বঙ্গবন্ধু পরিবার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


ড. শেখ আবদুস সালাম | Published: 2017-08-22 21:56:36 BdST | Updated: 2024-05-04 15:03:07 BdST

শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানসহ বিএ ডিগ্রি গ্রহণ করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। তিনি সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন।

সে সময় আইন বিভাগের হেড অব দি ডিপার্টমেন্ট ছিলেন অধ্যাপক এম ইউ সিদ্দিক। ভর্তির সময় তিনি তাকে নিয়মিত মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার রোল নম্বর ছিল-১৬৬। আইনের ছাত্র শেখ মুজিব তখন এসএম হলের সংযুক্ত ছাত্র হলেও তিনি থাকতেন মোগলটুলিতে। একটি সাইকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন দান এবং ভীষণভাবে তাদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ২৬ মার্চ (১৯৪৯) বিশ্ববিদ্যালয় এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করায় তার আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা সম্ভব হয়ে উঠেনি।

 কেবল বঙ্গবন্ধুই নন, তার পরিবারের অনেক সদস্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথা এই ক্যাম্পাসের সরাসরি শিক্ষার্থী ছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সর্বজ্যেষ্ঠ সন্তান (জন্ম : ২৮.০৯.১৯৪৭ সাল)। তিনি ২৬ আগস্ট ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন রোকেয়া হলের সংযুক্ত ছাত্রী। রোকেয়া হল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে লেখা এক পত্রে (রোহ/পিএফ/৬১/২০১৬ তাং ৩.৮.২০১৬) জানা যায় শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৭-৬৮ সেশনে বিএ (সম্মান) শ্রেণিতে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। তার রেজিস্ট্রেশন নং হ-৭১৬। ক্লাস রোল : ৮৫২। ভর্তি খাতায় তার নাম ঐধংবহধ ঝযবরশয লেখা রয়েছে। সেই সময়ে রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ ছিলেন মিসেস আখতার ইমাম এবং বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক মোহম্মদ আবদুল হাই (প্রয়াত)। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী (প্রয়াত), অধ্যাপক ড. নীলিমা ইব্রাহীম (প্রয়াত), অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রমুখ তার সরাসরি শিক্ষক।  

শেখ হাসিনা ইডেন কলেজের ছাত্রী থাকাকালীন ছাত্রীদের মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে বহুবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এসেছিলেন। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ছিল তার কাছে অনেক আগে থেকেই পরিচিত। তার সহপাঠীরা আজও অনেকেই বেঁচে আছেন। তাদের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার সাদামাঠা জীবন ও বন্ধুবৎসল গুণের কথা এখনো শোনা যায়। প্রয়াত বৈজ্ঞানিক ড. ওয়াজেদ মিয়া রাজশাহী বোর্ড থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে। উত্তরকালে তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং পরিণত হন বঙ্গবন্ধুর বড় জামাতায়। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কৃতী ছাত্র। তিনি ছিলেন দেশের একজন বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী। তার চাকরির স্থলও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের জন্ম ৫ আগস্ট ১৯৪৯ সালে। জানা যায় কামাল আতাতুর্কের নামের অংশ থেকে তার নাম রাখা হয়েছিল। শেখ কামালের ন্যায় শেখ জামালের নামও রাখা হয়েছিল জামাল আবদুল নাসেরের নামের অংশ থেকে। শেখ কামাল ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। তার ক্লাস রোল ছিল ২৬৮। তিনি ১৯৭২ সালে সমাজ বিজ্ঞানে অনার্স (পরীক্ষার রোল নং ৯৪২) এবং ১৯৭৩ সালে মাস্টার্স (পরীক্ষার রোল নং ২৭৬০) পরীক্ষায় [১৯৭৫ সালে অনুষ্ঠিত] অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালে তিনি যেমন ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা, তেমনি সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া, সংস্কৃতি, সামাজিক সংগঠন প্রভৃতি সব জায়গায় তার পদচারণা ছিল সক্রিয়। শেখ কামাল তার শিক্ষকদের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তার সরাসরি শিক্ষক প্রয়াত অধ্যাপক রঙ্গলাল সেন একদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘আসলে শেখ কামালের গুণের কোনো অভাব ছিল না। প্রতিদিন সমাজবিজ্ঞান বিভাগে আসা, আড্ডা দেওয়া, রাজনীতি তো আছেই, বিভাগের উন্নয়ন, বিভাগের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সপ্তাহ আয়োজন, বিভাগের জন্য একটি সমৃদ্ধ মিউজিয়াম গড়ে তোলা, বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলাধুলা ও কালচারাল অনুষ্ঠান সংগঠিত করা সব জায়গাতেই শেখ কামালের পদচারণা, অংশগ্রহণ কিংবা নেতৃত্বদান এটা ছিলই। ’

শেখ কামাল এক সময় মনোযোগ দিয়েছিলেন আবাহনী ক্লাব গঠনে। এই ক্লাবটি গঠনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আধুনিক ফুটবল প্রবর্তনের ক্ষেত্রে শেখ কামালের অবদান অপরিমেয়। শেখ কামাল সম্পর্কে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তার এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ‘আমি যখন ডাকসুর ভিপি তখন একবার ভিসি স্যারের কাছে গেলাম যে ছাত্রদের থাকার জায়গা নেই, আপনি হলের ব্যবস্থা করেন। স্যার বললেন, আমার তো টাকা নেই। বললাম যা আছে তাই দিন, বাকিটা আমরা ছাত্ররা স্বেচ্ছাশ্রমে করে দেব। এএফ রহমান হল। আমিসহ শত শত ছাত্র ভলান্টিয়ার হিসেবে মাথায় করে ইট-বালু টেনেছি, টিনের বেড়া লাগিয়েছি। চুয়াত্তর সালে একবার ভয়াবহ বন্যা হলো, সমস্ত বীজতলা নষ্ট হয়ে গেল। আমরা সেদিন রেসকোর্সে ট্রাক্টর এনে বীজতলা তৈরি করেছি, আবার চারা উঠিয়ে হেলিকপ্টারে করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গেছি। শেখ কামাল আমাদের সঙ্গে এসব কাজেও অংশগ্রহণ করত। ’

তিনি আরও জানান, ‘আমরা ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্রলীগ মিলে অ্যাকশন কমিটি করলাম যে, গ্রামে সামার ভ্যাকেশনের সময় এক মাস দেশের সব জায়গায় আমাদের ‘ছাত্র ব্রিগেড’ থাকবে। মানুষের কাছে রাষ্ট্রীয় চার নীতি— গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্র এগুলো পৌঁছে দেবে। গ্রামে গিয়ে দেখা গেল যে কৃষকরা লেখাপড়া জানে না, অক্ষরজ্ঞান নেই, এমনকি ক খ চেনে না; ১, ২ বলতে পারে কিন্তু পড়তে পারে না। আমাদের ছাত্র ব্রিগেড গ্রামে গিয়ে মাঠে যেসব গরু ঘাস খায় কৃষকের সম্মতি নিয়ে কাগজে ক খ অক্ষর লিখে একেকটা গরুর পিঠে তা বসিয়ে দিল। কোনো কোনোটার পিঠে ১, ২ সংখ্যা লাগিয়ে দিল যাতে কৃষকরা বর্ণ এবং সংখ্যাগুলো বুঝতে পারে। এটা ছিল নিরক্ষরতা দূর করার একটি অভিযান। ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রলীগের অনেকে সেখানে ছিল, শেখ কামালও ছিল— সবাই মিলে আমরা এসব কাজ করেছি। ’