আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সন্ধ্যার পর চামচিকারা কিচকিচ করে


Prothom-alo.com | Published: 2017-08-09 05:05:57 BdST | Updated: 2024-05-12 08:04:02 BdST

ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায় আমার ল্যাবরেটরি সপ্তাহের সাত দিন চব্বিশ ঘণ্টাই খোলা থাকে। আমাদের সবার কাছে চাবি থাকে। যে যখন ইচ্ছে তখনই গিয়ে কাজ শুরু করে দেন। দুনিয়ায় একেকজন মানুষ একেক সময়ে প্রোডাকটিভ। কেউ ভোরবেলায় পড়েন। কেউ পড়েন ভর দুপুরে। কেউ আবার মাঝরাত ছাড়া পড়তে পারেন না। গবেষণার বিষয়টাও এমন। তাই দিন-রাত সব সময় সেখানে প্রবেশাধিকার থাকতে হয়। আমার ল্যাবে কয়েকজন কাজ-পাগল তরুণ আছেন। তারা কখন ঘুমান আমি জানি না। ক্লান্তি তাঁদের স্পর্শ করে না। একটা ছেলে রীতিমতো ল্যাবকে ঘর বানিয়েছেন। কাজ ছাড়া তার কোনো কাজ নেই। তিনি পোস্টডক করছেন। আমেরিকান ছেলে। বয়স আটাশ। যথারীতি তার পঁয়ত্রিশের ওপরে বৈজ্ঞানিক আর্টিকেল আছে।

একজন পিএইচডি স্টুডেন্ট আছেন, যিনি লাঞ্চের পর ল্যাবে আসেন। এই ছেলেটা কাজ করবে রাত দুইটা-তিনটা পর্যন্ত। কখনো কখনো তিনি ল্যাবের করিডরে ঘুমান। সকালে গিয়ে আমরা তাঁকে ডেকে দিই। আমার প্রফেসর তাঁকে অসম্ভব পছন্দ করেন। কারণ ছেলেটা তুখোড় ছাত্র। তাঁর জীবনের প্রথম পাবলিকেশন তিনি করেছেন ‘সায়েন্স’ জার্নালে। এই সব মেধাবী ও কর্মপাগল মানুষদের সান্নিধ্যে থাকা খুব জরুরি। এদের সান্নিধ্যে থাকলে, আপনার ভেতর ঘুমিয়ে থাকা স্বপ্নগুলো জেগে যাবে। স্বপ্নরা তাড়া দেবে। এমন মানুষদের সঙ্গে থেকে নিজের ভেতরের সম্ভাবনাকে বের করা যায়।
যা হোক, আমেরিকার অন্যান্য ল্যাবগুলোও এমনই। দিন-রাত খোলা থাকে। ইউরোপেও তাই। যদিও সেখানে কাজের সংস্কৃতি কিছুটা ভিন্ন। স্টকহোমে থাকাকালে যখন-তখন ল্যাবে গিয়ে কাজ করতে পারতাম। ক্যাম্পাস ছিল অভয়ারণ্য। চীন-জাপানেও দিন-রাত কাজ হচ্ছে। এই সব দেশগুলো কাজের পরিবেশ তৈরি করে তরুণদের ব্যস্ত রাখে। সেসব তরুণদের মধ্য থেকে কর্ম-পাগল মানুষ তৈরি করা হয়। আর এইসব মানুষেরা সমাজকে বদলে দেন। সমাজের তরুণেরা যখন উদ্ভাবন-সৃষ্টির নেশায় দিন-রাত কাজ করেন, সেটা আশীর্বাদ হয়ে আসে। যে সমাজের তরুণেরা যত কম বয়সে সৃষ্টির নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন, সে সমাজ ততই শক্তিশালী হয়।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সন্ধ্যার পর ভুতুড়ে হয়ে থাকে। চামচিকারা কিচকিচ করে। আমরা ভূতের ভয়ে ছাত্র-শিক্ষক মিলে বাড়িতে গিয়ে বসে থাকি। ভূতের আছর থেকে বেঁচে গিয়ে আমরা দেশ নিয়ে বড় বড় স্বপ্ন দেখি। বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে একদিন মাথা তুলে দাঁড়াবে—এটা হলো আমাদের স্বপ্ন। কিন্তু আমরা কী কখনো গভীরভাবে ভাবি যে, এমন একটা স্বপ্ন পূরণ করতে হলে কি দরকার! যেদিন বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াবে সেদিন কি ইউরোপ-আমেরিকা কিংবা চীন-জাপান বসে থাকবে? যেদিন আমরা মহাকাশে যান পাঠাব, সেদিন এই সব দেশ মহাকাশ দখল করে বসে থাকবে। যেদিন আমরা একটা ড্রাগ বানাব, সেদিন তারা ডিএনএর গঠন পরিবর্তন করে জন্মনিয়ন্ত্রণ করবে, যেন মানুষ নীরোগ হয়। কথাটা গল্পের মতো শোনালেও, বাস্তবেই গবেষকেরা এগুলো নিয়ে কাজ করছেন।
আমাদের বিদ্যালয়গুলো বছরের এক-তৃতীয়াংশ সময় বন্ধ থাকে। প্রচুর সরকারি ছুটি সেখানে। সঙ্গে হরতাল, মারামারি-ধরাধরি, ধর্মঘট, অবরোধ, আন্দোলন, উপাচার্য হটানোর জন্য ক্লাস বর্জন। তার সঙ্গে নগর ডুবি, যানজট। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই আধুনিক ল্যাব। আছে গবেষণার অভিজ্ঞতাহীন শিক্ষক! তাহলে মেধাবী ও কর্মপাগল মানুষই তৈরি হবে কি করে? তদুপরি আছে শিক্ষার্থীদের আর্থিক টানাপোড়েন। দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েগুলো টিউশনি করে জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট সময় নষ্ট করেন। টাকার জন্য এই কাজটা তারা নিরুপায় হয়ে করেন। দুই টাকার জন্য জীবনের দশ টাকার সময় নষ্ট করতে হয়। তাদের এই সময়টুকু কি রাষ্ট্র কাজে লাগাতে পারত না?
একবার ভাবুন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কতগুলো ল্যাবরেটরি তৈরি করা হয়েছে। মেধাবী ও যোগ্য গবেষকদের সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ল্যাবগুলো দিন-রাত খোলা। সেগুলোতে কাজ করছে ২০ থেকে ৩০ বছরের তরুণ ছেলে-মেয়েরা। সরকার তাদের আর্থিক সাপোর্ট দিচ্ছে। টিউশনি করে তাদের সময় নষ্ট করতে হচ্ছে না। ল্যাবগুলোর সঙ্গে আছে ক্যাফেটেরিয়া। মানসম্পন্ন খাবার আছে সেথায়। তারা সেখানে খাবেন। কাজ করে ক্লান্ত হয়ে আড্ডা দেবেন। পার্টি করবেন। ঘুম পেলে সেখানেই ঘুমিয়ে নিবেন। তারপর আবার হাসতে হাসতে, গান বাজিয়ে কাজ করতে থাকবেন।
আমাদের দেশের জন্য এগুলো স্বপ্নের মতো শোনালেও, এমন পরিবেশেই সারা দুনিয়ার ছেলে-মেয়েরা কাজ করছেন। দেশ তার তরুণদের জন্য গবেষণার পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে। তরুণেরা দেশের জন্য দিচ্ছেন সর্বোচ্চ মেধা ও শ্রম। আমরা যদি এমন পরিবেশ তৈরি করে দিই তাহলে দেশকে নিয়ে আর ভাবতে হবে না। দেশ দাঁড়াবে তার আপন গতিতে, স্বমহিমায়।

*ড. রউফুল আলম: গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া (UPenn), যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <[email protected]>; ফেসবুক: <www.facebook.com/rauful15>

এমএসএল