শাসন নয়, এটা শিক্ষার্থী নির্যাতন


Prothom-alo.com | Published: 2017-08-28 06:23:20 BdST | Updated: 2024-05-04 20:06:27 BdST

ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার শেরপুর ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ মো. হোসেন আহমেদ ভীষণ কড়া মানুষ। নিজে নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলেন। তাই তিনি চান বাকি সবাই নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলবে। নিয়ম-শৃঙ্খলার একটু এদিক-ওদিক হলে তিনি তা সহ্য করতে পারেন না। এই তো সেদিনের ঘটনা মাদ্রাসার এক ছাত্রী কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই টিফিন টাইমের ছুটিতে বাড়ি চলে যাচ্ছিল। ঘটনা টের পেতেই ভীষণ রাগ করেন তিনি। চিকন বেতের লাঠি হাতে পিছু নেন ওই ছাত্রীর। নাগালের মধ্যে আসতেই ছাত্রীকে বেতের লাঠি দিয়ে পেটানো শুরু করেন। মারের চোটে একসময় প্রচণ্ড যন্ত্রণায় সে সড়কে পড়ে যায়। পড়ে গুরুতর আহত অবস্থায় ছাত্রীটিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই না হলে উপাধ্যক্ষ! মাদ্রাসায় নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তিনি যে দৃষ্টান্ত তৈরি করলেন, এরপর আর কেউ সাহস করবে বিনা অনুমতিতে মাদ্রাসা ত্যাগ করার?
হোসেন আহমেদের মতো এ রকম আরেকজন কড়া শিক্ষক আছেন। তিনি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম। গত সোমবার পরীক্ষার সময় ছবি দেখে আমপাতা আঁকতে পারছিল না প্রথম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া। এতে ভীষণ রাগ হয়ে যায় নুরুল ইসলামের। একটি বেত নিয়ে সুরাইয়ার পিঠে একাধিক আঘাত করেন।
তবে শুধু হোসেন আহমেদ বা নুরুল ইসলাম নন, দেশে এ রকম শিক্ষক ভূরি ভূরি আছেন। মাঝেমধ্যেই পত্রিকার পাতায় তাদের কর্মকাণ্ডের খবর ছাপা হয়। আর এসব খবর পড়ে আমরা দুঃখ পাই, বেদনাহত হই।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১০ সালে দেশের সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে এক পরিপত্র জারি করে। পরিপত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি দেওয়া বন্ধ করতে এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যাঁরা শারীরিক শাস্তি দেবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১৮৬০, ১৯৭৪ সালের শিশু আইন এবং ক্ষেত্রমতে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগ গ্রহণেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী নিষিদ্ধ করা শাস্তিগুলো হলো: হাত-পা বা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত বা বেত্রাঘাত, শিক্ষার্থীর দিকে চক বা ডাস্টার ছুড়ে মারা, কামড় দেওয়া, চুল টানা বা চুল কেটে দেওয়া, হাতের আঙুলের ফাঁকে পেনসিল চাপা দিয়ে মোচড় দেওয়া, ঘাড় ধাক্কা দেওয়া, আছাড় দেওয়া ও চিমটি কাটা, কান টানা বা কান ধরে ওঠ-বস করানো, চেয়ার, টেবিল বা কোনো কিছুর নিচে মাথা দিয়ে দাঁড় করানো বা হাঁটু গেড়ে দাঁড় করিয়ে রাখা, রোদে দাঁড় করে বা শুইয়ে রাখা কিংবা সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করানো এবং ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে এমন কোনো কাজ করানো, যা শ্রম আইনে নিষিদ্ধ৷
এই পরিপত্র জারি হয়েছে সাত বছর আগে। এই সাত বছরে বহু শিক্ষক তাঁদের শিক্ষার্থীদের মারধর করেছেন। কেউ কেউ এমন মারই মেরেছেন যে শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। মারের অপমান সহ্য করতে না পেরে অনেক শিক্ষার্থী স্কুল ছেড়েছে। আবার শিক্ষার্থী আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু এ জন্য কোনো শিক্ষক শাস্তি পেয়েছেন এমনটা কখনো শুনতে পাইনি। শাস্তি হিসেবে বড়জোর তাদের বরখাস্ত করা হয়। এর বাইরে আর কোনো শাস্তির কথা জানা যায় না।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজন শিক্ষার সুষ্ঠু, সুন্দর ও ভয়হীন পরিবেশ। শাস্তি শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির বাইরেও শিক্ষার্থীকে হীন করে গড়ে তোলে, ফলে তারা মনোবল হারিয়ে ফেলে। শারীরিক শাস্তিতে শিক্ষার্থীর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন করা সম্ভব হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে শিশুকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা যেন নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বোঝা যাচ্ছে, শিশুদের শারীরিক শাস্তি বন্ধ করতে এসব সরকারি পরিপত্র জারি করাই যথেষ্ট নয়। এ জন্য প্রয়োজন বিশেষ আইন যে আইনে শিক্ষার্থীদের শাস্তি দানকারী শিক্ষকদের পার পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। এ ছাড়া যেকোনো ধরনের শাস্তি যে শিশুর জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না বরং তার ক্ষতি করে—এ বার্তাটি ছড়িয়ে দিতে হবে। কারণ, দেখা যায় শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নয়, শিশুরা নিজ বাড়িতেও নির্যাতনের শিকার হয়। কাজেই শিক্ষক-অভিভাবক সবাইকে সচেতন হতে হবে।
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক

 

এমএসএল