এই অস্ত্র ভালবাসার, উন্মাদনার, হৃদয় বিনিময়ের এবং শেষে জয়ের হাসির লক্ষ্যে


Kolkata | Published: 2021-05-25 01:40:16 BdST | Updated: 2024-12-14 03:23:42 BdST

মার্চ ২০২০, বিশ্বে ক্রমেই বাড়ছে কোভিড সংক্রমণ। ভারতেও শুরু হলো সেই মারণ ভাইরাসের প্রকোপ। তারপর কেটে গেছে দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময়। আজও আমরা গৃহবন্দী। মুক্তির আশা ক্ষীণ, মানুষের আর্তনাদ, মৃত্যুর সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই এবং শেষে পরাজিত মৃত সৈন্যদের দেহ কবর কিংবা শশ্মানে আজ ঠাই নেই। নদীর জলে ভেসে চলা নামহীন দেহগুলো নিয়ে শুধুই রাজনৈতিক বড়াই। হেঁটে চলা পরিযায়ী শ্রমিক আজও পথে দু'বেলা খাবারের সন্ধানে। এবং সেই পথ আরো জটিল থেকে জটিলতর। এদিকে সেজে উঠছে শাসকদের নতুন পার্লামেন্ট ভবন।

রাজ্যে রাজ্যে নিজেদের ভীত শক্ত করতে রাষ্ট্র ব্যস্ত ভোট কিংবা রাজনীতির খেলায়। ১৩০ কোটির উপর দেশে প্রতিদিন মাত্র কয়েক হাজার মৃত্যুতে কি বা আসে যায় শাসকদের! সাধারণ মানুষের মৃত্যু! সে তো কয়েকটি সংখ্যা হয়ে থেকে যায় তাঁদের কাছে। তাতে আলাদা ক'রে শোক পালন বা সহানুভূতি দেখানোর দরকার কী? এর চেয়ে ভালো পাশ কাটিয়ে বিভ্রান্তিকর পরিবেশের বাতাবরণ তৈরি করা যাক্। অক্সিজেন বা সরকারি হাসপাতালের শয্যা, সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নতি, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য হ্রাস- পেট্রোল ডিজেলের চড়া দাম থেকে মুক্তি- নিম্নবিত্তদের জন্য বিনামূল্যে রেশন- এগুলো তো সাধারণ মানুষের সারা জীবনের দাবি।

সেই ধ্বনি যুগে যুগে বাতাসে বাতাসে প্রবাহিত হলেও সরকারি মহলে প্রবেশের অধিকার তাদের নেই। দীর্ঘ এই লড়াইয়ে মানুষ যখন অসহায় আর ক্লান্ত, তাঁকে কেউ দেখবার যখন নেই, ঠিক তখনই হাতে হাত ধ'রে লড়াইয়ে শক্তি সঞ্চয় করতে এগিয়ে আসে সাধারণ-ই। যে যুব সমাজ কে সর্বদা শুনে আসতে হয়েছে কটুক্তি, উচ্ছন্নে যাওয়া, শিক্ষার নামে কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়া এবং এই নিয়ে দুনিয়া যখন সবর, ঠিক তখনই একুশ শতকের সবথেকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়েছে আজকের এই যুবসমাজ। এই অস্ত্র ভালবাসার, উন্মাদনার, হৃদয় বিনিময়ের এবং শেষে জয়ের হাসির লক্ষ্যে।

থেমে নেই নাট্যজগত'ও, মঞ্চে ফেরার দিন যখন অনিশ্চিত, তখন নিজেদের মতো ক'রে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি থাকবার চেষ্টা করছে। অভিনয়ে-সংলাপে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত যে মানুষগুলোর কথা ভেবেই এই নাট্য আন্দোলন, আজ কালের নিয়মে সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে গোটা নাট্যমহল।

ইউনিভার্সিটি ফেন্ড'স গ্রুপ নামে সদ্য কলকাতায় জন্ম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের নাটকের গ্রুপ। এ'বছর জানুয়ারি মাসে তাঁদের প্রথম প্রযোজনা দেশের নামে মঞ্চায়নের মধ্যে দিয়ে আত্মপ্রকাশ গ্রুপটির। ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গ, ত্রিপুরা, দক্ষিণবঙ্গ এবং গতমাসে উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জে তাঁদের ১৩ তম মঞ্চায়ন শেষে ফিরেই দলের অর্ধেক সদস্য কোভিড আক্রান্ত হয়ে পড়ে। চারিদিকে তখন কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে। অক্সিজেন এবং হাসপাতালের শয্যা খুঁজতে বাড়ছে সাধারণ মানুষের হয়রানি। বন্ধ হতে শুরু করেছে মঞ্চ থেকে সিনেমা সবকিছুই। কয়েকদিন বাড়িতে নিভৃতে বাসে থাকতে থাকতেই তাই তাঁদের ভাবনা তৈরি হয় সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করবার।

কয়েকঘন্টার পারস্পরিক আলোচনার মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত হয় 'দেশের নামে' হেল্পলাইন চালু করার। বন্ধুবান্ধব, পরিচিত মানুষ, সরকারি ওয়েবসাইট থেকে অক্সিজেন এবং হাসপাতালের তথ্য সংগ্রহ করে কোভিড আক্রান্ত পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। প্রথম দিন সন্ধ্যায় তাঁদের একটি পোস্টার সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হবার সাথে সাথেই শুরু হয় হেল্পলাইন যাত্রা। প্রথমদিন প্রায় চারশো জন মানুষের কাছে তাঁরা তথ্য আদানপ্রদান করতে সক্ষম হয়। তারপর থেকেই গ্রুপের সদস্যরা সময়ের নিরিখে বিভক্ত হয়ে ২৪ ঘন্টা দিনরাত জেগে আজ পর্যন্ত এই পরিসেবা চালিয়ে যাচ্ছেন।

গ্রুপের নির্দেশক অভিনেতা ঋতব্রত মুখার্জি জানালেন- একটা কথা আছে যে 'মানুষ কিছুই মনে রাখে না'। আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সামাজিক কাজে যুক্ত থাকতে গিয়ে দেখেছি এই কথাটি সত্যি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। যখন যখন একবারে হতাশ হয়ে পড়তে হয়, যখন দেখা যায় যে শাসনের নামে আসলে কিছুই করতে সক্ষম হচ্ছেন না তাঁরা যাঁদের প্রচুর টাকা মাইনে, প্রচুর মানুষ তাঁদের সিকিউরিটি - তখন সেই হতাশা কাটিয়ে উঠে যাঁরা কিছু সময় সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হন, তাঁরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটাই দেখেছেন যে মানুষ সত্যি মনে রাখে না বা রাখলেও খুব কম।

নিঃস্বার্থ ভাবে যাঁরা সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন, তাঁদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুলে যাওয়া হয়। কিন্তু সেটা হবে বলে বাড়িতে বসে থাকা যায় না। এমনটাই হয়তো আমাদের প্রবর্তিত ক্রিয়া। এবং এই ক্রিয়া যতদিন শরীরের ভিতরে থাকবে ততদিন বুঝতে পারবো যে- আমার শিক্ষা, আমার বোধ কোথাও একটা আমাদের কে আনতে পেরেছে। তাই আমাদের এই যে টিম দেশের নামে তাঁরা যে কাজটি করছে, আসলে যে বিরাট কিছু করে উদ্ধার করে দিচ্ছি এমন টা নয়। আমরা ওই আমাদের প্রবর্তিত ক্রিয়া, আমাদের যে সামান্য বোধটুকু, আমাদের মাথা যা এখনো সুস্থ রয়েছে সেটা থেকে একটা কাজ করার চেষ্টা করেছি।

এই একই কাজটি করছেন আমাদের আরো অন্য অচেনা, সারা দেশ জুড়ে, সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অনেক অনেক মানুষ। তাঁরা চেষ্টা করছেন নিজেদের সাধ্যমত নিজেদের দিনের কাজ আর রাতের ঘুম বিসর্জন দিয়ে চেষ্টা করছেন আরেকজন অজানা অচেনা মানুষকে সাহায্য করার। এই সাহায্যের জন্যই আজ অবদি পৃথিবীটা টিকে আছে। কারণ যদি সত্যি খুব পরিস্কার কথা, আমরা যে যা রাজনীতি তে বিশ্বাস করি না কেন, যে দলের সমর্থক হই না কেন, আমরা এটা পরিস্কার দেখতে পেলাম এইবার যে আমাদের যাঁরা শাসক বলে দাবি করেন সেটা পাড়ায় হোক, গ্রামে হোক, বন্দরে হোক, শহরে হোক, দেশে হোক, পৃথিবীতে হোক, তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যর্থ হননি কারা? সেই সমস্ত ডাক্তার, নার্স, সেচ্ছাসেবী, সাধারণ মানুষেরা।

যাঁরা আটচল্লিশ ঘন্টা, বাহাত্তর ঘন্টা না ঘুমিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছেন। এঁদের জন্য হয়তো পৃথিবীটা টিকে থাকবে। কারণ যাঁদের কে শাসক বলি, তাঁদের ভরসায় যদি পৃথিবী ছেড়ে দিতে হতো কোনদিন তাহলে আমাদের মৃত্যু অনেক অনেক শতাব্দী আগেই হয়ে যেতো।

দেশের নামে নাটকের সহ নির্দেশক পুষন্ দাশগুপ্ত বললেন- আমরা এমন একটা কাজ করছি যেই কাজটার জন্য মেডিকেল ট্রেনিং দরকার হয়। অর্থাৎ যে হাসপাতালের অনুসন্ধান অফিসে বসেন তাঁকে ট্রেনিং দেওয়া হয় যে, বিভিন্ন ধরনের পেশেন্টদের'কে কি কি ভাবে পরামর্শ প্রদান করা যেতে পারে, ইমার্জেন্সি বিষয় তৈরি হলে কিভাবে সাহায্য করা যেতে পারে এবং বেসরকারি হাসপাতাল হলে টাকাপয়সার বিষয় টিও উল্লেখ্য থাকে, যা সেই বেসরকারি হাসপাতালের জন্য লাভজনক হবে। এইরকম এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাদের কোনো ট্রেনিং বা অভিজ্ঞতা কিছুই নেই। শুধুমাত্র মানুষের প্রতি সহানুভূতি এবং ভালোবাসা থেকে এই কাজটি করতে এগিয়ে এসেছি।

এবং তার জন্য প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বিপদ, ভয়ংকর মুহূর্তের সম্মুখীন আমাদের হতে হয়েছে। যেমন বহুবার এমন হয়েছে যে আমাদের ফোন করে কিংবা ম্যাসেজ করে জানিয়েছেন, খুব দ্রুততার সাথে অক্সিজেন জোগাড় করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ কিন্তু মা বা তাঁর আত্মীয় কে বাঁচানো যায় নি। লকডাউনে বহু মানুষের কাজ চলে যাওয়ায় কখনো কখনো ফোন করে মানুষ কাজের সন্ধান করেছেন আমাদের কাছে। রাষ্ট্রের নেতানেত্রীরা যেমন দায় এড়াতে পারেন না, ঠিক তেমনই আমাদেরও ভোট দিয়ে শুধু গনতান্ত্রিক অধিকার শেষ হয়ে যায় না।

আমাদের উচিৎ সবসময় সরকার কে প্রশ্ন করা, যে যে নিয়ম তৈরি হচ্ছে পার্লামেন্ট বা বিধানসভায় বসে সেগুলোর উপর প্রশ্ন করা বা চর্চা করা। এই প্রশ্নের চর্চা ভারতের সাধারণ মানুষ সেইভাবে চিন্তাভাবনা করে না অবশ্য। তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হতে পারে শক্তিশালী শাসকদল। যখনই কোনো শক্তিশালী শাসকদল তৈরি হয়েছে এবং শাসক বুঝতে পারছে আমি যা খুশি করি মানুষ কিছু বলতে বা করতে পারবে না এবং এই দম্ভ যখন তৈরি হয়ে যায় তখন এই ভাবনা আরো চেপে বসে তাঁদের। উল্টোদিকে যদি শাসকদল বুঝতে পারে যে তাঁর বিরোধী শিবির শক্তিশালী এবং যখন তখন সরকার কে পদচ্যুত করতে পারে, সেইসময় শাসকদল মানুষের কথা শুনতে চাইবে কিংবা মানুষের জন্য কাজ করতে আগ্রহ দেখাবে যাতে তাঁরা আরো বেশি ভোট পায়।

ফলতঃ এটা হচ্ছে ভোট রাজনীতি। কিন্তু সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের কি করা উচিৎ? সেটা হচ্ছে আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি যে, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষেরা রাজনীতির সাথে বা সমাজ সংস্কারের সাথে অতঃপ্রত ভাবে জড়িয়ে পড়েছে রাজনৈতিক নেতা না হয়েও। কিন্তু সেটা যে রাজনীতির খুব বাইরে এমনটা নয়। রামমোহন রায় বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমনকি চৈতন্য দেবের কথা তুলে ধরে বলা যেতে পারে। এই কাজ করতে গিয়ে নিজের ব্যক্তিগত মানসিক ক্ষতি হলেও মানুষের যে স্বতস্ফূর্ত আন্দোলনের স্পৃহা তা এমন এক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে প্রতিনিয়ত, যদি সরকার ব্যর্থ হতে থাকে বা শাসকদল গদি ছেড়ে দিতে চায় তবে সাধারণ মানুষ সেই দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে দ্বিধাবোধ করবে না।

ভোটের রাজনীতির বাইরে গিয়েও সরকারের ভূমিকা পালন করছে মানুষ। একজন রাজনৈতিক নেতার যা কর্তব্য তা সাধারণ মানুষ একসাথে মিলে করার চেষ্টা করছে। একটা গনতান্ত্রিক দেশ বা পৃথিবী জুড়ে এই ঘটনা গড়ে ওঠা সত্যি বলতে একটা ইতিবাচক দিক বলা যেতে পারে। আগামীতে একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ে ওঠার লক্ষণ হয়ে উঠছে হয়তো।

গ্রুপের আরেক সদস্য ভাস্কর বনিকের কথায়- আমার বাবা আজও বলেন "মানুষ হয়ে জন্মে যদি আর পাঁচটা মানুষের কাজেই না আসো, তাহলে গোটা জীবনই বৃথা"। আজকের এই অসময়ের জন্য আমি আপনি দায়ী নই, এর দায়ভার একান্তই এই সিস্টেমের। ফেলে আসা অতীতই দায়ী এই বর্তমানের জন্য। আমরা যুব সমাজ, আমরা শুধু অতীত কে দায়ভার দিয়ে চুপ করে বসে থাকবো তাও নয়, আমাদের ভবিষ্যতও যেন আমাদের দায় না দেয় সেই দায়িত্বও আমাদের। তাই এই অতিমারীর সময় যখন মানুষ মরছে আর মানুষই তার সংখ্যা গুনছে। তখন কিছু মানুষই থালা বাটি না বাজিয়ে মোমবাতি না জ্বালিয়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে।

আমারও বলতে ভীষণই ভালো লাগে আমি এবং আমার বন্ধুরাও অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিলাম এই কাজে। এই হেল্পলাইন চালাতে গিয়ে আমরা খেয়াল করেছি সরকারি হাসপাতালের ফোন নম্বর গুলির মধ্যে ৮০% নম্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে আমরা অক্ষম হয়েছি প্রতিনিয়ত। এই অসময়ে দাঁড়িয়ে কিছু লোভী মানুষ যাঁরা অক্সিজেন, ওষুধ সহ প্রয়োজনীয় দ্রব্য গুলি অমানবিক দাম চেয়ে বিক্রি করছেন। আবার কখনো কখনো অসুস্থ ব্যক্তির পরিবারের থেকে অনলাইনে টাকা নিয়েও কোনো পরিসেবা পৌঁছে দেন নি। অবশেষে মানুষ মরছে! এখনই সঠিক সময় প্রত্যেকে প্রত্যেকের পাশে দাঁড়ানোর।

টিমের সদস্য সাহেব সান্যালের গলায় একই সুরে শোনা গেলো- নিজের বাড়ির বাইরে মানুষ এখন বেরোতে ভয় পাচ্ছে। আর ঠিক এই সময়ে আমাদের দেশ ভারতবর্ষ সংকটের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে শুধুমাত্র শাসকের জন্য। মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে দিনে দিনে। আর সেই মৃত্যুর খবর দেখিয়ে সংবাদ মাধ্যমের বাড়ছে টিআরপি (TRP)। সত্যি ভাবলেও অবাক লাগে মৃত্যুর মধ্যেও সমাজের এক অংশের মানুষ তাঁদের লাভ খুঁজে নিচ্ছে। দেশের শাসক এই পরিস্থিতি তে কোনো ব্যবস্থা নেই নি। কিন্তু আমাদের আগে তাঁরাই জোর গলায় বলেছিলেন, সব ব্যবস্থা সরকার তৈরি করে রেখেছে। কিন্তু বাস্তবে আজ কিছুই চোখে পড়ছে না, তাই তাঁদের প্রতিশ্রুতি মিথ্যে আর ভুয়ো ছিল প্রমাণিত মানুষের কাছে।

দেশের নামে হেল্পলাইনের মাধ্যমে আমরা জানলাম কিভাবে রাত বাড়লে ১২০০ টাকার অক্সিজেন ১ লক্ষ টাকায় পৌছে যায়, আর আমরা এটাও জানলাম সরকারি হাসপাতালের বেড বিক্রি করা যায় কখনো কখনো পাঁচ, দশ, পনেরো হাজার কিংবা তার বেশি মূল্যেও। আরেকটা কথা তো বলতেই ভুলে গেলাম সৎকারের সময়ও ব্যবসা চলছে এবং অক্সিজেন দেবো বলে অগ্রিম টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া সেটাও আমরা দেখেছি। মোবাইল এবং মাদকে আসক্ত এই নতুন প্রজন্ম সুরক্ষার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধারণ মানুষের সামনে। আমরা এই কঠিন পরিস্থিতি কে ঠিকই জয় করবোই। আবার আমরা সবাই কাজে ফিরবো, আবার এই পৃথিবী হাসবে, আবার আমরা সবাই উৎসবে মেতে উঠবো। ততদিন আমাদের সবাই কে হাতে হাত দিয়ে লড়াই করতে হবে একসাথে। আমরা জয়ী হবোই।

টিমের সদস্য সৌমেন চক্রবর্তী জানান- কোভিড আক্রান্ত হয়ে গৃহবন্দি হয়ে পড়ায় বাড়িতে বসে সোশ্যাল মিডিয়া আর গণমাধ্যমের খবর মানসিকভাবেও অসুস্থ করে তুলছিল আমাকে। উদাসীন ! সাধারণ মানুষের এরকম অবস্থা দেখেও ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতার আশায় থাকা মানুষ গুলো এখনও কি করে উদাসীন এটা খুব ভাবাচ্ছিলো। পরে বুঝলাম অসুস্থ বলেই ভাবাচ্ছিলো, নয়তো সুস্থ লোকের এই ভাবনা আসে কি ভাবে! যাইহোক এসব ভাবনা ঝেড়ে কয়েকদিনেই দেশের নামের কোভিড হেল্পলাইন চালু হয়। চারিদিকে এতো লোক অসুস্থ, তাঁরা কেউ বেড পাচ্ছেন না, কেউ অক্সিজেন পাচ্ছেন না, আবার কেউ গৃহবন্দী বলে ওষুধ বা খাবার পাচ্ছেন না।

কখনো রোগীর বাড়ির লোক ফোন করে কেঁদেছেন, কখনো অক্সিজেনের ডিলার মাঝরাতে গালিগালাজ করেছেন, কখনো তাঁরা আকাশছোঁয়া দাম বলেছেন । কখনো বহু বহু ফোন কলের পরেও হাসপাতাল , ল্যাব , রিটেইলাররা ফোন ধরেন নি। নিজেদের অসহায় মনে হয়েছে বারবার, মনে হয়েছে বাইরে গিয়ে কোথাও থেকে অন্তত প্রয়োজনীয় জিনিস টা জোগাড় করে পৌঁছে দিয়ে আসি। কিন্তু আমরা নিজেরা ঘোরতর অসুস্থ ফলত বাড়িতে থেকেই যেটুকু করা যায়। সাহায্য পেয়েছেন এমন পরিবারের শুভেচ্ছাবার্তা যেমন উৎসাহ দিয়েছে তেমনই দুঃসংবাদ মর্মাহত করেছে বারবার। শুধু কলকাতা বা দক্ষিনবঙ্গ সহ বাংলার গ্রাম্য অঞ্চল নয় - দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খন্ড থেকে লোকেরা ফোন করেছেন অক্সিজেন এর খোঁজে । কেউ বলেছেন "আমি ভালো আছি কিন্তু বাড়িতে কেউ নেই, আমি একা আশি বছরের মানুষ, বড়ো ভয় করছে বাবা, তুমি একটু কথা বলো না গো আমার সাথে বড়ো একা লাগছে। যদি কিছু হয় তোমায় এই নাম্বারে সব সময় পাবো তো ?" , কেউ তা‌ঁর থ্যালাসিমিয়া আক্রান্ত ছেলের রক্তের জন্য ফোন করেছেন। আবার কেউ বিদেশ থেকে ফোন করে কেঁদে বলেছেন - " দাদা বাড়িতে মা একা আছেন পাশের বাড়ির কেও ওষুধ এনে দিচ্ছে না , আমার ফিরতে দু'দিন লাগবে হয়তো, আপনি কিছু একটা ব্যবস্থা করুন"।

প্রতিবার চেষ্টা করেছি সাধ্যমত সাহায্য করার বা পরিচিত স্বেচ্ছাসেবক যা‍ঁরা বাইরে বেরিয়ে কাজ করছেন তাঁদের সাহায্য নেওয়ার। আপনাদের কাছে বলার বিষয় এটাই যে ভয় না পেয়ে রোগের সাথে লড়াই করুন দেখবেন লড়াই টা অনেক সহজ হবে আর দয়া করে পাশের বাড়ির লোক গুলোর খারাপ সময়ে পাশে দাঁড়ান, কারণ মানুষের মানুষকে খুব প্রয়োজন এই মুহূর্তে ।

সারা দেশ রাজ্য জুড়ে ক্ষমতাশালীরা গত কয়েকমাস উদাসীন তান্ডব চালিয়ে আজ হঠাৎ মানুষের নামে, মানুষের জন্য মানুষেরই কাজ বন্ধ করে তাদের বাড়িতে বসিয়ে দিয়েছেন যা মানুষের একেবারেই কাম্য নয় ।

তাই নিজেরা সাবধান হোন সুস্থ থাকুন মানুষের পাশে থাকুন । এখনও আমাদের হেল্পলাইন সারাদিনরাত চলছে, আমাদের টিমের সবাই বর্তমানে সুস্থ কিন্তু পরিস্থিতি আরও খারাপ ফলত আমরা হেল্পলাইন ছাড়াও অন্য কিছু ভাবছি । গত কয়েকদিনে ফোন কলের সংখ্যা অনেক কমেছে কারণ সরকার ও আরও অনেক স্বেচ্ছাসেবী ও সহৃদয় মানুষ এগিয়ে এসেছেন । তবে সরকারকে অনুরোধ আপনারা সমস্ত বিষয়ে আরও অনেক বেশি সজাগ হোন নইলে সাধারণ মানুষরা যাবেন কোথায় আর খাবেনই বা কোথায়?