রক্তস্নাত ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব ও পশ্চাৎ গল্প


মোঃ আবিদুল ইসলাম খান (আবিদ) | Published: 2024-11-14 20:07:17 BdST | Updated: 2024-12-04 03:13:49 BdST

বিগত পনেরো বছরে শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় সফলতা ছিল জুলুমের শিকার মুক্তিকামী জনতাকে নানান অপকৌশল তথা হুমকি ও প্রলোভন দেখিয়ে বিভক্ত করে রাখা। বিশেষকরে বিএনপির নেতাকর্মীদের ভয়াবহ শাস্তির আওতায় এনে ভয়ের সংস্কৃতিটা জিইয়ে রাখা ছিল তার নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। সিলেটের মাটি ও মানুষের নেতা জননেতা এম ইলিয়াস আলীর গুম এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

বিরোধী মত ও পথের মানুষকে হত্যা, গুম, ক্রসফায়ার,ফাসি, কারাগারে নিক্ষেপণ এভাবেই পনেরোটা বছর কেটে যায়। বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে বারবার আন্দোলন করার চেষ্টা করলে, তার অপশাসন, ভোটবিহীন মিডনাইট ইলেকশন,দিনে দুপুরে পুকুরচুরির বিরুদ্ধে কথা বললে বিভিন্ন ট্যাগ দিয়ে আন্দোলন দমন করতে করতে হাসিনা ধীরে ধীরে স্বৈরাচার বনে যায়। বাংলাদেশের মানুষ মুক্তি খুঁজছিল কিন্তু শেখ হাসিনার নির্মম নির্যাতনের মুখোমুখি হওয়াটা ছিল যে কারো জন্য অসাধ্য। এক দীর্ঘ সংগ্রামের পর আসে সেই মুক্তির দিশা দেখানো দিন ২০২৪ সালের ৫ জুন।

২০১৮ সালের সরকারী চাকুরীতে কোটা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে শিক্ষার্থীরা তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিল করে এবং কোটার যৌক্তিক সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলমান থাকবে বলে উপস্থিত সকলেই মতামত দেয়।

পরবর্তীতে আন্দোলন সুসংগঠিত করার চ্যালেঞ্জ কিভাবে প্রস্ফুটিত করা যায় অনেকেই এ স্বপ্ন দেখতে থাকে এবং সুসংগঠিত করার ভূমিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি ছিল বেশ কার্যকর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে গত ১৫ বছরে সব থেকে নির্যাতিত ছাত্র সংগঠন ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। সরকার বিরোধী ব্লকের নেতৃত্বদানকারী এই ছাত্রসংগঠন ছাড়া বাদবাকি সকল সংগঠনের জন্যই ক্যাম্পাসে চলাফেরা ও রাজনীতি করার শিথিলতা ছিল।

শুধুমাত্র জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলই ক্যাম্পাসে সরাসরি কোন রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি। চতুর্মুখী এই চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে অন্য সকল সংগঠনের পাশাপাশি ছাত্রদলের তুলনামূলক  সিনিয়র- জুনিয়ররা আন্দোলনের প্রথম দিন থেকেই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে অংশগ্রহণ করে এবং আন্দোলনকে সুসংগঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। অংশগ্রহণকারী সকলেই একটা প্রতিকূল পরিস্থিতি অতিক্রম করেছে যে, না জানি কখন স্বৈরাচার আবার এই মুভমেন্টকে পুরনো সেই ট্যাগ দিয়ে আন্দোলন  বন্ধ করে ছাত্রদলকে সাধারণের কাছে দোষী সাব্যস্ত করে উপস্থাপন করে দেয়।

সবকিছু বিবেচনায় রেখে ৫ জুন তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ পরবর্তী ৭ জুন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা একটি মেসেঞ্জার গ্রুপ

"কোটা পর্যালোচনা গ্রুপ" নামক একটি প্লাটফর্ম আবিষ্কার  করে। পরিকল্পনা মাফিক ৯ জুন আবারো রাজু ভাস্কর্যে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভকে ত্বরান্বিত করা হয়। তবে যা না বললেই নয়, ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের আন্দোলনের গন্তব্য নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা ছিল। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রকাশ্য নেতৃত্বের পরিকল্পনা কোটা সংস্কার হলেও ছাত্রদলের পরিকল্পনা ছিল পুরো রাষ্ট্রসংস্কার। হাসিনাকে গণদাবি ও অভ্যুত্থান ছাড়া সরানো সম্ভব  ছিল না বলেই এই পাবলিক মুভমেন্টকে সংস্কারের সেতু হিসেবে নেয়ার চেষ্টারত ছিলো জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এই টিমের সদস্যদেরকে এমনভাবে তৈরী করার চেষ্টা করা হয়েছে যেন সরকার ভুল করলে বাকিদের প্রভাবিত করে আন্দোলনকে যে কোন ভাবে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে রূপদান করা যায়। এমন অসংখ্য রাত রয়েছে যে রাতের গভীরে পরের দিনের মুভমেন্টের স্লোগান, কবিতা আবৃত্তি, বিভিন্ন মিডিয়াতে সাক্ষাৎকারের বিষয়ে তুলনামূলক কম পরিচিত মুখগুলোকে প্রশিক্ষণ দেয়া হত।

কতটুকু বলা যেতে পারে সেটুকু নির্ধারণ করে দেয়া হতো যেন সরকার কোন আন্দোলনের পেছনে বিএনপির ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খুজে না পায়।

এভাবেই ৫ জুন থেকে শুরু হওয়া ১৩ জুলাই পর্যন্ত চলতে থাকলো পরিকল্পিত কার্যক্রম।

১৪ জুলাই ২০২৪ সেই মহেন্দ্রক্ষণের উদয়  ঘটে যখন শেখ হাসিনা সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলল,

"মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা পাবে না,

তো রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?"

এই লাইনটুকু পুরো জাতিকে আঘাত করে ও ঐক্যবদ্ধ হতে অনুপ্রেরণা যোগায়। সেদিন নিমিষেই সোশ্যাল মিডিয়াতে এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে রাজাকার শব্দটিকে ব্যবহার করে বিভিন্ন স্যাটায়ার পোস্টে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যায়। রাতের অন্ধকারে যখন কারেন্ট চলে যায় তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে  প্রতিবাদস্বরূপ স্লোগান উত্থিত হলো

" তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার।"

স্বৈরাচার কর্তৃক এই স্লোগানকে যখন ভিন্ন খাতে নেয়ার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হলো ঠিক তখনই রাত ১১ টা ৩৪ মিনিটে ছাত্রদলের "কোটা পর্যালোচনা গ্রুপ" নামক প্ল্যাটফর্ম থেকে

"কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার"

এই স্লোগানের সংযুক্তির মাধ্যমে এই বিগত ১৫ বছরে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে হাসিনাকে স্বৈরাচার শব্দে সম্বোধন করা হয়, যা নিমিষেই সারাদেশে ছড়িয়ে যায়। পরবর্তীতে সমন্বয়করা "কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার" এর পরিবর্তে "সরকার সরকার" সংশোধনী দেয়। যদিও গোটা জাতির চাহিদা ছিল "স্বৈরাচার স্বৈরাচার" তাই পরবর্তীতে আর এই শব্দ থেমে যায়নি। এই স্বৈরাচার শব্দটি গোটা মুক্তিকামী জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করে এক কাতারে এনে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন কে স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রূপদান করে। অতঃপর ১৫ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বরে সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি রক্তাক্ত হলে গোটা বিশ্বে নিন্দার ঝড় ওঠে। আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে দানা বাঁধতে থাকে। ১৪ তারিখ রাতের স্বৈরাচার স্লোগানের পর ১৫ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে হামলা হবার ফলশ্রুতিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের  নেতৃত্বে সংকট দেখা দেয়। ১৬ তারিখ আবারও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি ও সন্ধ্যায় শহীদুল্লাহ হলে ছাত্রলীগের সাথে সংঘর্ষে গোটা দেশের নজর ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে।সেদিনও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র নেতাদের মাঝে সিদ্ধান্ত নিয়ে মতানৈক্য দেখা যায়। অপরদিকে ১৬ জুলাই ঢাকা,রংপুর ও চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সাথে সংঘর্ষে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু সাঈদ, চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের ওয়াসিম আকরাম সহ  বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে থাকা ৬ জন শিক্ষার্থীর মৃত্যতে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। ১৬ তারিখ দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই ঘোষণার ফলে শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে  ১৭ তারিখ সিনেটে বৈঠকের পর বিশ্ববিদ্যালয় ও হল বন্ধের  সিদ্ধান্ত আসে। ১৭ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ যাবৎকালের বর্বরোচিত হামলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের  বিশ্ববিদ্যালয় ও হল ছাড়তে বাধ্য করে। সেদিন সারাদেশ যখন হাহাকার করছে তখন ভিসির বাংলোর সামনে বিজিবিকে লক্ষ্য করে

"মোদির সন্তানেরা, সীমান্তে ফিরে যা"

"সীমান্তের বিলাইয়েরা, সীমান্তে ফিরে যা"

এই সাহসী স্লোগান দিয়ে সারাদেশে আশার সঞ্চার করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর ভূমিকা ছিল অনন্য। সবগুলো সংগঠনই কমবেশি উপস্থিত থেকে সাধারণদের সাথে নিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। অপরদিকে জাহাঙ্গীরনগর,রাজশাহী ও অন্যান্য সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হল বন্ধে শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধে সরকারি বাহিনীর নির্মমতা চলতে থাকে এবং দেশের কোটি কোটি মানুষ নির্ঘুম রাত যাপন করে। ১৮ জুলাই অবরোধের ডাক আসলে রাত থেকেই ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অবরোধের সমর্থনে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৮ তারিখ দিনে গোটা দেশ বিক্ষোভে অচল হয়ে যায়। সেদিন ঢাকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা ও সেখানকার শিক্ষার্থীদের আত্মত্যাগ আন্দোলনকে এক দফায় ত্বরান্বিত করতে মুখ্য ভূমিকা রাখে। রক্তাক্ত বাড্ডার কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একে একে পাঁচটি গুলিবিদ্ধ মরেদেহ বের হলে চারজনকে হাসপাতালে পাঠানো হলেও ইম্পেরিয়াল কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী শহীদ জিল্লুরের লাশ নিয়ে রাজপথে শিক্ষার্থীরা মিছিল করে ও সেই রক্ত স্নাত রাজপথ থেকে শহীদ জিল্লুরের লাশকে সাক্ষী রেখেই এক দফার স্লোগান উত্থিত হয়

"দফা এক দাবি এক, খুনি হাসিনার পদত্যাগ।"

এভাবেই সারাদেশ থেকে অগণিত নিহত ও আহত হওয়ার খবর আসতে থাকে। ঢাকা সহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তি কামি ছাত্র জনতার প্রতিরোধের মুখে আওয়ামী যৌথ বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয় ও বিভিন্ন জায়গায় আত্মসমর্পণ করে। ১৮ তারিখ সন্ধ্যায় জারি করা হলো কারফিউ। শেখ হাসিনা তার পেটুয়া বাহিনী গুলোকে দেশব্যাপী কিলিং মিশনে নামিয়ে দেয়। চারদিকে হত্যা ও আহতদের নির্মম ভিডিও দৃশ্য যখন ছড়িয়ে যায়,তখন মুক্তিকামী জনতাকে দমন করতে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোকে সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সেদিন আবারো বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি দেখা দেয় ও পুরো জাতি সংকটাপন্ন পরিস্থিতি অতিক্রম করে। যদিও ১৬ তারিখের পর এ আন্দোলন আর শুধুমাত্র সমন্বয়ক নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল ছিলনা। এ আন্দোলন হয়ে ওঠে মুক্তি কামী জাতির সর্বজনীন আন্দোলন। তার পরবর্তীতে ১৯, ২০, ২১, ২২ ও ২৩ জুলাই পর্যন্ত কোন প্রকার কেন্দ্রীয় ঘোষণা ছাড়াই প্রত্যেকে প্রত্যেকের জায়গায়  নেতৃত্ব দিয়েছে এবং কারফিউ ভঙ্গ করে ফ্যাসিস্ট বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে অকাতরে দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। একদিকে রাতের অন্ধকারে ফ্যাসিস্ট তার পেটুয়া বাহিনী দিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে ও সকল বিরোধী সংগঠনের নেতাকর্মীদের গণ গ্রেপ্তার আরম্ভ করে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদেরও গ্রেফতার করে। ইন্টারনেট বন্ধ করে আন্দোলন কিছুটা দমাতে পারলেও প্রবাসীরা দেশের বাইরে হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যায় এবং বিদেশি রাষ্ট্রগুলোকে বাংলাদেশ সম্পর্কে সচেতন করে। প্রবাসীরা দেশে রেমিটেন্স পাঠানোও বন্ধ করে সরকারকে চতুর্মুখী চাপে ফেলে। প্রায় এক সপ্তাহ পরে ইন্টারনেট সেবা স্বল্প পরিসরে চালু হলে ১৮ তারিখ থেকে চালানো সকল হত্যাযজ্ঞের ভিডিও চারিদিকে আবারও ছড়িয়ে পড়ে। দেশে-বিদেশে নিন্দার ঝড় বইতে থাকে। আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হলেও ইন্টারনেট সেবা চালু পরবর্তী সংস্কৃতি মনা কর্মীরা প্রতিবাদস্বরূপ গান গেয়ে বিক্ষোভ করে আবারো আশার আলো দেখায়। একে একে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, আইনজীবীরা, সাংবাদিকরা  প্রতিবাদে নেমে আসে। চতুর্মুখী চাপে সরকার বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের মুক্তি দিলে আবারো মুক্তি কামী জনতার চাহিদা অনুযায়ী ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে সমাবেশ আহবান করা হয়। মুক্তি কামি ছাত্র জনতা সকাল থেকেই শহীদ মিনারে এক দফার স্লোগান তুলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত মঞ্চ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা ঘোষণা করা হয়। ৪ তারিখ শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে অবরোধ ও বিক্ষোভের ডাক দেয়া হয়। ৪ তারিখ দুপুর পর্যন্ত সফলভাবে অবরোধ ও বিক্ষোভ পালিত হলে পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী ৬ তারিখের "লংমার্চ টু ঢাকা" কর্মসূচি ৫ আগস্ট তারিখে নিয়ে আসা হয়। ৫ আগস্ট সকাল ৯ টায় শহীদ মিনারে পুলিশের হামলায় উপস্থিত ছাত্র জনতা ছাত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেলের নতুন বিল্ডিং এর পাদদেশে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং ছাত্র জনতা একত্রিত হয়ে চাংখারপুল এলাকায় কারফিউ ভাঙ্গা হয় এবং সেই কারফিউ ভাঙতে গিয়ে মুন্সীগঞ্জ জেলার একজন ছাত্রদল নেতা সহ পাঁচজন শহীদ হয়। পরবর্তীতে পলাশীর মোড় হয়ে একটি বিশাল মিছিল নিয়ে ছাত্র জনতা শাহবাগের দিকে এগিয়ে যায় এবং কারফিউ ভেঙে শাহবাগ চত্বরে অবস্থান নেয়। ঢাকার চারদিক থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ গণভবনের দিকে এগিয়ে যায়। পরবর্তী কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সবথেকে নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট  স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে হেলিকপ্টারে করে  পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে যায়।

একটি গণঅভ্যুত্থান কারো একক নেতৃত্বে সংগঠিত হয় না। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হল ছাড়তে বাধ্য হল তখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে এসেছে এবং জীবন দিয়েছে। যখন গোটা ছাত্র সমাজকে দমন করার চেষ্টা চালানো হলো তখন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষজন ও আইনজীবীরা ছাত্র সমাজের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং আন্দোলন কে পুনরুজ্জীবিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

একটি গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয় ইনফ্লুয়েন্স তথা প্রভাবিতকরণের মধ্য দিয়ে।

এই ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে চরম উত্থান পতন ছিল। কখনো রিক্সাওয়ালা, কখনো শিক্ষক, কখনো সাংবাদিক, কখনো লেখক, কখনো সাংস্কৃতিক কর্মী, কখনো বাসায় আশ্রয়দানকারী গৃহিণীরা, আবার কখনো বিদেশে অবস্থানরত রেমিট্যান্স যোদ্ধারা,গ্রাফিক্স ডিজাইনাররা ও সর্বশেষে সামগ্রিক রাজনৈতিক নেতাকর্মী  প্রত্যেকে প্রত্যেকের ইনফ্লুয়েন্সার ছিল। এই গণঅভ্যুত্থান সার্বজনীন। আমরা কারো অবদানকেই ছোট করে দেখব না। হিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সকল মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক সমন্বিত রাষ্ট্রসত্ত্বা প্রতিষ্ঠা করাই হোক ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের অঙ্গীকার। পরিশেষে, ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে প্রাণ দেয়া শহীদেরা ও  চিরকালের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করা অসংখ্য যোদ্ধারাই আমাদের মহানায়ক।

যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, পাখির কলকাকলির রব উঠবে ততদিন এই নায়কদের সংগ্রামী অবদান এ সবুজ শ্যামল ভূমিতে উচ্চারিত হবে।

প্রাচীন কাল থেকেই এ বাংলা বুলগাকপুর বা বিদ্রোহের নগরী হিসেবে পরিচিত ছিল, চব্বিশ যেন আমাদের সে ইতিহাসের গল্পই আবৃত্ত করে।

২৪ এর চেতনা অপশাসন,স্বৈরশাসন,মানুষের মুখ চেপে ধরার বিরুদ্ধে এক আপোষহীন সংগ্রাম৷ এদেশের বুকে চব্বিশ এর চেতনা অক্ষত থাকুক।আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে, মা মাটির স্বাধীনতার পক্ষে গণমানুষের জয় হোক।

 

লেখক: মোঃ আবিদুল ইসলাম খান (আবিদ)

যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, ঢাবি ছাত্রদল