৭১ বছরে পা রাখছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


RU Correspondent | Published: 2023-07-06 01:46:14 BdST | Updated: 2024-05-17 18:18:02 BdST

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই যাত্রা শুরু করে। উত্তরাঞ্চলের মানুষের পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলেও বর্তমানে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির গৌরব ও ঐতিহ্য বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। আগামীকাল ৬ জুলাই, ৭১ বছর বয়সে পা রাখবে দেশের অন্যতম প্রাচীন এই বিদ্যাপিঠ।

তবে প্রতিষ্ঠার শুরুতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানের স্থানে ছিল না। দুইটি অনুষদের (কলা ও আইন) ছয়টি বিভাগ (বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, আইন, দর্শন ও অর্থনীতি) নিয়ে প্রথম যাত্র শুরু হয়। ১৯৫৩-৫৪ সেশনে পোস্ট-গ্রাজুয়েট কোর্সের মাধ্যমে রাজশাহী কলেজে ১৫৬ জন ছাত্র, ৫ জন ছাত্রী ও ২০ জন শিক্ষক নিয়ে শুরু হয়। প্রথম অনার্স কোর্স চালু হয় ১৯৬২ সালে। কালের বিবর্তনে বর্তমানে বর্তমানে বিদেশি ও সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স কোর্সের শিক্ষার্থী ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত মোট ২৬ হাজার ৩১৫ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। এর মধ্যে ছাত্রী রয়েছে ৯ হাজার ৩৪৬ জন ও ছাত্র সংখ্যা ১৬ হাজার ৯৬৯।

প্রতিষ্ঠালগ্নে রাজশাহী কলেজের কাছে পদ্মাপারে অবস্থিত ডাচদের তৈরি বড়কুঠিতে উপাচার্যের প্রথম অফিস বসানো হয়। ছাত্রদের থাকার জন্য শহরের বিভিন্ন ভবন ভাড়া করা হয়। রাজশাহী কলেজ সংলগ্ন ফুলার হোস্টেলকে করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রাবাস। আর ছাত্রী নিবাস করা হয় বড়কুঠি এলাকার লালকুঠি ভবন। প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পর ১৯৫৮ সালে শুরু হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান মতিহার ক্যাম্পাসে ভবন নির্মাণের কাজ। ১৯৬৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম বর্তমান ক্যম্পাসে স্থানান্তর করা হয়। সে সময় ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ৫টি হল নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে ছাত্রদের ৪টি (শেরে বাংলা ফজলুল হক হল, শাহ্‌ মখদুম হল, নবাব আব্দুল লতিফ হল ও সৈয়দ আমীর আলী হল) ও ছাত্রীদের ১টি (মন্নুজান হল)। কালের বিবর্তনে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট আবাসিক হল রয়েছে ১৭টি। যার মধ্যে ছাত্রী হলের সংখ্যা ৬টি ও ছাত্রদের রয়েছে ১১টি আবাসিক হল। এছাড়া ১০ তালা করে দুটি হল নির্মাণাধীন রয়েছে।

বর্তমানে প্রায় ৭৫৩ একর বা ৩০৪ হেক্টর এলাকাজুড়ে রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১০টি অনুষদের অধীনে ৫৯ টি বিভাগ ও ৫টি উচ্চতর গবেষণা ইনস্টিটিউট রয়েছে।

তবে দীর্ঘ ৭০ বছরে শিক্ষক-শিক্ষাথীর সংখ্যায় কলেবর বাড়লেও বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দেশের শিক্ষা সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, গবেষণা ও অবকাঠামোসহ বিভিন্ন দিকে এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপকরা বলছেন, প্রশাসনিক দুর্বলতা, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সমস্যা, রাজনীতিকীকরণ, দুর্নীতি অগ্রগতির পিছে প্রধান অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম কনক বলেন, যেকোনো প্রতিষ্ঠান ৫০ বছর অতিক্রম করলে তাকে প্রাচীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে অভিহিত করা যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রাচীনতম ও শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি। জাতির প্রত্যাশা অনুযায়ী এ প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করেছে সাধ্যমত জনশক্তি তৈরি করতে। কিন্তু একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে রাষ্ট্রের যে লক্ষ্য থাকে সে জায়গায় আমরা অনেকটাই পিছিয়ে আছি। আন্তজার্তিকভাবে স্বীকৃত যে র‍্যাংকিং সেখানে রাবি সহ আমাদের দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। দলীয় রাজনীতিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা থেকে আলাদা করলে শিক্ষকরা স্বাধীনভাবে চিন্তা করে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। শিক্ষা ও গবেষণায় অধিক মনোযোগী হবে এবং সে সুযোগ অধিক তৈরি হবে। সরকারি হস্তক্ষেপ যত কম থাকবে ততই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য ও উচ্চতর গবেষণার জন্য মঙ্গলজনক হবে।

অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, রাজশহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল এই অঞ্চলের মানুষের শিক্ষাগত দিক দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কারণ সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ওই অঞ্চলের তুলনায় এদিকের খুব কম সংখ্যক মানুষ সেখানে পড়তে যেত। রাবি প্রতিষ্ঠার পর এই অঞ্চল তথা পুরো বাংলাদেশের শিক্ষার হার ক্রমেই বেড়েছে। এছাড়া মহান মুক্তিযুদ্ধ সহ যেকোনো জাতীয় আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তবে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম হচ্ছে। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ। তবে পূর্বের তুলনায় গবেষণার সংখ্যা বেড়েছে। এক্ষেত্রে প্রশাসনের উচিত গবেষণায় বাজেট বৃদ্ধি করা এবং রিসার্স পেপার যেন শুধু দেশীয়ভাবে প্রকাশ না করে আন্তজার্তিকভাবে প্রকাশের ব্যবস্থা করা। এছাড়া শিক্ষক নিয়োগে বিতর্কিত নীতিমালা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে সামগ্রিকভাবে আমাদের এই ৭০ বছরে যে লক্ষ্য অর্জনের কথা ছিল তা সম্ভব হয়নি।

উপ-উপাচার্য সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, ১৯৫৩ সালে অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়েই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটা সবারই প্রত্যাশা যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ কিংবা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেককেই নিজ নিজ দায়িত্বটুকু পালন করতে হবে। তবে সার্বিক বিবেচনায় যথেষ্ট উন্নতি হলেও কিছু জায়গায় এখনো আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজের মধ্যে একটি হচ্ছে গবেষণা। এটি ঐচ্ছিক নয়, আবশ্যিক একটি কাজ। আমরা ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করেছি। যেখানে প্রতিটি বিভাগের শিক্ষকদের গবেষণা সংযুক্ত করা হয়েছে। গবেষণা বৃদ্ধির জন্য এবার আমরা শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি নীতিমালা পরিবর্তন করে গবেষণার বিষয়টি সংযুক্ত করেছি। এখন সব অনুষদের শিক্ষকদের গবেষণা করতে হবে। এ জন্য প্রতিটি অনুষদের অধিকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সিনেট নির্বাচন করার জন্য ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছি। কারণ সিনেট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন। সিনেটের মাধ্যমে অনেক বিষয় আইনে পরিণত হয় কিংবা আইনসিদ্ধ হয়। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেটি চালু করার লক্ষ্যে কাজ করছি। সার্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির লক্ষ্যে সমস্যাগুলো নিয়ে প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে।