্পিউটারে ব্যবহারিত ট্রানজিস্টরগুলো এতই ছোট যে সেগুলো হাতের কাছে থাকা প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি করা যায়। তাই কম্পিউটার উদ্ভাবকরা পারমাণবিক এবং অতি-পরমাণু স্তরে সম্ভাব্য সমাধানগুলি সন্ধান করতে শুরু করেছেন, যা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নামে পরিচিত।

প্রযুক্তি জগতের বড় কোম্পানিগুলো টেকসই কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু করেছে এবং সেগুলোকে বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আনার চেষ্টা করছে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার বহুগুণ কম্পিউটিং শক্তি সরবরাহ করতে সক্ষম হবে যা প্রচলিত ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের জন্য সম্ভব নয়। এটি দ্রুত যেকোনো সমস্যার সমাধান করবে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার সম্পর্কে জানুন:

 

যুক্তির বাইরে নতুন কম্পিউটিং

কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এর কাজ বোঝার জন্য প্রথমে কোয়ান্টাম কম্পিউটার কি তা জানতে হবে। পরমাণু বা কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার যুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেছে যেহেতু বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পরমাণুর ব্যাপক গবেষণা শুরু হয়েছিল। কোয়ান্টামের জগতে পরমাণু বলতে পদার্থবিজ্ঞানের প্রচলিত সূত্রকে বোঝায় না। কোয়ান্টাম কণা একই সময়ে দুই জায়গায় অবস্থান করে। একই সময়ে সামনের দিকে বা পিছনে যেতে পারে। অর্থাৎ, একটি কোয়ান্টাম কণা বা পারমাণবিক কণা একই সময়ে তার পরিধির সকল স্থানে বিদ্যমান থাকে। গবেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন যে এই অদ্ভুত উদ্দেশ্যে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার করা যেতে পারে। এটাকে পরমাণুর বা কোয়ান্টাম সুপার পজিশন বলে।
গণনার সময় কমে যাবে

আজকের কম্পিউটারগুলি বিট হিসাবে চলে। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার কিউবিট হিসেবে চলবে। বর্তমান কম্পিউটারগুলি মূলত বিটগুলিতে ডেটা সংরক্ষণ করে। এই বিট একটি বাইনারিতে '0' বা '1'-প্রতিনিধি, যা একটি বৈদ্যুতিক বা আলোক সংকেত হিসাবে কাজ করে। এই বিট পদ্ধতিটি আটটি বিটকে বাইটে একত্রিত করে, যা সাধারণত একটি সংকেত সংরক্ষণ করতে সক্ষম। তাহলে কিউবিট কী জিনিস?

কিউবিট ০-১ বাইনারিকেই ব্যবহার করে তথ্য সংরক্ষণের জন্য। তবে আলাদাভাবে নয়। একই সময়ে। অনেকটা কোয়ান্টাম তত্ত্বে বর্ণিত পদার্থের কণা এবং তরঙ্গ বৈশিষ্ট্যের মতো। কারণ কোয়ান্টাম জগতে একই কণা একই সময়ে একাধিক স্থানে থাকতে পারে এবং তরঙ্গ এবং কণার গতির মধ্যে এর চলাচলও মসৃণ। এটি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মূল শক্তি, যা এটিকে 0-1 সহাবস্থানের মাধ্যমে একসাথে একাধিক ডেটা সংরক্ষণ করতে সক্ষম করে। এটি এর শক্তিকে দ্বিগুণ নয়, বহুগুণে বাড়িয়ে দিতে সক্ষম হবে। কারণ, এই শক্তি জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি জটিল রাস্তায় আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হলো আপনার সামনে ২০ থেকে ৩০ টা রাস্তা আছে যাওয়ার কিন্তু আপনার নির্দিষ্ট একটি স্থানে পৌছানোর রাস্তা এই ২০ থেকে ৩০ টা রাস্তার মধ্য একটি। এখন আপনি কি করবেন? সাধারণ যুক্তিতে আপনাকে প্রত্যেকটি রাস্তায় যেয়ে যাচাই করতে হবে।
এখন এই ব্যাপারটিকে আমরা ক্ল্যাসিকাল কম্পিউটার এই সাথে তুলনা করি। অন্যদিকে বিষয়টি যদি এমন হয় আপনার অনেকগুলা কার্বন কপি তৈরি হবে এবং সব গুলা কার্বন কপি এই ২০ থেকে ৩০ টা রাস্তায় একই সময় যাচাইয়ের জন্য বেরিয়ে পড়বে। তাহলে সঠিক রাস্তা যাচাই করে বের করতে কত সময় লাগবে? অবশ্যই খুবই কম সময় লাগবে। এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটার ঠিক এইভাবেই কাজ করবে তার সুপার পজিশন বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করে।


অবাস্তবকে বাস্তব করে তুলবে

ধরুন, কোনো একটি সমস্যা শেষ করতে বিলিয়ন বছর লাগত। অর্থাৎ প্রায় অসম্ভব গাণিতিক সমস্যার সমাধান এক তুড়িতেই করে ফেলতে পারবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। একসময় যা অসম্ভব বলে ধরে নেওয়া হতো, তা অসম্ভব থাকবে না। ক্ল্যাসিকাল কম্পিউটারকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার।

তথ্য নিরাপত্তা
অনেকে মনে করেন ডেটা নিরাপত্তার জন্য এনক্রিপশনই যথেষ্ট। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমে ভার্চুয়াল এনক্রিপশন তৈরি করা সম্ভব যা ভাঙা যাবে না। এটি ডেটা নিরাপত্তায় যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে বলে অনেকে মনে করেন।


গতির রাজা

গুগল সম্প্রতি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের উপর তার আধিপত্য ঘোষণা করেছে। গুগলের এআই কোয়ান্টাম টিম কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এর ক্ষেত্রে আরেক ধাপ এগিয়েছে বলে বিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল নেচারে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। গুগলের সিকামোর প্রসেসর সাড়ে তিন মিনিট সময়ে এমন এক গাণিতিক সমস্যা সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে, যা প্রচলিত সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটারের করতে ১০ হাজার বছর সময় লাগত। আর্মহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ক্যাথরিন ম্যাকগিওচের মতে, প্রচলিত কম্পিউটারের চেয়ে হাজার হাজার গুণ গতিসম্পন্ন কোয়ান্টাম কম্পিউটার।


বড় ডেটা সমাধান
আমাদের প্রতিদিনের জীবনে আমরা ২ দশমিক ৫ হেক্সাবাইট তথ্য উৎপন্ন করছি, যা ৫০ লাখ ল্যাপটপে থাকা কনটেন্টের সমান। ভ্যবিষ্যৎ এ বিশাল এ তথ্য ভান্ডার বিশ্লেষণ করবে কোন কম্পিউটার? কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পক্ষেই এ পরিমাণ তথ্য প্রসেস করে বিগ ডেটা যুগের চাহিদা মেটানো সম্ভব! ভবিষ্যতে মেশিন বা যন্ত্রের যুগ আসছে। প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যন্ত্র থেকেও তৈরি হবে ডেটা। এসব তথ্যের নিখুঁত বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়েই।


উন্নত সফ্টওয়্যার এবং মেশিন লার্নিং

কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জন্য ইতিমধ্যে বিভিন্ন ধরনের অ্যালগরিদম তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আনস্ট্রাকচারড ডেটাবেইস খুঁজতে গ্রোভারস অ্যালগরিদম ও বৃহৎ সংখ্যাকে উৎপাদন কাজে লাগাতে সর অ্যালগরিদ উল্লেখযোগ্য। টেকসই কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি হয়ে গেলে মেশিন লার্নিং সমস্যা সমাধানের জন্য সময় কমাতে সাহায্য করবে।

তবে আমাদের প্রতিদিনের জীবনে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের স্থান কোয়ান্টাম কম্পিউটার হয়তো বা দখল করতে পারবে না। বিজ্ঞানীদের মতে এই ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ক্ল্যাসিকাল কম্পিউটারের মত পারফরমেন্স দেখাতে পারবে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের থেকে বেশি সময় নিয়ে নিবে। সুতরাং আপতত ক্ল্যাসিকাল কম্পিউটার কে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। ত্রিমাত্রিক (থ্রি -ডাইমেনশিয়াল) মহাবিশ্ব কি শুধু মাত্র বিভ্রম বা ইলিউশন? হলোগ্রাফিক মহাবিশ্বের কনসেপ্ট কিন্তু সেটাই বলে।