স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস (১৯৭২-২০১৭...)


এম. এ. লতিফ | Published: 2017-08-09 03:59:45 BdST | Updated: 2024-03-29 12:47:04 BdST
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক ইতিহাস ঘটনাবহুল এসময় রাজনীতি বিভিন্ন মোড় নিয়েছে। ১৯৭২ থেকে ২০১৭ এই সময়ে গণতান্ত্রিক শাসন, স্বৈরাচার ও জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের মত ঘটনা ঘটেছে। নিম্নে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো ...
১৯৭২ সাল (বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণীত ও বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি)
৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেদিনই বঙ্গবন্ধু ঢাকার উদ্দেশ্যে লন্ডন যাত্রা করেন। লন্ডনে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়। লন্ডন থেকে ঢাকা আসার পথে বঙ্গবন্ধু দিল্লীতে যাত্রা বিরতি করেন। বিমানবন্দরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারী ঢাকায় পৌঁছেন। তাঁকে অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে লাখো জনতার সমাবেশ থেকে অশ্র“সিক্ত নয়নে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ১১ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। ৬ ফেব্র“য়ারী ভারত সরকারের আমন্ত্রণে তিনি ভারত যান। ২৪ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করে তাঁর আজীবন সদস্যপদ প্রদান করেন। ১ মার্চ তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে যান। ১২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারতীয় মিত্র বাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ১৯ মার্চ মুজিব-ইন্দিরা ২৫ বছরের ভারত- বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু ব্যাংক, বীমা, পাট, বস্ত্র, চিনি ও জাহাজ শিল্পসহ ভারী শিল্প জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত ঘোষনা করেন। ১ মে তিনি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সরকারী কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। ৩০ জুলাই লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর পিত্তকোষে অস্ত্রোপাচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের পর লন্ডন থেকে তিনি জেনেভা যান। ১০ অক্টোবর বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরী পুরস্কারে ভূষিত করে। ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বচনের তারিখ (৭ মার্চ ১৯৭৩) ঘোষণা করেন। ১৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের কথা ঘোষণা করেন।
১৯৭৩ সাল (জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচন)
জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৯৩ আসন লাভ। ৩ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ সিপিবি ও ন্যাপের সমন্বয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত। ৬ সেপ্টেম্বর জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য বঙ্গবন্ধু আলজেরিয়া যান। ১৭ অক্টোবর তিনি জাপান সফর করেন।
১৯৭৪ সাল (জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ)
১৯ ফেব্র’য়ারি বঙ্গবন্ধু সরকার ঢাকা পৌরসভাকে কর্পোরেশনে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। ২২ ফেব্র“য়ারি বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি প্রদান। ২৩ ফেব্র“য়ারি ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মত অনুমোদনে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে এবং ২৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন।
১৯৭৫ সাল (জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড )
২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ। ২৪ ফেব্র“য়ারি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন। বঙ্গবন্ধু ২৫ ফেব্র“য়ারি এই জাতীয় দলে যোগদানের জন্য দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও নেতাদের প্রতি আহবান জানান। তিনি বিদেশী সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বাঙালি জাতিকে আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করেন। তাই স্বাবলম্বিতা অর্জনের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক নীতিমালাকে নতুন ভাবে ঢেলে সাজান। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে মানুষের আহার, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজে সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসুচি ঘোষনা দেন যার লক্ষ ছিল-দুর্নীতি দমন, ক্ষেতে খামারে ও কল-কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। এই লক্ষে দ্রুত অগ্রগতি সাধিত করবার মানসে ৬ জুন বঙ্গবন্ধু জাতীয় দল বাংলাশে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।
সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে অভূতপূর্ব সাড়া পান। অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। চোরাকারবার বন্ধ হয়। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার আওতায় চলে আসে। নতুন আশা-উদ্দিপনা নিয়ে স্বধীনতার সুফল মানুষের ঘরে পৌঁছিয়ে দেবার জন্য দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিন্তু মানুষের সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয় না।
১৫ আগষ্টের ভোরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিজ বাসভবনে সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাষী অফিসার বিশ্বাসঘাতকের হাতে নিহত হন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী মহিয়ষী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেসা, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র মুক্তিযোদ্ধা লেঃ শেখ কামাল, পুত্র লেঃ শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্দুর ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলূল হক মনি ও তার অন্তঃসত্তা স্ত্রী আরজু মনি, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬জন সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনকে ঘাতকরা হত্যা করে।
জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যা
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগের চারজন সিনিয়র নেতা - সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে ঢাকার কারাগারে হত্যা করা হয়। হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা ভেবেছিল যদি সে চারজন রাজনীতিবিদকে যদি হত্যা করা হয় তাহলে পাল্টা অভ্যুত্থান হলেও সেটি রাজনৈতিক সমর্থন পাবেনা।–বিবিসি বাংলা
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ
১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহি জনতা বিপ্লবের পর তিনি রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ১৯শে নভেম্বর ১৯৭৬ সালে তাঁকে পুনরায় সেনাবাহিনীর চীফ অফ আর্মী স্টাফ পদে দায়িত্বে প্রত্যাবর্তন করা হয় এবং উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়। জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ৮ই মার্চ মহিলা পুলিশ গঠন করেন, ১৯৭৬ সালে কলম্বোতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন সম্মেলনে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশ ৭ জাতি গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৬ সালেই তিনি উলশি যদুনাথপুর থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খনন উদ্বোধন করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯শে নভেম্বর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৬ সালে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন, ১৯৭৭ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি একুশের পদক প্রবর্তন করেন এবং ২১শে এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন জিয়া দেশে আবার গণতন্ত্রায়ণের উদ্যোগ নেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর সিদ্ধান্ত নেন। দেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক ও সহনশীল অবস্থানের প্রতিযোগিতা সৃষ্টির আভাস দিয়ে তিনি বলেন
“ I will make politics difficult for the politicians”
১৯৭৮ সালের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনে মোট ১০ জন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, এ নির্বাচনে ১১ জন প্রার্থী মনোনয়ন দাখিল করেন। ২ জনের মনোনয়নপত্র বাছাই –এ বাদ পড়ায় বৈধভাবে মনোনীত প্রার্থীর সংখ্যা ৯ জন। ১ জন আপীল দাখিল করায় ও তাঁর আপীল গৃহীত হওয়ায় এবং কোন প্রার্থী প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করায় সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা ১০ জন ছিল। এরপর জিয়াউর রহমান মে মাসে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা এবং আস্থা যাচাইয়ের জন্য ৩০শে মে গণভোট অনুষ্ঠান ও হাঁ-সূচক ভোটে বিপুল জনসমর্থন লাভ করেন।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন
১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়া এই দলের চেয়ারপারসন (Chairperson)। রাষ্ট্রপতি জিয়া এই দলের সমন্বয়ক ছিলেন এবং এই দলের প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক এ. কিউ. এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এর প্রথম মহাসচিব ছিলেন। জিয়ার এই দলে বাম, ডান ও মধ্যপন্থীসহ সকল স্তরের লোক ছিলেন। বিএনপির সব থেকে প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এর নিয়োগ পদ্ধতি। প্রায় ৪৫% সদস্য শুধুমাত্র রাজনীতিতে নতুন ছিলেন তাই নয়, তারা ছিলেন তরুণ। ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টায় রমনা রেস্তোরাঁয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যাত্রা শুরু করেন। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণাপত্র পাঠ ছাড়াও প্রায় দুই ঘণ্টা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের আহবায়ক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি প্রথমে ১৮ জন সদস্যদের নাম এবং ১৯শে সেপ্টেম্বর ওই ১৮ জনসহ ৭৬ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, বিএনপি গঠন করার আগে ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে আরেকটি দল উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে সভাপতি করে গঠিত হয়েছিল। ২৮শে আগস্ট ১৯৭৮ সালে নতুন দল গঠন করার লক্ষ্যে জাগদলের বর্ধিত সভায় ওই দলটি বিলুপ্ত ঘোষণার মাধ্যমে দলের এবং এর অঙ্গ সংগঠনের সকল সদস্য জিয়াউর রহমান ঘোষিত নতুন দলে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তিনি রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২০৭টিতে জয়লাভ করে। নির্বাচনে অংশ নিয়ে আঃ মালেক উকিলএর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩৯টি ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২টি আসনে জয়লাভ করে। এছাড়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ৮টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ১টি ও মুসলিম ডেমোক্রেটিক লীগ ২০টি আসনে জয়লাভ করে।
৩০ মে, জিয়ার হত্যা কাণ্ডের সেই মর্মান্তিক ঘটনা
জেনারেল জিয়াউর রহমানের ইহ জগতের শেষ দিনটি ছিলো একেবারে সাদামাটা। বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে জেনারেল জিয়া নৌবাহিনীর প্রধান, রিয়ার এএডমিরাল এম, এ, খান এবং বিএনপি’র কয়েকজন নেতৃস্থানীয় সদস্য নিয়ে ঢাকা থেকে পতেঙ্গা এসে পৌঁছেন। বিএনপি নেতাদের মধ্যে ডঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সৈয়দ মহিবুল হাসান, ডঃ আমিনা রহমান, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা এবং রাজ্জাক চৌধুরী উল্লেখযোগ্য। বিমান বাহিনীর প্রধান ওয়ার ভাইস মার্শাল ছদরুদ্দীন, নগরীর পদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ এবং বিএনপি’র নেতৃবৃন্দ তাকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। ঔপনিবেশিক কায়দায় নির্মিত চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে পৌঁছালে জেনারেল জিয়াকে কিছু হালকা নাস্তা পরিবেশন করা হয়। নিরাপত্তা নিয়ম অনুযায়ী তাঁর নাস্তা প্রেসিডেণ্টের ব্যক্তিগত চিকিৎসক লেঃ কর্নেল মাহতাবুল ইসলাম খেয়ে পরীক্ষা করে এবং তারপর তাকে তা খেতে দেয়া হয়।
জেনারেল জিয়া প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে সার্কিট হাউসের বারান্দায় বিএনপি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে আলাপ-আলোচনা চালান। বেলা সাড়ে বারোটার দিকে জুম্মার নামাজের জন্য আলোচনা বন্ধ রাখা হয়। জিয়া পায়জামা-পাঞ্জাবী পরে চকবাজারের চন্দনপুরা মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে উপস্থিত মুসল্লী ও জনগণের সাথে কুশল বিনিময় করেন এবং কিছুক্ষণ তাদের সঙ্গে কাটিয়ে সার্কিট হাউসে ফিরে যান। এখানে তিনি দলীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দুপুরের খাবার খান। খাবার শেষে তিনি ঘণ্টা দেড়েক বিশ্রাম নেন। বিকেল ৫টায় উঠে চা পান করে তিনি নীচতলার বৈঠকখানায় চলে আসেন। সেখানে তাঁর জন্যে ৪৫ জন গণ্যমান্য ব্যক্তি অপেক্ষা করছিলেন। এদের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও কয়েকজন অধ্যাপক, বারের কিছু সদস্য, শহরের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ লোক এবং কয়েকজন সাংবাদিক। তাদের সঙ্গে জিয়া প্রায় আড়াই ঘণ্টা কথাবার্তা বলেন। তারপরে তিনি তার আসল কাজে মনোনিবেশ করেন। স্থানীয় বিএনপি’র দুই বিবদমান অংশের বিরোধ নিরসনের জন্যে তিনি আলাদা আলাদাভাবে তাদের সঙ্গে রাত ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত আলোচনা চালিয়ে যান। এর মাঝে তিনি চট্টগ্রামের কমিশনার সাইফুদ্দিন আহমেদ এবং মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বদিউজ্জামানের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। তারা জানায়, অন্ততঃ ৪০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশের তৎপরতা চলছে। তাদের কেউ বেআইনী জমি দখল, বেআইনী অস্ত্রবহন আবার কেউবা শহরে সন্ত্রাস সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এদের সকলেই বিএনপি’র সদস্য বিধায় পুলিশ তাদের ধরতে চেয়েও থমকে দাঁড়াচ্ছে বলে তারা প্রেসিডেণ্টকে জানান। জিয়া তাদেরকে তাঁর দল থেকে সরিয়ে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।
প্রেসিডেণ্টের ব্যক্তিগত ডাক্তার তাঁর খাবার পরখ করা শেষ করলে, রাত ১১টার একটু পরে তাকে রাতের খাবার পরিবেশন করা হয়। জীবনের শেষ খানা সেবন করে জিয়া তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ঢাকয় টেলিফোনে কথা বলেন। স্বামী-স্ত্রীর জীবনের শেষ কথোপকথন ১৫ মিনিট মত স্থায়ী হয়। জীবনের সব কাজ সাঙ্গ করে মধ্যরাতের খানিক পরে, জিয়া তাঁর জীবনের শেষ দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। জীবন বাতি নিভে যাবার মাত্র পাঁচ ঘণ্টা আগে জিয়া তাঁর নিজ হাতে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে ঘুমাতে গেলেন। বাইরে তখন তুমুল ঝড় আর বিদ্যুতের ঝলকানি। এর আগে অবশ্য তিনি সকাল পৌঁনে সাতটায় তাকে সকালের চা পরিবেশন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। নিশ্চিন্তে তিনি শুয়ে পড়লেন বিছানায়। অথচ, ঠিক সেই মুহূর্তেই জিয়াকে চিরনিদ্রায় শায়িত করার উদ্দেশ্যে চট্টলার ক্যাণ্টনমেন্টে ঘাতকের দল প্রস্তুতি নিচ্ছে।
জেনারেল মঞ্জুরের সংকেত পেয়ে সংশ্লিষ্ট অন্যান্যেরা লেঃ কর্নেল দেলোয়ার হোসেনের বাসভবনে ‘অভিযান পরিকল্পনা’ তৈরী করার জন্যে মিলিত হন। তখন বিকেল ৬টা। লেঃ কর্নেল মতিও রাঙ্গামাটি থেকে ফিরে এসেছে। উপস্থিত অন্যান্যরা হচ্ছে, লেঃ কর্নেল মাহবুব, লেঃ কর্নেল ফজলে হোসেন, মেজর খালিদ, মেজর লতিফুল আলম চৌধুরী এবং মেজর রওশন ইয়াজদানী ভূঁইয়া। লেঃ কর্নেল ফজলে হোসেনের মতে, তখন তারা দু’টি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করে। প্রথমটি হচ্ছে, সার্কিট হাউস থেকে জিয়াকে উঠিয়ে আনা। তাকে ব্যবহার করে ভাইস প্রেসিডেণ্ট সাত্তার, সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এরশাদ এবং উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের এখানে এনে তাদেরকে হত্যা করা। বিকল্প হচ্ছে, যদি ঐটি ব্যর্থ হয়, তাহলে জেনারেল জিয়াকে হত্যা করা হবে। মতি, মাহবুব এবং খালিদ জেনারেল জিয়াকে হত্যা করার চাইতে জিম্মী করার পক্ষপাতি ছিলো। কারণ এতে তারা তাদের কাজের জন্যে জনসমর্থন আদায়ে সক্ষম হতে পারবে।
ভিন্ন ভিন্ন ঘাতকদলের নেতাদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে বিশেষ বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়। ১১২ সিগন্যাল কোম্পানীর কমান্ডিং অফিসার মেজর মারুফ পরে এলে তাকে পরদিন ভোরবেলা নাগাদ ঢাকার সঙ্গে সকল যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিন্ন করে দেয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়। ষড়যন্ত্রকারী দল আগে থেকেই সার্কিট হাউসের ভেতর থেকে সহযোগিতা পাবার ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। দিনের বেলায় মতি তাল ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রেসিডেণ্টের প্রধান স্টাফ অফিসার লেঃ কর্নেল মাহফুজের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সে তাকে জানায় যে, তারা আজ রাতেই প্রেসিডেণ্টের জীবনের উপর হামলা চালাবে। তার পরিবর্তে মাহফুজও সম্ভব সকল প্রকার সহায়তা প্রদানের অঙ্গীকার করে। নিয়ম অনুযায়ী প্রেসিডেণ্টের শয়নকক্ষে যে দু’জন গার্ড থাকে , মাহফুজ তাদের সরিয়ে দয়ে। তাছাড়া, সে সরকারী প্রটোকল অফিসারের কাছ থেকে সার্কিট হাউসের কক্ষ বণ্টনের চার্টও সংগ্রহ করে এবং দিনের বেলায় ফিল্ড ইণ্টেলিজেন্সের মেজর মুজিবুর রহমান এলে, তার মাধ্যমে চার্টটি হানাদার বাহিনীর কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
জেনারেল মঞ্জুর আগে থেকেই কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন যেন, এ কাজ কোন সৈন্য ব্যবহার না করা হয়। মঞ্জুরের এ নির্দেশ সত্ত্বেও আঘাত হানার জন্যে সৈন্য যোগাড় করতে মেজর খালিদকে বলা হয়। সে তখন ব্রিগেড মেজর। কিন্তু তা সত্ত্বেও সৈন্য যোগাড় করা তার পক্ষে যথেষ্ট কষ্টকর হয়ে পড়ে। রাত প্রায় ৯টায় সে ফাস্ট ইস্ট বেঙ্গলের সুবেদার আবুল হাশিমকে ডেকে পাঠিয়ে নির্দেশ দেয়, তাকে ঐ রাতেই কিছু অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সৈন্য নিয়ে কালুরঘাটে যেতে হবে। খালিদ তাকে একটি টাকার তোড়া এগিয়ে দিয়ে সেগুলোকে সৈন্যদের বহর করার জন্যে ট্রাক ভাড়া করার কাজে ব্যবহার করতে বলে। সুবেদার হাশিম সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠে। টাকা নিতে অস্বীকার করে সে খালিদকে জিজ্ঞেস করেঃ ‘আমি সৈনিকদের এ টাকার ব্যাপারে কি বলবো?’ খালিদঃ তোমার যা খুশী একটা বলে দিও—কিংবা বলে দিও যে, “প্যারেডের সময় সিনেমা দেখার শাস্তি হিসেবে তাদেরকে এখন কালুরঘাটে যেতে হচ্ছে”। এতে সুবেদার হাশিম আরো বেশী সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠে। খালিদ তার উপর চটে গেলে, হাশিম এমনভাবে বেরিয়ে যায় যেন সে মেজরের হুকুম তামিল করার জন্যেই ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু সে তার সৈন্যদের যার যার জায়গায় পাঠিয়ে দিয়ে নিজে সোজা তার বাসায় গিয়ে পালিয়ে থাকে।
আধা ঘণ্টা পরে মেজর খালিদ ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের মেজর মোহাম্মদ মোস্তফাকে কিছু সৈন্য সরবরাহের জন্যে অনুরোধ জানায়। মেজর মোস্তফা ঘটনাটি সঙ্গে সঙ্গে তার ব্রিগেড কমান্ডার, ব্রিগেডিয়ার মোহসিনউদ্দীন আহমদ-এর কানে তুলে এবং বলে, ‘মেজর খালিদ সার্কিট হাউস থেকে প্রেসিডেণ্টকে উঠিয়ে আনার জন্যে ফাস্ট ইস্ট বেঙ্গলের কিছু ট্রুপ চাচ্ছে’। ব্রিগেডিয়ার মোহসিন উদ্দীন বলে, ‘খালিদ পাগল বনেছে নাকি? এক্ষণই তাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো।‘। ব্রিগেডিয়ার একজন সৈনিককেও ব্যারাক থেকে বেরুতে মানা করে। পরে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে ব্রিগেডিয়ার মোহসিন উদ্দীন জানায়, সে জিওসি, জেনারেল মঞ্জুরকে ব্যাপারটি জানাতে চাইলেও তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে তখন প্রেসিডেণ্টের নিরাপত্তা স্টাফ কিংবা গোয়েন্দা সংস্থাকে না জানিয়েই চুপচাপ বসে থাকে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই ষড়যন্ত্রকারীরা বুঝতে পারে যে, এ কাজের জন্যে কোন সৈন্যই তারা পাচ্ছে না। আঘাত হানার জন্যে তাদেরকে সম্পূর্ণভাবেই অফিসারদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। রাত দশটার দিকে লেঃ কর্নেল মাহবুব দু’জন অফিসারকে সার্কিট হাউসে পাঠিয়ে সেখানে কোন অস্বাভাবিক গতিবিধি চলছে কিনা তা রিপোর্ট করতে বলে। মেজর শওকত আলী এবং মেজর লতিফুল আলম চৌধুরী চট্টগ্রাম ক্লাবের দেয়ালে তাদের সশস্ত্র অবস্থান নেয়। সেখান থেকে সার্কিট হাউস পরিষ্কার দেখা যায়। অভিযান পরিপূর্ণভাবে শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানেই অবস্থান করে।
রাত গড়িয়ে যাচ্ছে দেখে ষড়যন্ত্রকারীরা সব কাজ তড়িঘড়ি করে সেরে নিতে সচেষ্ট হয়। রাত সাড়ে এগারোটায় মতি আর মাহবুব ২৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সেকেন্ড ইন কমান্ডের অফিসে ১১এবং ২৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সকল অফিসারকে ডাকা হয়। তাদের মধ্যে ৬ জন সেখানে উপস্থিত হয়। তারা হচ্ছে—মেজর মোমিন, মেজর গিয়াসউদ্দীন, ক্যাপ্টেন মুনির, ক্যাপ্টেন জামিল, ক্যাপ্টেন মইনুল ইসলাম এবং ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দীন আহমেদ। মতি দরজা তালাবন্ধ করে একখানা পবিত্র কোরআন শরীফ নিয়ে আসে। সে সমবেত সকলের কাছে থেকে শপথ করিয়ে নেন।
তারপর অস্ত্র, পোশাক ইত্যাদি নিয়ে তারা সকলেই সমরসাজে সজ্জিত হয়। তাদরে সঙ্গ ছিলো সাব-মেশিনগান (এসএমজি) আর প্রচুর পরিমাণে গোলাবারুদ।
৬ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল ফজলে হোসেনও তার হেড কোয়ার্টারে একই নাটকের অবতারণা করে। ফজলে লেঃ রফিকুল হাসান খানকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমি যেখানে যেতে চাচ্ছি, তুমি কি আমার সঙ্গে সেখানে যাবে?” রফিকুল জবাব দেয়ঃ স্যার, আপনার নির্দেশ পেলে অবশ্যই যাবো। তারপর ফজলে লাইনের অন্যান্য অফিসারদের ডেকে পাঠায়। তাদের মধ্যে উপস্থিত হয়, মেজর দোস্ত মোহাম্মদ, ক্যাপ্টেন ইলিয়াস, ক্যাপ্টেন আরেফীন এবং লেঃ মোসলেহ উদ্দীন। ফজলে উপস্থিত অফিসারদের উদ্দেশ্যে বলেঃ ‘তোমরা জানো, দেশের অবস্থা খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীকে বহুলাংশে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আজ এবং কাল এই দু’দিন প্রেসিডেণ্ট এখানে আছেন। এ ব্যাপারে এরই মধ্যে আমাদের কিছু একটা করে নিতে হবে। আমরা মনস্থ করেছি, আজই আমরা প্রেসিডেণ্টের সঙ্গে দেখা করে তাকে বিষয়টা অবগত করাবো। তোমরা কে কে আমার সঙ্গে যেতে রাজী আছো? একবাক্যে সকলেই রাজী হয়ে গেলে ফজলে একখানা পবিত্র কোরআন শরীফ এনে তাদেরকে শপথ করিয়ে বলে, ‘আমাদের মিশন পুরোপুরিভাবে স্বার্থক/সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের কেউ আমার সঙ্গ ত্যাগ করতে পারবে না’।
৩০শে মে, রাত আড়াইটার দিকে ‘ঘাতকদল’ কালুরঘাটস্থ রেডিও ট্রান্সমিটারের কাছাকাছি তাদের নির্ধারিত মিলন স্থলে এসে হাজির হতে থাকে। এই সেই জায়গা যেখান থেকে ১৯৭১-এর মার্চ মাসে জেনারেল জিয়া খ্যাতির সিঁড়িতে পা রাখেন। তখন বিজলী, বজ্রপাতসহ প্রচণ্ড বেগে বাতাস বইছিলো আর মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিলো। তিনজন সঙ্গী নিয়ে লেঃ কর্নেল মাহবুব তার সাদা টয়োটা গাড়িতে চড়ে আসে। এক ঘণ্টার মধ্যেই সেখানে ১৮ জন অফিসার আর দু’জন জেসিও এসে জড়ো হয়। ঐ সময় সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে ফাস্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড, মেজর ফজলুল হক ৪০ জন সৈন্যের দু’টি প্লাটুন নিয়ে এসে হাজির হয়। মেজর খালিদ তাদের উদ্দেশ্যের কথা ব্যক্ত করলে তারা তাদের সঙ্গে যোগ দিতে জোর গলায় অস্বীকার করে। তাদেরকে পরে লেঃ মতিউর রহমানের অধীনে কালুরঘাট ব্রীজের অপর পাড়ে বান্দরবন সড়কে রেখে আসার নির্দেশ প্রদান করা হয়।
বিদ্রোহে যোগদানের ব্যাপারে সাধারণ সৈনিকদের অস্বীকৃতি জিয়া হত্যা ঘটনার একটি অসাধারণ দিক।
সৈনিকদের নৈশকালীন প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর ব্যবস্থা থাকায় সশস্ত্র লোকদের ক্যাণ্টনমেণ্টের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারটি কারো নজরে পড়েনি। তাছাড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঐ সময়ে যথেষ্ট শিথিল ছিলো। চট্টগ্রামের স্থানীয় নিরাপত্তা ইউনিট তৎপর না থাকায় ব্যাপারটি সময় মতো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আসতে পারেনি।
ঘাতকদলের নেতৃত্ব দেয় লেঃ কর্নেল মতিউর রহমান। তাদের সঙ্গে ছিলো ১১টি এসএমজি, তিনটি রকেট ল্যান্সার এবং তিনটি গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেল। সে ঐ সবগুলো অস্ত্রে সঠিকভাবে গোলাবারুদ ভর্তি করা হযেছে কিনা এবং ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা, পরীক্ষা করে নেয়। ১৬ জন অফিসারকে একটি পিকআপে গাদাগাদি করে উঠানো হয়। ‘সার্কিট হাউস এবং থাকার ঘরের একটি নকশা দেখিয়ে মতি তাদেরকে পুরো অভিযান পরিকল্পনাটি বুঝিয়ে দেয়। তারপর সে একখানা পবিত্র কোরআন শরীফ দিয়ে তাদের সকলে শপথ নবায়ন করে নিয়ে সজোরে ঘোষণা করেঃ ‘আমরা আজ প্রেসিডেণ্টকে হাতের মুঠোয় পাবার জন্যে এগিয়ে যাচ্ছি’।
ঘাতক বাহিনী তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে আক্রমণ চালানোর কথা। পরিকল্পনা মতে, দু’টি দল সার্কিট হাউসে ঢুকে আক্রমণ পরিচালনা করবে এবং একটি দল সার্কিট হাউসের পেছনে আলমাস সিনেমা হলের কাছে অবস্থান নেবে। কেউ যদি সার্কিট হাউস থেকে পালাতে চেষ্টা করে তাকে গুলি করে হত্যা করা হবে। প্রথম দলে কে কে থাকতে ইচ্ছুক জিজ্ঞেস করা হলে অনেকই এতে ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু তাদের মধ্যে থেকে মাত্র ছ’জনকে বাছাই করে নেয়। এই ছ’জন ঃমাহবুব, ফজলে, খালিদ, জামিল হক, আব্দুস সাত্তার আর লেঃ রফিকুল হাসান খান। ফজলে এ দলের নেতৃত্ব দেবে এবং গাড়ী চালাবে মাহবুব। ৯ নম্বর কক্ষে প্রেসিডেণ্ট জিয়ার উপর আঘাত হানার দায়িত্ব দেয়া হয় ফজলে আর ক্যাপ্টেন সাত্তারকে।
লেঃ কর্নেল, মতি নিজে থাকলো দ্বিতীয় দলে। তার সঙ্গে থাকলো মেজর মোমিন, মেজর মোজাফফর, ক্যাপ্টেন ইলিয়াস, ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন আর লেঃ মোসলেহউদ্দিন। প্রথম দলটিকে দ্বিতীয় দলটি পেছন থেকে সহায়তা করে। মেজর গিয়াসউদ্দিন আর ফজলুল হক, ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আর মুনিরকে নিয়ে গঠিত হয় তৃতীয় দলটি।
রাত সাড়ে তিনটার সামান্য কিছু পরে দল তিনটি কালুরঘাট থেকে প্রচন্ড বৃষ্টির মাঝে আস্তে আস্তে গাড়ী চালিয়ে সামনে এগোতে শুরু করে। যুবক লেফটেন্যান্ট রফিক প্রথম দলের পিকআপে বসে কম্পিত স্বরে ফজলেকে জিজ্ঞেস করেঃ ‘আপনারা কি প্রেসিডেণ্টকে খুন করতে যাচ্ছেন? কর্নেল ফজলে তাকে জানায়, ‘না’ আমরা কেবলই তাকে তুলে আনতে যাচ্ছি’। কথা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, শেষ মুহূর্তেও দলের অনেক সদস্য বিশ্বাস করতো যে, তারা প্রেসিডেন্টকে তুলে নিয়ে এসে জিম্মী করে রাখতে যাচ্ছে।
ঘাতকদল দু’টি বিনা বাধায় সার্কিট হাউসে ঢুকে পড়ে। লোহার তৈরী বিরাট বড় সদর দরজাটি অজ্ঞাত কারণে সে রাতে খুলে রাখা হয়েছিলো। পাহারারত চারজন প্রহরী ঘাতক বাহিনীকে বিনা প্রশ্নে ভেতরে যেতে পথ করে দিলো। এ সময় লেঃ কর্নেল ফজলে হোসেন তার হাতের রকেট ল্যান্সার থেকে পরপর দু’টি ফায়ার করে। গোলা দু’টি জিয়ার শয়নকক্ষের ঠিক নীচের দিকে বিরাট দু’টি গর্ত সৃষ্টি করে। সার্কিট হাউসে অবস্থানরত সকলকে ভয় পাইয়ে দিতে এবং ঘাতকদের অন্যান্য দলকে সংকেত দেয়ার জন্যেই ঐ প্রাথমিক বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সঙ্গে সঙ্গেই বাকী দলীয় সহযোগীরা গ্রেনেড, রকেট আর মেশিন গান থেকে গুলি চালাতে শুরু করে। এতে করে সামান্য দু’একজন প্রতিরোধ সৃষ্টিকারীকে একেবারে ধূলোয় মিলিয়ে দেয়া হয়। চট্টগ্রাম ক্লাবের দেয়ালে দর্শকের ভূমিকায় অবলোকনরত দুই মেজরের একজন পরে জানায়, সিনেমায় ছবিতে প্রদর্শিত কমান্ডো আক্রমণের মত সেদিনের হামলা পরিচালিত হয়েছিলো।
নিরাপত্তা রক্ষীদের মধ্যে পুলিশ কনস্টেবল দুলাল মিঞা পোর্টিকোতে প্রহরারত অবস্থায় মাথায় গুলি খেয়ে প্রথম প্রাণত্যাগ করে। পাহারারত বাকী ৪৪ সশস্ত্র পুলিশের কেউ কোন রকম প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেনি। তাদের কেউ কেউ ছুটে গিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালায়। ঘাতকদলের এলোপাথাড়ি গোলাগুলি আর ছোটাছুটির কারণে আরো ১২ জন পুলিশ আহত হয়।
ঐ সময় কর্তব্যরত প্রেসিডেন্টের গার্ড রেজিমেণ্টের সৈন্যরাও তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলো। যে দু’জন সৈন্য প্রেসিডেন্টের কক্ষের সামনে পাহারারত থাকার কথা , তাদের একজনকে নীচতলায় মৃত এবং অন্যজনকে তার কোয়ার্টারে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। নীচতলার সৈন্যেরা সম্ভবতঃ প্রেসিডেন্টের কক্ষের দিকে যেতে চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু এর আগেই তাদেরকে খতম করে দেয়া হয়।
আশ্চর্যজনকভাবে সার্কিট হাউসের নিরাপত্তা প্রহরীদের গুলিতে হানাদার দলের কেউ নিহত বা আহত হয়নি। তাদরে দু’জ নিজেদের লোকদের গুলিতেই আহত হয়েছিলো। এর মধ্যে লেঃ কর্নেল ফজলে হোসেন পেছনের দলের বেপরোয়া গুলিতে ঘোরতর আহত হয়ে অভিযান থেকে সরে পড়ে। ক্যাপ্টেন জামিলও ঠিক সেভাবেই আহত হয়েছিলো। কিন্তু যেভাবেই হোক, আহত শরীরে জামিল সার্কিট হাউসের দু’তলায় বেয়ে উঠে এবং নায়েক রফিকউদ্দিনকে গুলি করে আহত করে। প্রেসিডেন্টের প্রধান নিরাপত্তা অফিসার লেঃ কর্নেল মইনুল আহসান এবং ক্যাপ্টেন আশরাফুল খান তখন দু’তলায় প্রেসিডেণ্টের পেছনের কক্ষে ঘুমুচ্ছিলো। রকেটের আওয়াজে তারা জেগে উঠে। তারা তাদের অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পাবার আগেই আক্রমণকারীদের গুলিতে নিবেদিত প্রাণ এই দুই অফিসারের নিষ্প্রাণ দেহ বারান্দায় লুটিয়ে পড়ে।
পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট পেছনের ঘাতকদলটি কর্নেল মতিসহ এই সময়ে দু’তলায় অন্যান্য আক্রমণকারীদের সঙ্গে প্রেসিডেণ্টের ৯ নম্বর কক্ষ খুঁজতে শুরু করে। ক্যাপ্টেন সাত্তার লাথি মেরে ঐ দরজা ভেঙ্গে ফেলতেই সে দেখে ঘরে অবস্থানরত ডঃ আমিনা রহমান। ফলে প্রেসিডেণ্টের খোঁজে ওরা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে থাকে। ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দীন এ সময় উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলতে থাকে , ‘প্রেসিডেণ্ট কোথায়? প্রেসিডেণ্ট কোথায়?’ কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা বুঝতে পারে যে, প্রেসিডেণ্ট ৪ নম্বর রুমে অবস্থান করছেন। রুমটি সিঁড়ির গোড়ায়। রুমের একটি দরজা সিঁড়ির দিকে আর একটি দরজা বারান্দার দিকে। ক্যাপ্টেন সাত্তার লাথি মেরে বারান্দার দিকের দরোজাটি ভাঙ্গতে চেষ্টা করে। হঠাৎ করে তাদের একজন চিৎকার করে বলতে থাকে ঃ ‘প্রেসিডেণ্ট বেরিয়ে আসছেন’। এক মুহূর্ত পরেই আর একজন চিৎকার করে বলে উঠেঃ ‘এইতো প্রেসিডেণ্ট’।
সাদা পায়জামা পরা উষ্কখুষ্ক চুলে প্রেসিডেণ্ট অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসেন। তাঁর হাত দু’টি সামনের দিকে উঁচিয়ে প্রেসিডেণ্ট দৃঢ়কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘তোমরা কি চাও?’
প্রেসিডেণ্টের সবচেয়ে কাছে ছিলো মেজর মোজাফফর আর ক্যাপ্টেন মোসলেহউদ্দীন। মেজর মোজাফফর দৃশ্যতঃ ভয়ে কাঁপছিলো। মোসলেহ উদ্দীন প্রেসিডেণ্টকে আশ্বস্ত করতে চাইছিলো। সে বলছিলো। স্যার, আপনি ঘাবড়াবেন না। এখানে ভয়ের কিছুই নেই, কি আশ্চর্য! ঐ দু’জন অফিসার তখনও মনে করছে, তারা প্রেসিডেণ্টকে উঠিয়ে নিতে এসেছে, হত্যা করতে নয়। লেঃ কর্নেল মতিও কাছাকাছিই ছিলো। কিন্তু প্রেসিডেণ্ট জিয়ার প্রতি তার বিন্দুমাত্রও দয়ামায়া ছিলো না। সে প্রেসিডেণ্টকে একটুও সুযোগ দিলো না। মোসলেহ উদ্দীনের ঠোঁট থেকে জিয়ার প্রতি তার আশ্বাসের বাণী মিলিয়ে যাবার আগেই মতি তার এসএমজি থেকে গুলি চালিয়ে দেয়। ঝাকে ঝাকে গুলি এসে জিয়ার শরীরের ডানদিকে একেবারে ঝাঁঝরা করে ফেলে। দরজার কাছেই জিয়া মুখ-থুবড়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। রক্তের বন্যায় তার সমস্ত শরীর ভেসে যেতে থাকে। খুনের নেশায় ঘাতক মতি পাগল হয়ে উঠে। সে তার বন্দুকের নল দিয়ে প্রেসিডেণ্ট জিয়ার প্রাণহীন দেহ উল্টিয়ে নেয়। তারপর জিয়ার মুখমন্ডল আর বুকের উপর তার এসএমজির ট্রিগার টিপে রেখে ম্যাগজিন খালি করে তার খুনের নেশা মিটিয়ে দেয়। গুলির আঘাতে জিয়ার মাথা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। কি ধরনের ক্ষোভ কর্নেল মতি তার মনের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিলো, যার বহিঃপ্রকাশ এতটা মর্মান্তিক আর নৃশংসরূপ নিয়েছিলো ! জিয়াকে নৃশংসভাবে খুন করে খুনীরা ঝটপট সার্কিট হাউস ছেড়ে চলে যায়। দু’জন আহত সঙ্গীকেও তারা সঙ্গে নিয়ে যায়। পুরো নৃশংস হত্যাকান্ডটি ২০ মিনিটেরও কম সময়ে সম্পন্ন হয়েছিলো।
১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ, স্বৈরাচারী এরশাদের ক্ষমতা দখল
৩০ মে ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হবার পর, এরশাদের রাজনৈতিক অভিলাষ প্রকাশ হয়ে পড়ে। ২৪ মার্চ ১৯৮২ সালে এরশাদ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ১১ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সাল নাগাদ তিনি প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন। ঐ দিন তিনি দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এ.এফ.এম আহসানুদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকে নিজের অধিকারে নেন। এরশাদ দেশে উপজেলা পদ্ধতি চালু করেন । চলবে... 
//