প্রেমে প্রশংসা দাম্পত্যে নেই কেন !


Prothom-alo.com | Published: 2017-08-16 20:17:35 BdST | Updated: 2024-05-09 02:42:23 BdST

বৃষ্টির দিনে মনটা উদাস হয়ে গেল দোলার (ছদ্মনাম)। মনে পড়ল ক্যাম্পাসের দিনগুলো। সহপাঠী রাশেদের সঙ্গে তখন তুমুল প্রেম। বৃষ্টিতে ক্যাম্পাসে মনের সুখে ভেজা, কখনো রিকশার হুট খুলে ঘুরে বেড়ানো, তারপর কাঁপতে কাঁপতে চায়ের দোকানে গরম চায়ে চুমুক—কী দিনই না ছিল! ‘আর এখন তো বৃষ্টিতে ভেজার কথা মুখেই আনতে পারি না, রাশেদ শুনলেই বিরক্ত হয়, বলে যে ঠান্ডা লাগবে।’ অভিমান জড়ানো কণ্ঠে বললেন দোলা। বিয়ের আগের আর পরের রাশেদকে মেলাতে না পেরে ভীষণ কষ্ট লাগে, দোলার সরল স্বীকারোক্তি।
উল্টোটাও হয়। ছাত্র অবস্থায় সিনেমা দেখার আয়োজনে গিয়ে তিন বছরের বড় তন্ময়ের সঙ্গে পরিচয় তনুজার। পরিচয় প্রেমে গড়ায়। সিনেমাপ্রেমী তন্ময়ের সঙ্গী হয়ে তনুজা চষে বেড়াতেন যেকোনো উৎসব-আয়োজন। এ নিয়ে আপত্তি ছিল না তনুজার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে তন্ময় তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবে চলচ্চিত্রকে বেছে নিয়েছেন। ফলে এখনো প্রচুর সিনেমা দেখা হয় তাঁর। কিন্তু আগের মতো আর সঙ্গী হতে চান না স্ত্রী তনুজা, বরং বিরক্ত হন। আক্ষেপ করে তন্ময় বলছিলেন, ‘চলচ্চিত্র নিয়ে আগে আমার কোনো লেখা কোথাও প্রকাশিত হলে কী যে খুশি হতো ও। এখন তো আমি সামনে নিয়ে দিলেও পড়তে চায় না।’
তাহলে কি নিন্দুকের কথাই সত্য? প্রেমের মৃত্যু হয় বিয়েতে! আর এ পরিস্থিতি এড়াতেই কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতার অমিত রায় প্রেম করেছেন লাবণ্যের সঙ্গে আর বিয়ে করেছেন কেতকীকে? তবে অমিতের মতো করে তো আর সবাই ভাবেন না। বেশির ভাগ মানুষই চান, তাঁদের ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে সুখে-শান্তিতে সারাটা জীবন কাটাতে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে গেলে, ‘আমি তোমাকে অসংখ্যভাবে ভালোবেসেছি, অসংখ্যবার ভালোবেসেছি।’
তো একজনকে অসংখ্যবার অসংখ্যভাবে ভালোবাসার ক্ষেত্রে বাধাটা কী? যার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়া, বিয়ের পর ‘তোমাকে তো বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে’ বলতেও কার্পণ্য কেন? স্মার্টনেস দেখে প্রেমে পড়া মেয়েটির বর কেন বলেন, ‘এত দাপট দেখাও কেন? সবকিছুতে খবরদারি না করলে হয় না?’ প্রেমের দিনগুলোতে প্রেমিকের গিটার হৃদয়ে ঝড় তুললেও সংসার-জীবনে তা তাল কেটে দেয় কেন? মঞ্চকাঁপানো নৃত্যশিল্পী হাজার হাজার মানুষের প্রশংসা পেলেও ঘরের মানুষের মুখটা প্যাঁচার মতো বেজার থাকে কেন?
এসব কেন-এর উত্তর দিতে গিয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রেমের সময় লক্ষ্য থাকে সেটাকে পরিণতি দেওয়ার। বিয়ের মাধ্যমে যেহেতু লক্ষ্য অর্জিত হয়ে যায়, তাই সেটা নিয়ে আর ভাবতে চায় না অনেক দম্পতি। তবে এমন করলে চলবে না। দৃষ্টিভঙ্গি একটু বদলাতে হবে। সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দিতে ছোট ছোট লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। সেসব পূরণে দুজনই যখন সচেষ্ট হবেন, সম্পর্ক এমনিতেই মধুর হয়ে যাবে।বিয়ের পর একটু কথাতেই যেন বিরক্তি। কোথায় গেল সেই প্রেম
মধুর দাম্পত্যের উদাহরণও কিন্তু কম নয়। আমিন চৌধুরী-রাহেলা বেগমের কথাই বলা যাক। ৪০ বছরের দাম্পত্যজীবন তাঁদের। পরিচিতজনেরা তাদের সুখী দাম্পত্যের উদাহরণ টানেন। এই দম্পতির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সুখী জীবনের রহস্য কী? আমিন চৌধুরী বললেন, ‘প্রতিটা বয়সের ভিন্ন সৌন্দর্য আছে। বিয়ের পরপর আমরা খুব সিনেমা দেখতে যেতাম। পরে বাচ্চাকাচ্চা হলো। তখন বছরে একবার সবাই মিলে বেড়াতে যেতাম। ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটাই।’ আর রাহেলা বেগম বললেন, ‘ও আমার রান্নার প্রশংসা করে সব সময়। আমি কিছু কিনে দিলে ও কখনো নাক সিটকায় না, আমিও না। এটা প্রেম কি না, জানি না। তবে এভাবেই চলছি আমরা।’
শীতলতা ভেঙে দাম্পত্যকে চিরসবুজ করার কিছু উপায়ও বলে দিলেন হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তাঁর ভাষায়, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সকালে চোখ মেলে সঙ্গীকে দেখে মিষ্টি একটা হাসি দিন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও পরস্পরকে ‘ভালোবাসি’ কিংবা ‘মিস করছি খুব’—এমন খুদে বার্তা পাঠান। কাজ শেষে ঘরে ফিরে গল্প করুন, একটু হাতটা ধরুন। অন্তত একটা বেলা একসঙ্গে বসে খান। এর সঙ্গে তিনি যোগ করলেন, মন খুলে সঙ্গীর প্রশংসা করুন, ভালো কাজে উৎসাহ দিন; দেখবেন নতুন লাগছে সম্পর্কটাকে।
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলে গেছেন, ‘ভালোবাসাবাসির জন্য অনন্তকালের প্রয়োজন নেই, একটি মুহূর্তই যথেষ্ট। তো সেই মুহূর্তটা কেন এখনই নয়! সব অভিমান পেছনে ফেলে সঙ্গে থাকার জন্য পরস্পরকে ধন্যবাদ দিয়েই শুরু করা যেতে পারে। ছকে বাঁধা জীবনটাকে মাঝে মাঝে পাশ কাটিয়ে কোথাও খেতে চলে যাওয়া কিংবা বেড়ানো, অবাক করে দিতে ছোট কোনো উপহার দেওয়া—এভাবেই অভিমানের দেয়াল ভেঙে অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে থাকা দাম্পত্য সম্পর্কটাকে করে তুলুন টক-ঝাল-মিষ্টি। বৃষ্টির দিনে অঞ্জন দত্তের সুরে গেয়ে উঠুন—
‘একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে, থাকবে না সাথে কোনো ছাতা,
শুধু দেখা হয়ে যাবে 
মাঝ-রাস্তায়, 
ভিজে যাবে চটি, জামা, মাথা।’

এমএসএল