
নারী হচ্ছে সাহস ও শক্তির উৎপত্তিস্থল। আজ ৮ মার্চ মহান নারী দিবস। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে অন্যতম শক্তি ছিল আমাদের নারী শিক্ষার্থী বোনেরা। ৫জুন থেকে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। এই আন্দোলনে বোনদের সাহস ভাইদের জাদুর মত প্রভাবিত করেছে।
সেই ১৪ জুলাই রাতে পতিত স্বৈরাচার হাসিনার শ্লেষাত্মক রাজাকার শব্দচয়নের বিরুদ্ধে থালা বাটিতে চামচের শব্দে প্রকম্পিত করতে করতে হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে হল থেকে মিছিল নিয়ে বের হয়ে এসেছিল রোকেয়া হলের দুঃসাহসী মেয়েরা। বোনদের দঃসাহসে ভাইদের প্রভাবিত হওয়া তো বাধ্য। তখন সকল হল থেকে মিছিল বের হত লাগলো।নিমিষেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবাদের ধ্বনিতে বিদ্রোহের ক্যাম্পাসে রূপান্তরিত হয়েছিল। পরবর্তীতে হাসিনাকে সে রাতে গোটা দেশে স্বৈরাচার শব্দে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল।
পরদিন ১৫ জুলাই আবারো প্রতিবাদ করতে বোনেরা সঙ্ঘবদ্ধভাবে ভাইদের পাশে সাহস হয়ে এসেছিল। অতঃপর ছাত্রলীগের আক্রমণে চোখের সামনে অসংখ্য বোন রক্তাক্ত হয়েছিল। কি নির্মম দৃশ্য! এখনো এক বোনের আর্তনাদ কানে ভাসে "ভাই আমাদের ছেড়ে যাইয়েন না, আমাদের নিয়ে যান "।সেই আক্রমণ পরবর্তী সময়ে আমাদের বোনেরা পেছনে ফেরেনি।আবারো রোকেয়া হলের গেটে জড়ো হয়ে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের চোখে চোখ রেখে রোকেয়া হলের গেইট থেকে সন্ত্রাসী ডেকে স্লোগান তুলেছিল "টোকাইদের গালে গালে, জুতা মারো তালে তালে", যা ছিল যুদ্ধে লড়াইরত ভাইদের সাহসের উৎপত্তিস্থল। সন্ত্রাসীদের আমাদের বোনেরাই প্রথম মানসিকভাবে পরাজিত করেছিল। আমাদের বোনেরা ১৫ জুলাই ভিসি চত্বরে সন্ত্রাসীদের আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে এই সংগ্রামকে বিশ্বব্যাপী ত্বরান্বিত করেছিল।সেই ১৬ তারিখ শহীদ মিনারে ভাইদের পাশে ঢাল হয়েছিল বোনেরা। গোটা দেশে ছয় জন শহীদ হলে দেশ যখন থমথমে পরিস্থিতি সে রাতেই রোকেয়া হলসহ অন্যান্য হল গুলো থেকে সম্মিলিত গান ভেসে এসেছিল “মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান লেখা আছে অশ্রুজলে।” সে গানটা ছিল গোটা দেশবাসীর জন্য সাহস। রাত যখন আরো গভীর হল সুফিয়া কামাল হল থেকে সম্মিলিত এক জাদুকর প্রতিবাদী আওয়াজ বেরিয়ে এসেছিল “আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না, আমার বোনের রক্ত বৃথা যেতে দেব না” /“চারিদিকে হামলা কেন, প্রশাসন জবাব চাই।”
সেই রাতগুলোতে পরদিন রাস্তায় নামার সাহস ছিল বোনদের এই প্রতিবাদী কন্ঠস্বর।আমরা দেখেছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ভয়াবহ রাতগুলো, যেখানে বোনেরা ভাইদের ছেড়ে যায়নি। আমি দেখেছি ১৮ জুলাই বসুন্ধরা থেকে রামপুরা পর্যন্ত বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বোনদের যারা ভাইদেরকে পেছনে রেখে সামনে দাঁড়িয়ে মিছিলকে নেতৃত্ব দিয়েছেল।সে ১৮ তারিখ একটা মেয়েও পিছু হটেনি। রক্ত ঝরিয়ে ঝরিয়ে সামনে অগ্রসর হয়েছিল। আমার সেই সময়ের কথা মনে পড়ে যখন একজন আহতকে নিয়ে এক বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম তখন একজন মা তার বাসায় থাকা তিনটি লাঠি, টিয়ারগ্যাস থেকে বাঁচতে একটি পেপসোডেন্টের টিউব ও দেশলাই হাতে তুলে দিয়ে আশির্বাদ করেছিলেন।
আমি দেখেছি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের অভিভাবকদের কথা অমান্য করে রাষ্ট্রকে বেছে নিতে এবং ১৯ তারিখ বসুন্ধরা গেটে জমায়েত হয়ে হেলিকপ্টার থেকে টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেটের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়ে রাস্তায় পড়ে প্রতিবাদ জানাতে।
আমি দেখেছি হাইকোর্টের সামনে ভাইদের প্রিজন ভ্যানে করে নিয়ে যাবার সময় ভ্যানের সামনে ভাইকে রক্ষায় বুক পেতে দেওয়া সেই দুঃসাহসী বোনকে।যে সাহস সবার মাঝে সংক্রামিত হয়েছিল। আমি দেখেছি ৩ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে হাসিনার ছবিতে রং মেরে মেরে পদত্যাগের স্লোগান তুলতে ও বিভিন্ন গ্রাফিতে আকতে।
এই গণঅভ্যুত্থানে বোনদের সাহস ছিল সংক্রামক। ভাই বোন একসাথে লড়েছে, মার খেয়েছে, জেলে বন্দী হয়েছে। আমাদের বোনেরা আপোষহীন থেকে ভাইদের লড়াইয়ে উজ্জীবিত রেখেছে।আমাদের নারীরাই ছিল এই গণঅভ্যুত্থানের সাহস।
এখন সময় গণঅভ্যুত্থানকে স্মৃতিচারণের। আমি স্বপ্ন দেখি আমার বোনেরা হল গুলোতে সেই ১৬ তারিখ রাতের মতো করে মাঝে মাঝে সেই স্লোগান ও গান গেয়ে আমাদের গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতিকে সতেজ রাখবেন। আমাদের সাহসী সেই মা ও বোনদের জন্য একটি সুস্থ নিরাপদ রাষ্ট্র বিনির্মাণই হোক এই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী প্রথম নারী দিবসের অঙ্গীকার।
লেখক: মোঃ আবিদুল ইসলাম খান
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।