সবাইকে কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে?


ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ | Published: 2017-09-19 03:25:12 BdST | Updated: 2024-05-04 23:04:26 BdST

আমার মনে পড়ে ১৯৮০ সালে আমি প্রথম তাজমহল দেখতে আগ্রা যাই। বুকের ভেতর একটি তাজমহল তো ছিল ছেলেবেলা থেকেই। সুতরাং প্রচণ্ড আবেগ আর আগ্রহ নিয়েই তাজমহলের কাছে গিয়েছিলাম। তাজমহলের মূল ভিত্তির নিচে মমতাজ মহলের আসল সমাধিটি আর উপরে দর্শকদের সামনে দৃশ্যমান সমাধি মূলের অনুকৃতি। সে যাই হোক, মর্মর পাথরে বাঁধানো কবরের গা জুড়ে বিচিত্র রঙের ফুল-লতা-পাতা ঝলমল করছে। আমি ভাবলাম বুঝি নতুন করে সংস্কার করেছে। রঙগুলো খুব টাটকা। হয়তো এখনো শুকোয়নি। আঙুল ছোঁয়ালেই রঙ লেগে যাবে। কৌতূহল চেপে রাখতে পারলাম না। সকলের অগোচরে স্পর্শ করলাম। ভুল ভাঙলো আমার। এসব রঙ নয় পাথর কেটে কেটে মিনা করে বসানো। জানলাম—এগুলো আদিতে অর্থাত্ তাজমহলের সৃষ্টিকালেই গড়া। অমন নির্মাণশৈলী দেখে বিস্মিত হতে হয়। তখন আমার মনে হয়েছিল আমরা কি সত্যিই এগুতে পেরেছি! মিশরে বিখ্যাত গিজা পিরামিডের সামনে দাঁড়ালেও একই বিস্ময় জাগে। পাঁচ হাজার বছর আগে স্থপতির হাতে আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতি ছিল না। তাহলে কেমন করে তৈরি করতে পারলো এই বিশাল অত্যাশ্চর্য পিরামিড!

সাধারণ মানুষের প্রচলিত কথা ‘যায় দিন ভালো যায়’। আসলেও বোধ হয় তাই। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি ভাবনা আমাকে খুব বিচলিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারে-কাছে যারা আসতে পারেননি সেই সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে আঁকা ছবিটা সাধারণত অন্যরকম থাকে। তারা মনে করেন, এটি জ্ঞানচর্চার পুণ্যভূমি। শিক্ষা-সমাজের অভিজাত এলাকা। এখানে ছাত্র-শিক্ষক ভাবনায়, পোশাকে, আচার-আচরণে একটু অন্য রকম হবেন। হবেন মার্জিত এবং মানবিক।

আমি ১৯৭০ সালের কথা মনে করতে পারি। কুমিল্লার হোমনা থানায় আমার বড় ভগ্নিপতির পোস্টিং। থানা পর্যারে বড় কর্মকর্তা। সার্কেল অফিসার। আমাকে ভর্তি করে দেয়া হলো হোমনা হাইস্কুলে। তখন নারায়ণগঞ্জ থেকে হোমনা যাওয়ার একমাত্র বাহন লঞ্চ। আমি যখন নারায়ণগঞ্জ আসতাম অফিসের পিয়ন আমাকে সারেং-এর জিম্মায় দিয়ে দিতো। সিও সাহেবের পরিচয়ে আদর-যত্ন পেতাম। আপার ক্লাসে চারদিক ঘোরানো বসবার বেঞ্চ ছিল। আমারও ঠাঁই হতো সেখানে।

সবে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান শেষ হয়েছে। উত্তপ্ত ঢাকা। লঞ্চের দু’একটি স্মৃতি এখনো বেশ মনে আছে। কোনো এক স্টপেজ থেকে দু’জন তরুণ উঠেছে লঞ্চে। সে যুগে সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন পোশাকী আড়ম্বর ছিল না। আটপৌরে পোশাকই ছিল অধিকাংশের। তরুণ দুজন ব্যতিক্রম। ফুল প্যান্টে ধবধবে সাদা শার্ট ইন করা। পায়ে চামড়ার জুতো। পরিপাটি করে মাথা আঁচড়ানো। একজনের চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। আপার ক্লাসে সব কটি আসনই পূর্ণ। তবু কয়েকজন মাঝবয়সী যাত্রী শশব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সকলকে একটু চেপে বসিয়ে তরুণ দুজনের বসার ব্যবস্থা করলেন। এসব দেখে আমার মধ্যে একটু বাড়তি সম্ভ্রম তৈরি হলো দুই তরুণের প্রতি। নিশ্চয়ই তারা বিশেষ কেউ হবেন। আলোচনায় বুঝলাম তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সবাই তাদের কাছ থেকে ঢাকার পরিস্থিতি জানতে চায়। তরুণ দু’জন ধীরে ধীরে চমত্কার শব্দ চয়নে উত্তর দিচ্ছিলেন। আমি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়লাম। অতদিনের কথা খুব বেশি আর মনে করতে পারছি না। কিন্তু এটি ঠিক এই দুই জ্যোতির্ময় তরুণকে দেখে সেদিন ক্লাস সিক্সে পড়া ছোট্ট আমার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার ইচ্ছে জেগেছিল।

পাশাপাশি গত দু’বছর আগের কথা মনে পড়লো। ঢাকা শহরে আমি বাসে মিরপুর যাচ্ছিলাম। সামনের সিটে তিনজন তরুণ বসা। দু’জনের পরনে জিনসের প্যান্ট আর গায়ে টি-শার্ট। অন্যজন শার্ট-প্যান্ট পরা। হাল-ফ্যাশনের হেয়ার কাট। কন্ডাক্টর ভাড়া চাইলে ওরা জানালো—বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। হাফ ভাড়া রাখতে হবে। কন্ডাক্টর আইডেন্টিটি কার্ড দেখতে চাইলো। এবার আত্মসম্মানে লাগলো ছাত্র তিনজনের। বাসকর্মীর শার্টের কলার ধরে চড় বসাতে উদ্যত হলো। আমার পাশের এক যাত্রী প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন। তার পাশের জন থামিয়ে দিলেন। বললেন—এসব ছাত্রদের বিশ্বাস নেই। হয়তো আপনাকে অপমান করে বসবে। কন্ডাক্টর হাফ ভাড়া কেটে রাগে গড় গড় করতে করতে গেটের কাছে গিয়ে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন— চেহারা দেখে কি বোঝা যায়, এমন চেহারার ছাত্রও আছে আবার সন্ত্রাসী- ছিনতাইকারীও আছে। আমি লজ্জায় অধোবদন হয়ে বসে রইলাম।

আরেকটি অভিজ্ঞতা। ১৯৭৫-৭৬-এর দিকে হবে। আমার ফুপা থাকেন শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে। একবার বেড়াতে গেছি। ফুপাতো ভাই মন্টুদা বললেন, আমার এক বন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। মাসুদ দোতলাতেই থাকে। ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমি তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দেখিনি। তাঁকে কাছে থেকে এখানেই দেখতে পাবো! একটা রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, ওই মুহূর্তে মন্টুদা আমার চোখে আগের চেয়েও অনেক বড় কেউ হয়ে গেলেন। আর এ সময়ের বাস্তবতায় সাধারণ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কতটা সম্মান হারিয়েছেন তা দেখে ও শুনে খুব অসহায় বোধ করি।

‘শিক্ষা সকলের অধিকার’ কথাটি সবাই মানেন। তবে স্লোগান দিয়ে যারা মাঠ গরম করেন তাদের সাথে আমি একমত নই। সবাইকেই কেন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আসতে হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে সেই শিক্ষার্থী যে ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষার আরো সোপান পেরুতে চায়। দেশে বা বিদেশে যেতে চায় উচ্চতর জ্ঞানচর্চার জন্য। যে শিক্ষার্থী গবেষণা করতে চায় নিজ নিজ ক্ষেত্রে। কিন্তু উপায় কী এই উপমহাদেশের মানুষের! বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বা সুযোগ আছে তেমন সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পাস না করলে সরকারি বেসরকারি বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবে না। এম.এ, এম.এসসি, এম.কম পাস না করলে সামাজিক মর্যাদা থাকে না। বিয়ের বাজারেও মূল্য কমে যায় পাত্র বা পাত্রীর। এসবই হয়েছে আমরা বদ্ধ কাঠামো থেকে বেরুতে পারছি না বলে। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতে সকলকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয় না। বুনিয়াদি শিক্ষার পর বিশেষ করে আমাদের ইন্টারমিডিয়েট সম-স্তরের পাঠের পর শিক্ষা ব্যবস্থাপকরা শিক্ষার্থীর মেধা ও ঝোঁক অনুযায়ী ঠিক করে দেন কে কোন্ ধরনের ট্রেড কোর্স বা ডিপ্লোমা ইত্যাদি সম্পন্ন করবে। এরপরই তারা চাকরির বাজারে চলে যেতে পারে। সমস্ত বিধি-ব্যবস্থাটিই সেভাবে করা আছে। খুব কম শিক্ষার্থীরই আগ্রহ থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তাদের অধিকাংশ স্নাতক শেষ করে চলে যায়। ওদের সমাজ বাস্তবতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আলাদা মর্যাদা বাড়ানোর কিছু নেই। অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থীই স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে। সকলে মেনেই নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে গবেষণার জায়গা। যাদের সেদিকে ঝোঁক তারাই সেখানে যাবে। এসব কারণে অধিকাংশ দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ব্যয়সাপেক্ষও।

আমাদের সমাজ বাস্তবতা ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা সকল শিক্ষার্থীকে ঠেলে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই ধীরে ধীরে তা কম মনোযোগ দেয়া পাঠশালায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই বলছি, ক্লাসরুম সংকট প্রচণ্ড। সব বর্ষের ক্লাস চললে মাঝে মাঝে ক্লাসরুমের অভাবে ক্লাস নেয়া সম্ভব হয় না। অনেক ক্লাসরুমের যা ধারণ ক্ষমতা তাতে ক্লাসের সকল শিক্ষার্থীর আসন সংকুলান হয় না। বাজেট স্বল্পতার কারণেই হোক বা চৌর্যবৃত্তির কারণেই হোক ক্লাসরুমের ফ্যানগুলো সশব্দে ঘোরে। ফ্যানগুলো একসাথে ঘুরলে লেকচার শোনা কষ্টকর। তাই ক্লাসে ঢুকলে দেখি শিক্ষার্থীরা নিজ গরজেই ফ্যানের সুইচ অফ করে দেয়। এই গরমে ঘাম মুছতে মুছতে ক্লাসে কথা বলি আর শিক্ষার্থীরা চেষ্টা করে মনোসংযোগ করতে।

আমি সান্ত্বনা দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের বলি আর ক’টা বছর কষ্ট করো। বিসিএস অফিসার যখন হবে তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে পিএটিসিতে ট্রেনিংয়ে আসবে, দেখবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সকল সুবিধাসহ আধুনিক ক্লাসরুম আছে তোমাদের জন্য। জ্ঞানচর্চার চেয়ে আমলা তৈরি জরুরি এদেশে। তাই বলছিলাম আমলা তৈরি বা পেশাজীবী তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি জরুরি কেন? বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিকতায় না গিয়ে বিকল্প ব্যবস্থায় কেন যেতে পারছি না?

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক যাঁরা তাদের আমি ঠিক বুঝতে পারি না। পত্রিকা থেকে জানলাম দেশের সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষক ও প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কয়েক হাজার পদ খালি। অন্যদিকে বিসিএস দিয়ে যারা দ্বিতীয় শ্রেণির অফিসার হয়েছেন তাদের পদায়ন করা যাচ্ছে না। তাই এই অফিসারদের আপাতত প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার আর মাধ্যমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষক বানিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমার প্রথম বিশ্বাস হয়নি। পরে বুঝলাম শিক্ষা নিয়ে এমন ছেলেখেলা এদেশেই বুঝি সম্ভব। সকলের সকল বিষয়ে আগ্রহ থাকে না। যাদের কখনো শিক্ষকতা করা ভাবনার ভেতরেই ছিল না তাদের জোর করে ক্লাসরুমে ঢুকিয়ে দিচ্ছি। এদেশের শিক্ষার্থীরা সত্যিই বিধায়কদের গিনিপিগ। আমি বিশ্বাস করি শিক্ষক যখন নিজেকে শিক্ষক না ভেবে চাকুরে ভাবেন তখন শিক্ষকের ঔজ্জ্বল্য তার কাছ থেকে আশা করা যায় না।

প্রসঙ্গটির অবতারণা করলাম আমার মূল বক্তব্যকে স্পষ্ট করার জন্য। যদিও খুব সহজ হবে না তবুও আমি মনে করি প্রাইমারি থেকে উচ্চশিক্ষার ধারা এবং ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন করে ভাবার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পদ্ধতি ও কারিকুলাম নিয়ে আমূল সংস্কারের প্রস্তাব আমাদের থাকবে। তবে বুঝতে পারছি এই পথটি সহজ নয়। রাজনীতির সুবিধালোভীরা এ ধারার চিন্তায় প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়াবেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখন আংশিকভাবেই জ্ঞানচর্চার ভূমি বলা যেতে পারে। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান পরিচিতি এখন ছাত্র রাজনীতি আর শিক্ষক রাজনীতির ঊর্বর ভূমি হিসেবে। রাজনীতি চর্চা তো আর নিন্দনীয় নয়। সে অর্থে এখানে যদি সুস্থ রাজনীতি চর্চার চাষ হতো তবে তেমন আফসোস ছিল না। এর বদলে হচ্ছে দলতন্ত্রের চাষ। রাজনীতি অঙ্গনের ছাত্র চাচ্ছে পেশীশক্তির চর্চায় নিজেদের অবস্থাশালী আর ক্ষমতাশালী করে তুলতে অন্যদিকে রাজনীতিতে নিমগ্ন শিক্ষক চাইছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা এবং সেই সূত্রে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছতে। এসবের পর সময় সুযোগ থাকলে একাডেমিক বিষয় নিয়ে ভাবা যেতে পারে।

এমন বাস্তবতায় নষ্ট সময়ের ঘেরাটোপ থেকে জাতির ভবিষ্যেক রক্ষা করতে হলে সকল শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার কাঠামো ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমাদের অবশ্যই নতুন করে ভাবতে হবে।

লেখক :অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক 

এমএসএল