জনগণের নাকি আমলাতন্ত্রের বিশ্ববিদ্যালয়?


হামজা রহমান অন্তর | Published: 2019-12-15 19:23:35 BdST | Updated: 2024-05-03 18:46:53 BdST

সান্ধ্যকালীন কোর্স একেবারে বন্ধ করা কোনও সমাধান নয়। একজন শিক্ষার্থীর অধিকার রয়েছে একাধিক বিষয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করার। নিত্যনতুন বিষয়ে গবেষণা করা ও শেখার অধিকার সীমাবদ্ধ হতে পারে না। বাংলাদেশের হাজার হাজার মেধাবী শিক্ষার্থী বিদেশে গিয়ে ডিপ্লোমা, মাস্টার্স, এমফিল-পিএইচডি করতে পারতো না, দেশের সুনাম বাড়াতে পারতো না, যদি সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব কোর্স বন্ধ থাকতো। কিন্তু তফাৎ হলো, সেসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করতে জানে, আমরা জানিনা।

আমাদের দেশের এসব কোর্সে মাত্রাতিরিক্ত কোর্স ফি নির্ধারণ করে শিক্ষার্থীদের পিঠের চামড়া তুলে নেওয়া হয়। দেখা যাচ্ছে, এক বছর মেয়াদি একটা মাস্টার্স প্রোগ্রামের সব শিক্ষকদের যথাযথ বেতন-ভাতা দিয়ে শিক্ষার্থীদের জনপ্রতি ৩০ হাজার টাকাও যেখানে খরচ হয়না, সেখানে প্রায় ৫ গুণ বেশি বাড়িয়ে দেড় লাখ টাকা নেওয়া হচ্ছে। এসব নিয়ে কথা বলতে হবে।

শিক্ষাদান কখনো ব্যবসায়িক উপাদান নয়, শিক্ষাদান একটি পবিত্র ও সেবামূলক কার্যক্রম। শিক্ষার সাথে ব্যবসা না জড়ালেই মান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তখন যোগ্যতার তোয়াক্কা না করে যে কাউকে বিশেষ বিবেচনায় ভর্তি করতে পারবে না। যোগ্যতার সঠিক বিচার হবে। তখন সবাই সান্ধ্যকালীন সার্টিফিকেটকে মূল্যায়ন করবে।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কেবল ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি, জাবি, রাবি, চবি) ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ আইন দ্বারা পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন মর্যাদায় পরিচালিত। আমাদের উচিৎ এসব স্বায়ত্বশাসনের যথাযথ ব্যবহার করতে শেখা। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন দূরদর্শী ও গণতান্ত্রিক ধারার মানুষ ছিলেন বলে উপলব্ধি করতে পেরেছেন স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে স্বায়ত্তশাসনের অপব্যবহার করে এইসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন মগের মুল্লুক কায়েম করছে।

গবেষণার বরাদ্দ কমিয়ে দিয়ে আরাম আয়েশ করার বরাদ্দ বাড়াচ্ছে। শিক্ষার্থীদের জন্য বাস না কিনে শিক্ষকদের পরিবারের জন্য এসি বাস কিনছে। বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের যথাযথ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করছে না। শিক্ষার্থীদের সেশনজট ও আবাসিক সমস্যা ভয়াবহ, এ নিয়ে না হয় নাই বললাম। ক্লাসে আসার আগে শিক্ষকরা যথেষ্ঠ পড়াশোনা না করে, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পাঠদানকে আকর্ষণীয় করে না তুলে, ‘উপস্থিতি নম্বর’ চাপিয়ে দিচ্ছে।

আবিষ্কারক, গবেষক, বিশেষজ্ঞ গড়ে না তুলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একেকটা ‘বিসিএস ক্যাডার’ গড়ার কারখানায় পরিণত হচ্ছে। শিক্ষকদের মহান দায়িত্ব শুধু পাঠদান বা জ্ঞান বিতরণ নয়, জ্ঞান তৈরি করা। তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে বিভিন্ন ইনস্টিটিউট/বিভাগ খোলার কী দরকার? সিনেট ও সিন্ডিকেটে ছাত্র অধিকার নিয়ে কথা বলার মতো কোনো ছাত্র প্রতিনিধিত্ব রাখছে না, ছাত্রসংসদ নির্বাচন এখন ইতিহাসের পাতায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্লামেন্ট বলে পরিচিত সিনেটে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রয়োগের সুযোগ রাখছে না, অনেক পদ খালি রাখছে, কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ হবার পরেও নির্বাচন দিচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিনেট বলে পরিচিতি সিন্ডিকেটেও একই বেহাল। এখানে উপাচার্য একাই সিন্ডিকেট, বাকিদের দায়িত্ব শুধু তার সিদ্ধান্তকে সাফাই গেয়ে যাওয়া, কোনো গণতান্ত্রিক চর্চা নেই।

গণতান্ত্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বদলে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একেকটা আমলাতান্ত্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকের বদলে শোষিত ক্রীতদাস এবং এক শ্রেণির শিক্ষকরা অভিভাবকের বদলে বুর্জোয়া শোষকের ভূমিকায়। তবে এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেবার সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী।

বঙ্গবন্ধু এটি দিয়েছিলেন ছাত্রদের অধিকার রক্ষার জন্য, কোনো অগণতান্ত্রিক/স্বৈরাচারী সরকার যাতে সেটি হরণ করতে না পারে। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য শিক্ষার্থীদের অধিকার হরণ করেছেন আমাদের সম্মানিত শিক্ষকরাই। স্বায়ত্তশাসনের সুফল পাচ্ছেন শিক্ষকরা। আর সুফলের বদলে কুফল ভোগ করছে শিক্ষার্থীরা।

এসব নিয়ে না ভেবে শুধু সান্ধ্যকালীন কোর্স বন্ধ করা কোনভাবেই কোনো স্থায়ী সমাধান না, এই শিক্ষকেরা কী তখন অবসর সময়ে গবেষণায় মনোনিবেশ করবেন? শিক্ষার্থীদের নিয়ে মেতে থাকবেন? নাকি স্বায়ত্তশাসনের অপব্যবহার করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে “খ্যাপ” মারতে যাবে? ভাবার আছে অনেক কিছু, কিন্তু আমরা ভাবি না।

bdnews24