বিদ্যার বাটখারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা!


টাইমস অনলাইনঃ | Published: 2018-10-11 01:52:07 BdST | Updated: 2024-07-05 10:07:27 BdST

ফারদিন ফেরদৌস: গেল কয়েক বছরে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ পেলে জিপিএ ৫ পাওয়ার আনন্দের আতিশয্যে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের অনেকেই কেঁদে ফেলেন। এই কান্নাটা সত্যিকারের ক্রন্দনে রূপ পায় যখন গোল্ডেন জিপিএ ৫ পাওয়া বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। কিন্তু প্রথম সাড়ির শিক্ষার্থীরা কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করবে না এই বিষয়টি কারো ভাবনায় আসে না। বিশেষ করে গেল পাঁচ-ছয় বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফল দেখে সবার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যাচ্ছে। একশ জনের মধ্যে প্রায় নব্বই জন ছাত্রছাত্রীই যখন ফেল করে বসেন তাতে শিক্ষার মান বলে কিছু আর অবশিষ্ট আছে এমন বোধ হয় না।

২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ পেলে এক লজ্জাজনক পরিস্থিতির অবতারণা হয়। ইংরেজি বিভাগে ভর্তির জন্য মাত্র দুজন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হন। বাকি সবাই ফেল। বাধ্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পাস মার্কের মার্জিন অবনমন করতে বাধ্য হন। ইংরেজি বিভাগে ভর্তির জন্য পরীক্ষায় ‘সাধারণ ইংরেজিতে’ ৩০ নম্বরের মধ্যে ২০ এবং ‘ইলেকটিভ ইংলিশে’ ১৫ পাওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছিল। পরে শর্ত শিথিল করে ইলেকটিভ ইংলিশে ৮ পাওয়াদেরও ইংরেজি বিভাগে ভর্তির সুযোগ দেয়া হয়। তা নইলে মাত্র দুইজন শিক্ষার্থী দিয়েই সেশন শুরু করতে হতো।

এ বছর ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে কলা অনুষদের অধীন ‘খ’ ইউনিটের প্রথম বর্ষ স্নাতক সম্মান শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে মাত্র ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছেন। তার মানে ৮৬ শতাংশ ভর্তিচ্ছুই ফেল করেছেন। ‘খ’ ইউনিটে দুই হাজার ৩৭৮টি আসনের জন্য ৩৫ হাজার ৭২৬ জন আবেদন করলেও পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ৩৩ হাজার ৮৯৭ জন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করেছেন চার হাজার ৭৪৭ জন। আর অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৯ হাজার ১৫০ জন। যদিও মোট আসনের তুলনায় পাসকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম নয়, তবু এত শিক্ষার্থীর ফেল করা নিয়ে নিশ্চিতই শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের ভাবনার সময় এসেছে।

গত বছর ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ৩১ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২৬ হাজারই ফেল করেছিলেন। পাসের হার ছিল ১৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আর চলতি বছর এই হার নেমে এসেছে ১৪ শতাংশে। অন্যদিকে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ‘গ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলেও পাসের হার ছিল ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৮৫ ভাগ শিক্ষার্থী ফেল করেছেন। অধিকাংশ শিক্ষার্থী পাস মার্কস ১২ না পাওয়ায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেন। একশ নাম্বারের মধ্যে ৪০ পেলেই যেখানে পাস, তারপরও ৮৫ ভাগই ফেল। এবারের অবস্থাও ভিন্নতর কিছু নয়। ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায় অনেক গোল্ডেন এ প্লাসধারীরাও ইংরেজিতে ৪-এর অধিক মার্কস পান না। উলটো আবার অনেকের কাছ থেকে নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই মার্কস পাওনা হয়ে যায়।

গেল কয়েক বছর ধরেই ফলাফলের এমন ধারা লক্ষ করা গেছে। যে শিক্ষার্থীটি জিপিএ ৫ পেয়ে আশার স্বপ্ন বুনেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা নিদেনপক্ষে দেশের প্রান্তিক এলাকার কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবেন তাদের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকেই নিরাশ হতে হয়। যাদের পরিবার সক্ষম তারা নাহয় অর্থের বিনিময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহুমূল্যবান পণ্য হিসেবে বিদ্যা কেনেন, বাকিদের ভরসা করতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কোনো কলেজে। যারা তাও না পারেন মাঝপথ থেকে ঝরে যান। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে যদি এমন পরিণতিই বরণ করতে হবে তবে কেন কর্মমুখী শিক্ষার ওপর অধিকতর জোর দেওয়া হয় না?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরাবর দাবি করে এসেছে তাদের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন সবই সিলেবাসের মধ্য থেকেই হয়। তারপরও এত ফেল কেন? শিক্ষা বিশারদদের মতে পাঠদান পদ্ধতি ও শিক্ষার্থীদের সহজ পদ্ধতিতে জিপিএ ৫ পাওয়ার প্রবণতার কারণেই এমনটা হচ্ছে। সাংবাদিকদের তরফে বেশ কয়েকবার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে এই বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা হলে তিনি উলটো বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করে দিয়ে এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির দাবি তুলেছেন। শিক্ষামন্ত্রীর মতামত হলো, ৭০-৮০ ঘণ্টার পাবলিক পরীক্ষার চেয়ে এক ঘন্টার ভর্তি পরীক্ষার মূল্যায়ন বড় হতে পারে না। বিষয়টি যে কত হাস্যকর তা শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা ছাড়াও সবাই জানেন। বাচ্চারা সৃজনশীলতা ভালো বোঝে না, পাঠ্যবইয়ে তাদের আগ্রহ নেই। পছন্দের শিক্ষকের কাছে কোচিং করলেই প্রশ্ন আউট করে দিয়ে ভালো নাম্বার পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন অসাধু শিক্ষকরা। এমন বাস্তবতায় পাবলিক বিশবিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ছাঁকনিতে গিয়ে আটকে যায় শিক্ষার্থীরা। কারণ সেখানে বলে কয়ে দেওয়ার কেউ থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রশ্নও করা হয় দীর্ঘদিনের চর্চা থেকে পাওয়া পরিশুদ্ধ পদ্ধতিতে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলাফল বিপর্যয় প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বেশ কয়েকবার গণমাধ্যমকে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় বড় একটি অংশের উত্তীর্ণ হতে না পারাটা খুবই খারাপ লক্ষণ। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ফলাফল ভালো হলেও তাতে যে গুণগত কোনো পরিবর্তন আসেনি এটি তারই প্রমাণ। শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরকে গুরুত্ব না দেওয়া এবং শিক্ষকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করা এর অন্যতম কারণ। শিক্ষকদের কোচিং নিষিদ্ধ করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা বন্ধ করা যায়নি। তারা শ্রেণিকক্ষে কী পড়ালেন বা কী করছেন সঠিকভাবে সেটিরও তদারকি হয় না। এই শিক্ষকের মতে, প্রবর্তিত সৃজনশীল পদ্ধতি শিক্ষার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারছে না।

যতক্ষণ পর্যন্ত না পাসের হার বৃদ্ধির উলম্ফন প্রবণতা আমাদের শিক্ষামন্ত্রক বন্ধ করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার বাটখারায় বিদ্যাদেবী পাস করবে বলে মনে হয় না। প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় আগে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগদান নিশ্চিত করা হোক, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হোক এবং সৃজনশীলতার অদ্ভুত সংস্কার করে সিলেবাসে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড যথার্থরূপে অনুসরণ করা হোক। শিক্ষায়তনগুলো থেকে সরকারি দলের পদাধিকারি নেতা-পাতিনেতাদের লভ্যাংশ গ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হোক। শিক্ষায়তন থেকে রাজনীতি চিরতরে অপসারিত করা হোক। তারপর শিক্ষার্থীদের বোধ ফিরলে, সত্যিকারের জ্ঞান চর্চায় তারা মনোনিবেশ করলে ভর্তি পরীক্ষার এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে জাতির মুক্তি মিললেও মিলতে পারে।

অন্যথায় প্রচলিত ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে না হবে জ্ঞানচর্চা, না হবে গবেষণা, না হবে সুশিক্ষিত জাতিগঠন। প্রকৃত মানুষ হওয়া আর কারো হয়ে উঠবে না। এ দেশে এত কাঠখড় পুড়িয়ে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সুযোগ পান, তারাও যে খুব খুব শান্তিতে আছেন এমন নয়। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই তাদের ভবিষ্যৎ ভাবনায় দিশেহারা থাকেন। গেল কয়েক বছরে উপযুক্ত কর্মের সন্ধান না পেয়ে বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীকে আত্মহত্যাও করতে দেখা গেছে। এমন বাস্তবতায় শিক্ষিত অথবা অর্থশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বোঝা না বাড়িয়ে রাষ্ট্রের উচিত কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করা। বিশ্ববিদ্যালয়কে রূপান্তর করা উচিত পুরোদস্তুর গবেষণাগারে। যেখানে সত্যিকারের মেধার চাষ হবে। আর সেই চাষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ফসলে ভরে ওঠবে দেশ মাতৃকার গোলা। এমন একটা সময় আমাদের যারা উপহার দিতে পারেন, সেই শিক্ষাবান্ধব তারা এই ভূমিতে কবে পা রাখবেন আমাদের জানা নেই।

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন