মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা কার নেওয়া উচিত?


Prothom-alo.com | Published: 2017-08-26 19:53:52 BdST | Updated: 2024-05-04 22:41:58 BdST

বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসেবে এ বছর যারা এইচএসসি পাস করেছে, তাদের একটি বড় অংশই চিকিৎসক হওয়ার লক্ষ্যে মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেবে। দীর্ঘকাল ধরে এই ভর্তি পরীক্ষাটির আয়োজন করে আসছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আমাদের প্রশ্ন: এ পরীক্ষাটি নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরই যথাযথ প্রতিষ্ঠান কি না।

বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষাদান ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে পাঁচ ধরনের শাখা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এগুলো হলো: বিভাগ, ইনস্টিটিউট, উপাদানকল্প (কনস্টিটিউয়েন্ট) কলেজ, অধিভুক্ত (অ্যাফিলিয়েটেড) কলেজ এবং কেন্দ্র (সেন্টার)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে উল্লিখিত পাঁচ ধরনের শাখা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলো তারাই, যারা এই পাঁচটি শাখা প্রতিষ্ঠানের কোনো না কোনোটির ছাত্র।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাদানকল্প কলেজের সংখ্যা বর্তমানে মোট ১০৫। এগুলোর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের সংখ্যা যথাক্রমে ৫৫ ও ৯। দেশের মোট যে ১০৫টি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ রয়েছে, সেগুলোর ৬৪টিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা প্রতিষ্ঠান, যার সংখ্যা মোটে শতকরা ৬০ ভাগ। অবশিষ্ট যে ৪১টি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ রয়েছে, তার সংখ্যা শতকরা ৪০ ভাগ এবং এগুলো রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ অন্য কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা প্রতিষ্ঠান।

আমরা সবাই জানি যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো নয়ই, নয় কোনো শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানও। আর এ জন্যই আমরা বলতে চাই যে এ ভর্তি পরীক্ষাটি কোনো বিচারেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেওয়া উচিত নয়। যার দায়িত্ব কোনোভাবেই শিক্ষাদান নয়, সে দপ্তরটিই কোন যুক্তি ও অধিকারবলে এই পরীক্ষা গ্রহণ করে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। যদি এমন যুক্তিও দেওয়া হয় যে বিগত কোনো আদেশ বা বিধানের ফলেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ দায়িত্ব পালন করে, তাহলেও বলব, এমন আদেশ বা বিধান ত্রুটিপূর্ণ। তাহলে প্রশ্ন, ভর্তি পরীক্ষাটি কে নেবে? অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়। এর কারণ দুটি:

এক. মেডিকেল ও ডেন্টাল শিক্ষার অর্থ যথাক্রমে এমবিবিএস এবং বিডিএস ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে শিক্ষা। এমবিবিএস হলো ব্যাচেলর অব মেডিসিন এবং ব্যাচেলর অব সার্জারি। অর্থাৎ যারা এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করে, তারা একই সঙ্গে দুটো স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে: একটি মেডিসিনে, অন্যটি সার্জারিতে। অন্যদিকে বিডিএস হলো ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি। অর্থাৎ বিডিএস ডিগ্রিধারীরা ডেন্টাল সার্জারিতে স্নাতক। যেহেতু এমবিবিএস ও বিডিএস দুটোই স্নাতক ডিগ্রি, সেহেতু এটি উচ্চশিক্ষার প্রথম ধাপ এবং এই শিক্ষাদানের যথাযথ প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়। এ জন্যই এই ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার অধিকারও বিশ্ববিদ্যালয়েরই।

দুই. যারা এমবিবিএস এবং বিডিএসে ভর্তি হয়, তাদের কোনো না কোনো মেডিকেল বা ডেন্টাল কলেজের অঙ্গীভূত হয়েই শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে হয়। উভয় প্রতিষ্ঠানই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাদানকল্প কলেজ হওয়ায় এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়েরই শাখা প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের, সেই প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ভর্তি করার অধিকার এবং দায়িত্বটিও সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরই যে বর্তায়, তা না বললেও চলে।

কারও কারও কাছে মনে হতে পারে, যে দায়িত্বটি দীর্ঘকাল ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পালন করে যাচ্ছে, তার হাতবদলের আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি? আমরা মনে করি, আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক গৃহীত বিগত বছরগুলোর বেশ কয়েকটি পরীক্ষাই প্রশ্নবিদ্ধ। বছর দুয়েক আগে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া অসংখ্য ছাত্রছাত্রী প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ তুলে রাজপথে আন্দোলন করেছে। এই অভিযোগ আমলে নিয়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি সমন্বয়ে যে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল, সে কমিটির তদন্ত ফলও অভিযোগের সত্যতাকেই তুলে ধরেছে।

কথা আরও আছে। ‘সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ’ এবং ‘বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ’ নামে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই দুটো উপাদানকল্প কলেজ। এর ছাত্রছাত্রীরা অর্জন করে ‘বিএইচএমএস’ নামের স্নাতক ডিগ্রি। ‘সরকারি ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ’ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাদানকল্প আর একটি কলেজে পড়াশোনা করে ছাত্রছাত্রীরা অর্জন করে ‘বিইউএমএস’ এবং ‘বিএএমএস’ নামের স্নাতক ডিগ্রি। এ কলেজগুলো থেকে যে চিকিৎসকেরা বের হয়ে আসেন, যদি প্রশ্ন করি, তাঁদের ভর্তি পরীক্ষা কেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গ্রহণ করে না? অধিদপ্তর কী উত্তর দেবে? কী উত্তর দেবে যদি প্রশ্ন করি চিকিৎসকদের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি, অর্থাৎ এমডি, এমএসের ভর্তি পরীক্ষা কেন অধিদপ্তর গ্রহণ করে না? এফসিপিএস এবং এমসিপিএসের ভর্তি পরীক্ষা কেন বিসিপিএসের হাতে, কেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাতে নয়? এই পর্যায়ে এটিও স্মর্তব্য যে অধিভুক্ত সব কলেজের স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ই করে থাকে।

আমরা আগেই বলেছি, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তারাই, যারা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো না কোনো শাখা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র। যে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের পাঠ্যক্রম-পাঠ্যসূচি তৈরি ও অনুমোদন করে, ছাত্রছাত্রী ভর্তির আসন নির্ধারণ করে, ছাত্রছাত্রীদের নিবন্ধনের ব্যবস্থা করে, সব পেশাগত পরীক্ষা পরিচালনা করে, ফল প্রকাশ করে, সন্তোষজনক শিক্ষা কার্যক্রমের অভাব হলে কলেজের অনুমোদন বাতিল করে, সমাবর্তনের মাধ্যমে ডিগ্রি প্রদান করে, সেই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করবে না, তা কোনোভাবেই স্বীকার্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে যদি প্রশ্ন করা হয়, যে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি পরীক্ষা আপনারা গ্রহণ করেননি, তাদেরই নিবন্ধন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিচয়ে আপনারা কীভাবে পরিচিত করছেন, কী উত্তর হবে? আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে বলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যে ছাত্রছাত্রীদের আমরা ভর্তি করিনি, তাদের আমরা রেজিস্ট্রেশন দেব না, তখন আপনারাই-বা কী করবেন?

বস্তুত যার যে দায়িত্ব, তার সে দায়িত্বই পালন করা উচিত। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাদানকল্প কলেজ হিসেবে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ রয়েছে, সেসব বিশ্ববিদ্যালয় একটি ভর্তি কমিটির মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে এই পরীক্ষাটি গ্রহণ করতে পারে। আমরা আশা করি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আলোচ্য ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের অনধিকারচর্চা থেকে সরে আসবে, আর সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবে। ব্যাপারটি যত দ্রুত হয়, ততই মঙ্গল। মঙ্গল প্রশ্নবিদ্ধ পরীক্ষা থেকে মুক্তির জন্যও।

ড. সাখাওয়াৎ আনসারী: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

এমএসএল