দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আসন্ন ১২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শিক্ষক সমিতির নির্বাচন বর্জন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল। গত ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সাদা দলের সাধারণ সভায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী গতকাল ২৯ নভেম্বর ছিল মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার তারিখ শেষ হলেও কোনো মনোনয়নপত্র জমা দেয়নি দলটি।
বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. লুৎফুর রহমান লিখিত বক্তব্যে এ ঘোষণা দেন।
কারণ উল্লেখ করে লিখিত বক্তব্যে অধ্যাপক ড. লুৎফুর রহমান বলেন, ভিন্নমতের লালন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার পাদপীঠ আমাদের প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। একে গণতন্ত্রের সূতিকাগারও বলা হয়। কিন্তু আপনারা লক্ষ্য করেছেন যে, বর্তমান প্রশাসন আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ উদার ও গণতান্ত্রিক চরিত্রটি মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন করা হয়েছে। গত প্রায় দেড় দশক ধরে বর্তমান সরকার সমর্থক প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছে। আপনারা একমত হবেন যে, এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা অনিয়ম ও ব্যাপক মাত্রায় দলীয়করণ করা হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগে অনেক ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতাকে উপেক্ষা করে দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ভিন্নমত এবং আদর্শের শিক্ষকদের যথাসময়ে পদোন্নতি না দেয়াসহ তাদের নানাভাবে হয়রানির কথাও সকলের জানা। হল প্রশাসন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র একদলীয় নিয়ন্ত্রণ পাকাপোক্ত করা হয়েছে। হলগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল দলমতের শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ঐতিহ্যকে ভুলুষ্ঠিত করা হয়েছে। দলীয় পরিচয় দিয়ে ব্যক্তিগত আক্রোশে অনেক নিরীহ শিক্ষার্থীকে নিপীড়ন নির্যাতন করে হল ছাড়া, এমনকি পুলিশেও সোপার্দ করা হচ্ছে।
ঢাবি শিক্ষক সমিতি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে উল্লখ করে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক মানোন্নয়নসহ শিক্ষকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং অভিভাবক হিসেবে সকল শিক্ষার্থীর জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করার পক্ষে ভূমিকা রাখে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান ও গণতান্ত্রিক ধারা রক্ষা, আইনের শাসন, ন্যায় বিচার, সুশাসন এবং মানবাধিকার রক্ষার ব্যাপারেও শিক্ষক সমিতি সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনে শিক্ষক সমিতির গঠনতান্ত্রিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতাও রয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী প্রশাসন সমর্থক শিক্ষক সমিতি তার এ দায়িত্ব কী যথাযথভাবে পালন করেছে?
সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ আজ একটি অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট ও একনায়কতান্ত্রিক সরকারের দুঃশাসন কবলিত। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচনের নামে তামাশা ও প্রহসন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দলখকারী বর্তমান আওয়ামী সরকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নস্যাৎ, ভোটাধিকার হরণ ও মানবাধিকার ভুলুন্ঠিত করার বিষয়টি কেবল দেশপ্রেমিক জনতা নয়, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলেও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। এ অবস্থায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জোটের চলমান গণআন্দোলন দমনে ফ্যাসিস্ট সরকার চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। সরকারের আজ্ঞাবহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তার ও ভয়াবহ জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে দেশে চরম অস্থিরতা, নৈরাজ্য ও ভীতিকর অবস্থা তৈরি করেছে। আমরা মনে করি, বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ভিন্নমত দলন করে বর্তমান অগণতান্ত্রিক সরকার আবারও ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো আরেকটি প্রহসনের নির্বাচন করতে যাচ্ছে। নানা অপকৌশলের মাধ্যমে দেশের বিপুল জনপ্রিয় প্রধান বিরোধীদল বিএনপি-কে নির্বাচন থেকে দূরে রেখে একটি এক তরফা নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের নীলনকশা দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে।
শিক্ষক সমিতির দায়িত্ব উল্লখ করে তিনি আরও বলেন, শিক্ষক সমিতির কাছে কেবল আমাদের নয়, জাতির প্রত্যাশা ছিল ঐতিহ্য অনুযায়ী তারা বর্তমান সরকারের অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী ভূমিকার প্রতিবাদ জানাবে। জনদাবি অনুযায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু আমরা দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সেটি তো করেই নি, বরং তারা তাদের নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গত দেড় দশক ধরে বর্তমান সরকারের অন্যায়, অন্যায্য ও অগ্রণতান্ত্রিক কার্যক্রমকে শর্তহীনভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে সরকারের অপকৌশলকেও সমর্থন দিচ্ছে। এ অবস্থানের কারণে শিক্ষক সমিতি দেশের সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষেরও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ছে। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জনগণ তাদের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবে প্রত্যাশা করে বলেন, সাদা দল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী একটি পেশাজীবী সংগঠন। নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনে বিশ্বাসী বলে দলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ফোরামের নির্বাচনে সবসময় অংশ নিয়ে আসছে। এরই ধাবরাবাহিকতায় ফলাফল যাই হোক না কেন, সবসময় এ দলটি শিক্ষক সমিতির নির্বাচনেও অংশ গ্রহণ করে। কিন্তু এবার বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আসন্ন নির্বাচনে অংশ গ্রহণের পরিবেশ অনুকূল বলে আমরা মনে করি না। দেশে একটি এক তরফা জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বর্তমান সরকার এবং তাদের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন। এর প্রতিবাদে গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের পরিচালিত আন্দোলনে আমরাও সমর্থন জানিয়ে আসছি। আমরা মনে করি, দেশে বিরাজমান পরিস্থিতিতে আসন্ন শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার চেয়ে দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং ভোটাধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনের গুরুত্ব অনেক বেশি। আমরা চাই না, শিক্ষক সমিতি নির্বাচিত হোক যেটি ভোটাধিকার হরণকারী অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিস্ট সরকারের হাতকে শক্তিশালী করবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাবি শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম, সাদা দলের যুগ্ম-আহবায়ক অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান খান প্রমুখ।