বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রেম ক্যাম্পাসেই পরিণয়


চবি | Published: 2019-07-20 11:42:22 BdST | Updated: 2024-05-18 09:58:42 BdST

পরিচয়টা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করতে এসে। তন্বী ও ইমরান টুকটাক কথা বলতেন ক্লাসের ফাঁকে।

কোনোভাবেই মনের মানুষকে ভালো লাগার কথাটি বলতে পারছিলেন না ইমরান। এর মধ্যে একদিন ঘটে গেল আচানক এক ঘটনা। এক বন্ধু এসে ক্লাসের ফাঁকে ইমরানকে বলল, 'দোস্ত, তন্বীকে আমার ভালো লাগে। ওকে বলতে চাই, তুই সঙ্গে থাকিস। ' হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলেও ইমরান সায় দিলেন। ইমরানের উপস্থিতিতেই সেই বন্ধু তন্বীকে প্রস্তাব দিল। কাজ হলো না। খানিকটা আশা পেলেন ইমরান। কে জানে, তন্বীর ভালোবাসা হয়তো তাঁর জন্যই তোলা আছে।

এরপর নিয়মিত কথা হতো দুজনের। কিছুদিন ফোন নম্বরও বিনিময় হলো। শুরু হলো কথা বলা। দেখতে দেখতে ভর্তি পরীক্ষাও হলো। কাকতালীয়ভাবে দুজনেই সুযোগ পেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। দুজনের 'আনুষ্ঠানিক ভালোবাসা'র সেই শুরু। ইমরান উঠলেন সলিমুল্লাহ হলে, তন্বীর ঠিকানা শামসুন্নাহারে। প্রতিদিন সকালে তন্বীর হলের সামনে আসতেন ইমরান। গল্প করতে করতে ক্লাসে যেতেন। একই বেঞ্চে বসতেন। বিকেলে ঘুরে বেড়াতেন ক্যাম্পাসে। এভাবে বিভাগে তো বটেই, গোটা ক্যাম্পাসেই পরিচিত হয়ে উঠল তন্বী-ইমরান জুটি।

চতুর্থ বর্ষের শেষে ক্লাস পার্টিতে 'সেরা জুটি'র পুরস্কারটাও গেল তাঁদের ঝুলিতে। ঘটনাটা ঘটেছিল সেন্ট মার্টিনসে শিক্ষা সফরে গিয়ে। সেখানে মেয়েদের হাঁড়িভাঙা প্রতিযোগিতা চলছিল। একজন গামছা দিয়ে সব মেয়ের চোখ বেঁধে দিচ্ছিল। তন্বীর পালা এলে বিভাগের শিক্ষক তাহসিনা ম্যাডাম মজা করে বললেন, 'তন্বীর চোখ অন্য কেউ বাঁধবে না। কেবল ইমরানই বাঁধবে। ' স্নাতক শেষ হওয়ার আগেই দুই পরিবারে জানাজানি হয় সস্পর্কের বিষয়টি। শুরুতে কিছুটা দোমনা ভাব ছিল। 'এখন চাকরি করিস না। বিয়ের পর কিভাবে চলবি?' এমন বহু প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে দুজনই। কিন্তু দুজনের অটুট বাঁধন দেখে আর আপত্তি করেননি মা-বাবা। অবশেষে এলো সেই শুভলগ্ন। ২০১৩ সালের ২২ মার্চ। অনার্স পরীক্ষার পরপরই বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তন্বী-ইমরান। 'এটা ছিল স্বপ্নপূরণের মতো। এত তাড়াতাড়ি সব কিছু হয়ে যাবে আমরাও ভাবিনি', বললেন ইমরান। তন্বী যোগ করলেন, 'আমাদের সম্পর্ককে বিভাগের বন্ধু-শিক্ষক সবাই সমর্থন করেছেন। বন্ধুরা সবাই আমাদের বিয়েতে গেছে। সব মিলিয়ে দারুণ অনুভূতি। ' কয়েক দিন আগেই দুজন স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শেষ করেছেন। এর মধ্যে ইমরান আবার ৩৪তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তন্বী-ইমরান দুজনেরই লক্ষ্য বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি করা। এখন চলছে সেটারই প্রস্তুতি।

চিঠির রসায়ন

প্রায় একই রকম গল্প আল মামুন আর মৌসুমীর। একজন পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তরে, অন্যজন ম্যানেজমেন্টের চতুর্থ বর্ষে। দুজনই পুরান ঢাকার বাসিন্দা। একই স্কুলে পড়তেন। ছোটবেলার পছন্দ ভালোবাসায় রূপ নিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর। 'মনে মনে দুজন দুজনকেই পছন্দ করতাম। কিন্তু সরাসরি বলা হয়নি। ক্যাম্পাসে ভর্তির পর মনে হলো, যথেষ্ট বড় হয়েছি। ওকে বলার পর মনে হলো ও যেন এটা শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিল', বললেন আল মামুন। শুরুতে দুজনের পরিবারের কেউই জানত না। পরে জানার পর অবশ্য আপত্তি করেনি কোনো পক্ষই। দুই পরিবারের সম্মতিতেই আল মামুন-মৌসুমীর বিয়ে হয় ২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল। দুজনের প্রেমের রসায়ন কী? 'এই মোবাইল-ফেসবুকের যুগেও আমরা চিঠি লিখতাম। ওর লেখা সব চিঠি যত্ন করে তোলা আছে', বললেন মৌসুমী। তবে বিয়ের পর আর চিঠি লেখা হচ্ছে না। গত বছর প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে অনেক জোরাজুরির পর আল মামুনের কাছ থেকে একটা চিঠি আদায় করা গেছে। দুজনেরই পড়াশোনা চলছে, এর মধ্যে বিয়ে করায় কী সমস্যা হচ্ছে? 'না, পরীক্ষার আগে বরং ভালো করে প্রস্তুতি নিতে দুজন দুজনকে তাড়া দিই', বললেন আল মামুন। ভবিষ্যতে সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার ইচ্ছা তাঁর। আর ম্যানেজমেন্টের ছাত্রী মৌসুমীর ইচ্ছা ব্যাংকে চাকরি করার।

প্রায় সিনেমার গল্প

শাহরিয়ার আর নিশির গল্পটা অবশ্য একটু আলাদা। নিশিকে পেতে শাহরিয়ারকে নানা বাধাবিপত্তি পেরোতে হয়েছে। ঠিক সিনেমার মতোই। দুজনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। ২০১০ সালে ক্লাস শুরুর পর নিশিকে দেখেই প্রেমে পড়েন শাহরিয়ার। তিন মাসের মাথায় কয়েকজন বন্ধুকে দিয়ে প্রস্তাব পাড়েন। প্রস্তাবটা ছিল আঠারো পৃষ্ঠার দীর্ঘ এক চিঠিতে! কিন্তু নিশি রাজি হলেন না। উল্টো তাঁর বাসা থেকে শাহরিয়ারকে হুমকি দেওয়া হলো। ভয়ে শাহরিয়ার কয়েক মাস ক্লাস করাও বন্ধ রাখলেন। কয়েক মাসের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলো। নিশির সঙ্গেও কথা চলল। এভাবে একদিন দুজনের বন্ধুত্ব হলো। কিন্তু নিশি সব সময়ই শাহরিয়ারকে মনে করিয়ে দিত_এটা শুধুই বন্ধুত্ব আর কিছু নয়। শাহরিয়ার তখন এর বেশি কিছু চাননি। তিনি জানতেন, বন্ধুত্ব টিকলে নিশি আরো ভালো করে তাঁকে জানার সুযোগ পাবে। এভাবে একদিন বরফ গললেও গলতে পারে। সেটা হলো ২০১২ সালের মাঝামাঝিতে। নিশি জানালেন, পরিবার যদি মেনে নেয় তাহলে তাঁর আপত্তি নেই। পরের বছর ঈদের ছুটিতে বাড়ি গিয়ে মা-বাবাকে রাজি করালেন শাহরিয়ার। দুই পরিবার আলোচনায় বসল, রাজিও হলো। ২০১৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর শাহরিয়ার-নিশির বাগদান হলো। 'সেদিন যে কী ভালো লাগছিল, বলে বোঝাতে পারব না। প্রথমে না করে দেওয়ার পর ভাবিনি নিশিকে কখনো পাব', বললেন শাহরিয়ার। এরপর দুজনের বিয়ে হলো ২০১৪ সালের ১০ অক্টোবর। প্রেম, তারপর পরিণয়- দুজনই এখন ব্যস্ত নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে। শাহরিয়ার আর নিশি পড়াশোনায় ভালো। শাহরিয়ার আবার ভালো বিতর্কও করেন। ঝুলিতে আছে আন্তবিভাগ, আন্তক্লাব ও আন্তবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্কের শিরোপা।