বিষাক্ত পার্থেনিয়ামে ছেয়ে গেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সবুজ ঝোপ আকৃতির সাদা ফুলবিশিষ্ট গাছগুলো দূর থেকে দেখতে সাধারণ কোনো আগাছা মনে হলেও এটি মূলত নর্থ-আমেরিকান প্রজাতির একটি বিষাক্ত আগাছা। এর আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত পুরোটাই ক্ষতিকর। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সবার জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেসিয়ামের পাশে, মেডিকেল সেন্টারের সামনে, বিনোদপুর গেটের পাশে, নবনির্মিত শেখ হাসিনা হলের সামনে, ডরমিটরির পাশে, মতিহার হল, বঙ্গবন্ধু হল, লতিফ হলসহ প্রায় প্রতিটি হলের আশেপাশে এই আগাছাটিতে ভরে গেছে। অ্যাকাডেমিক ভবন এলাকাতেও এর উপস্থিতি রয়েছে। এমনকি শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলসমূহের রুমের পাশেও শিকড় গেড়েছে এই বিষাক্ত আগাছাটি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পার্থেনিয়াম (ইংরেজিতে Parthenium) আগাছাটি ডেজি পরিবারের মধ্যে সূর্যমুখী উপজাতের উত্তর আমেরিকান গুল্ম প্রজাতির বংশধর। শিরাযুক্ত, নরম কাণ্ডবিশিষ্ট একবর্ষজীবী গুল্মজাতীয় এ আগাছার নাম গ্রিক শব্দ (parthenos) থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ ‘কুমারী’ বা (parthenion)। এটির উৎপত্তি উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার সাব ট্রপিক্যাল অঞ্চল, মেক্সিকো ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে। বিশ্বের ২০টিরও বেশি দেশে এটি ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ আগাছার উচ্চতা দুই থেকে তিন ফুট, আয়ুকাল তিন থেকে চার মাস। চিকন সবুজ পাতার ফাঁকে ছোট ছোট সাদা ফুলে আকর্ষণীয় দেখায় গাছগুলোকে। ত্রিভুজের মতো ছড়িয়ে থাকে এর অসংখ্য শাখা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক ড. আজিজুর রহমান বলেন, এই আগাছাটির ফুলের রেণুতে রয়েছে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ। ফলে নিশ্বাসের সঙ্গে নাকে প্রবেশ করলে জ্বর, হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টের সৃষ্টি হয় এবং ক্ষতস্থানে রক্তের সাথে মিশে চর্মরোগের সৃষ্টি করে। এছাড়া যাদের অ্যালার্জি রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এর রস তাদের চামড়ায় লাগলে সেখানে ক্যান্সার হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, একটি পার্থেনিয়ামের আগাছা থেকে জন্ম নিতে পারে প্রায় ৪-৫ হাজার আগাছা। তাছাড়া এর বীজ হালকা ও প্যারাসুটের ন্যায় হওয়ার কারণে দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে এর বংশবিস্তারও দ্রুত হয়। আগাছাটির ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবগত থাকলেও সেগুলো কাটার ব্যাপারে বরাবরের মতোই উদাসীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এদিকে আগাছাটির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অবগত নন অধিকাংশ শিক্ষার্থী। দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার, বিনোদপুর গেইট এবং ক্যাম্পাসে খেলার মাঠে বিভিন্ন জায়গায় ঝোপের ভেতর দিয়ে অনায়াসেই চলাচল করছেন শিক্ষার্থীরা। ফলে নিজের অজান্তেই বাড়ছে চর্মরোগ, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট ও ক্যান্সারের মতো জটিল রোগসমূহে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী রহমান উল্লাহ বলেন, বিষাক্ত আগাছাগুলো নিয়ে শিক্ষার্থীরাও তেমন অবগত নয়। যার কারণে হয়তো নির্দ্বিধায় আমরা সেগুলোর সংস্পর্শে চলে যাচ্ছি এবং বিভিন্ন ধরনের রোগের ঝুঁকিতে পড়ছি। এগুলো অতিদ্রুত পরিষ্কারের জন্য প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাবরিনা নাজ বলেন, শুধু ক্যাম্পাস নয় বিষাক্ত ও ভয়ানক আগাছা পার্থেনিয়াম দিয়ে ভরে গেছে সারা দেশ। পার্থেনিয়াম নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি ও এর বিস্তার রোধে করণীয় নির্ধারণে রাবিতে খুব শীঘ্রই একটি সেমিনার আয়োজনের চিন্তা করছি। আমাদের ক্যাম্পাসের অধিকাংশ শিক্ষক শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে কিছু জানেন না। বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের সম্মতিক্রমে প্রশাসন থেকে যাতে এগুলোকে দূর করা যায় সে পদক্ষেপ নেওয়া হবে খুবই দ্রুত।
এসব ক্ষতিকর দিক পর্যালোচনা করে কৃষিবিদরা গাছটিকে পুড়িয়ে ফেলতে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। সতর্ক না হলে যেকোনো ব্যক্তি বিপদের সম্মুখীন হতে পারেন। যেমন-এটি কেউ কাটতে গেলে ওই ব্যক্তির হাতে-পায়ে লাগতে পারে। পোড়াতে গেলে ফুলের রেণু দূরে উড়ে বংশবিস্তার করতে পারে। আবার ব্যক্তির নাকে-মুখেও লাগতে পারে। তাতে তিনি মারাত্মক বিষক্রিয়ায় পড়তে পারেন। এ ক্ষেত্রে খুব সতর্কতার সঙ্গে প্রথমে গাছটিকে কাটতে হবে। হাতে গ্লাভস, চোখে চশমা থাকলে ভালো হয়। অবশ্যই পা ভালোমতো ঢেকে রাখতে হবে। মোটা কাপড়ের প্যান্টের সঙ্গে বুটজুতা পরা যেতে পারে, সঙ্গে মোটা কাপড়ের জামাও পরতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, বিষাক্ত এই আগাছা সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। যারা পরিবেশ নিয়ে কাজ করে তাদের সাথে সমন্বয় করে আমরা খুব দ্রুত প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করব। ক্যাম্পাস থেকে যাতে এটিকে সমূলে উৎপাটন করা যায় সে ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া সচেতনতা তৈরিতে আমরা ক্যাম্পাসে প্রচার প্রচারণা চালাব।