প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও ৫ই জুন পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ভুমি পুনরুদ্ধার, মরুময়তা এবং খরা সহনশীলতা। বাংলাদেশ সরকার এর বাঙলা ভাবানুবাদ করা করেছে “করবো ভূমি পূনরুদ্ধার, রুখবো মরুময়তা/ অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা”। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক কর্মসূচীর সবচেয়ে বড় এই আয়োজনের এবারের আয়োজক সৌদি আরব। প্রতিপাদ্যের উপজীব্য বিষয় এবং আয়োজক দেশের প্রতিবেশ ও পরিবেশের দিকে তাকালে আয়োজনের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য সহজেই প্রতীয়মান হয়। এ বছরের নির্ধারিত এই প্রতিপাদ্যের সাথে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও করণীয় সম্মন্ধে বিশদ আলোচনার দাবী রাখে।
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে অবস্থিত এবং মৌসুমী বায়ূপ্রবাহ দ্বারা প্রভাবিত। পৃথিবীর অন্যতম কয়েকটি বায়োডাইভার্সিটিহটস্পট এলাকা যেমন ইন্দো-মালায়ান, ইন্দো-বার্মা ও সুন্দরবন অঞ্চলদ্বারা পরিবেষ্টিত বলে এই অঞ্চল জীববৈচিত্রপূর্ণ হওয়া স্বাভাবিক। এছাড়াও রয়েছে বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল। আরও রয়েছে বিপুলসংখ্যক নদী-নালা, খাল-বিল এবং অন্যান্য জলাশয় যা জীব বৈচিত্র সহায়ক। তাই এই ভূখন্ডতে মরূময়তার ঝুঁকি না থাকার কথা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নানাবিধ কারণে বাংলাদেশ বর্তমানে মরুময়তার ঝুঁকিতে রয়েছে। বনাঞ্চল কমে যাওয়া, পানির স্তর নেমে যাওয়া, জমিতে দীর্ঘ মেয়াদে সেচ প্রদান, অজৈব সার প্রয়োগ, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েলবনাক্ত জমির পরিমান বেড়ে যাওয়া, লবনাক্ত পানির চিংড়ী চাষ, জলাশয় ভরাট হওয়া, নগরায়ন, অবকাঠামো নির্মাণসহ নানাবিধ কারণ বাংলাদেশে মরুময়তার ঝুঁকি তৈরি করছে। দীর্ঘ মেয়াদে বৃষ্টিপাত না হলে খরার সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও, অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত খরার অন্যতম প্রধান কারণ। খরা বাংলদেশের কৃষি উৎপাদনকে ব্যাহত করার মাধ্যমে আর্থ সামজিক সমস্যার সৃষ্টি করে। খরা জীববৈচিত্র হ্রাস এবং নানবিধ রোগ বালাই এর অন্যতম কারণ। জলবায়ূ পরিবর্তন জনিত কারণে খরার প্রকোপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে মৌসুমীবায়ু প্রবাহজনিত বৃষ্টিপাত ক্রমাগতভাবে বিলম্বিত হচ্ছে। যার ফলে এপ্রিল-মে মাসে তীব্র তাপপ্রবাহ এবং খরার ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এইবছর বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমার এর উপর দিয়ে স্মরণ কালের তীব্রতর তাপপ্রবাহ বয়ে গিয়েছে।
মরুময়তা এবং খরার প্রকোপ প্রশমন করা এবং এর সাথে খাপ খাইয়ে চলার টেকসই উপায় এবং পদ্ধতি বের করা এখন জরুরী। এই লক্ষে আমাদের জোর দিতে হবে বনাঞ্চলের পরিমাণ বাড়ানোর দিকে এবং একই সাথে প্রাকৃতিক বনাঞ্চলকে সংরক্ষণ করার দিকে। আমাদের প্রতিবেশী ভারত এবং মিয়ানমারের সংরক্ষিত অঞ্চল যথাক্রমে ৫.২৮%, ৬.৪২%। আর সেখানে বাংলাদেশের সংরক্ষিত অঞ্চল ২% ভাগেরও কম যা লক্ষমাত্রা ১৭% এর অনেক নীচে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নেপাল ও ভুটান এই লক্ষমাত্রা অর্জন করেছে। সংরক্ষিত অঞ্চল শুধু বনাঅঞ্চলকেই বুঝায় না। জলাশয়ও সংরক্ষিত এলাকাভুক্ত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলদেশের একটি সুবিধা হল এখানে রয়েছে অনেক নদী-নালা, খাল-বিল এবং অন্যান্য জলাধার। এ গুলোকে সংরক্ষিত অঞ্চলহিসেবে ঘোষণা করে আমরা আমাদের সার্বিক সংরক্ষিত অঞ্চল বাড়াতে পারি। যেহেতু আমাদের বনাঞ্চল কম তাই জলাশয়গুলো যথাযথ সংরক্ষণ করে আমাদের জীববৈচিত্রকে সমৃদ্ধ করতে পারি। এবং একইসাথে মরুময়তাকেও রোধ করতে পারি।
জীববৈচিত্র সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমদেরকে প্রাধান্য দিতে হবে প্রাকৃতিক আবাসস্থলসমূহ সংরক্ষণ করাকে। কোনো একটি প্রাকৃতিক আবাস্থল যথাযথ সংরক্ষণ করা গেলে সেখানে অবস্থিত সকল উদ্ভিদ ও প্রাণি জগত এমনকি অণুজীবসমূহ সংরক্ষণের আওতায়ও চলে আসে। তাই সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি বা দুইটি মাত্র প্রজাতি কেন্দ্রিকসংরক্ষণ-ব্যাবস্থাপনা ধারণা থেকে বের হয়ে প্রাকৃতিক আবাস্থল সংরক্ষণের উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
জলাশয় সমূহ জীববৈচিত্রের অন্যতম প্রধান আধার। এই জলাশয় সংরক্ষণের মাধ্যমে জীব-বৈচিত্র সংরক্ষণে করা সম্ভব। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। দেশের অর্থনীতিতে এদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাই এসমস্ত নদী সংরক্ষণ করে অর্থনীতি এবং পরিবেশগত ভারসাম্য দুটিই রক্ষা করা যায়। নদী ভরাট হওয়া বা তলানি জমা একটি প্রাকৃতিক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। উজানের পলি ভাটি এলাকায় জমে ধীরে ধীরে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা। তাই নদী সচলরাখার জন্য নদী খনন করা প্রয়োজন। নদীর দূষণ রোধ করা অপরিহার্য। দুষণের প্রধান্তম কারণ শিল্প বর্জ্য, নৌযান থেকে নির্গততৈল, কৃষিজমির অজৈব সার, কীট নাশক ইত্যাদি এবংনগরেরজৈববর্জ্য। এই গুলি বন্ধ করা না গেলে নদী রক্ষা করা সম্ভব হবে না। যেসমস্ত জলাশয় ইতোমধ্যে দূষিত হয়ে গেছে সেগুলোর প্রাকৃতিক পরিবেশ পুনরুদ্ধার করা অত্যন্ত জরুরী। অধিক দূষিত জলাশয় কিংবা প্রাকৃতিক বাসস্থানসমূহকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে তাদেরকে সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা আবশ্যক।
বাংলাদেশে নগরায়ণ দ্রুত গতিতে হচ্ছে। আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের ৫৬ % মানুষ নগরে বসবাস করবে। অর্থাৎ এখনকার অনেক গ্রামাঞ্চল তখন নগরে পরিণত হবে। তাই নগরসমুহে প্রাকৃতিক ভাবে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় রাখার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত সবুজায়ন ওজলাধার। বর্তমান যুগে “নগর বনায়ন” ধারণা জনপ্রিয় হচ্ছে। যেখানে ছোট ছোট এলাকা জীববৈচিত্রপূর্ণ সবুজ এলাকায় রূপান্তরিত করা হয়। পৃথিবীর অনেক দেশে এখন এই ধরণের মডেল ব্যবহার করে সবুজায়ন করা হচ্ছে। আমাদের দেশেও এই মডেল অনুসরণ করে নগরে সবুজায়ন করে নগরকে পরিবেশবান্ধব ও বসবাস উপযোগী করা সম্ভব। এটি একইসাথে মরুকরণ রোধসহ খরা সহনশীলতা অর্জনে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশের মতো ঘন জনবসতিপূর্ণ দেশে জমির সংকট প্রকট। বাণিজ্যিক ও কর্মসংস্থানের চাহিদার জন্য এদেশের শহরগুলোতে জায়গার চাহিদা অধিক। এ কারণে এখানে ঘনবসতিপুর্ণ আবাসস্থান ও বাণিজ্যিক ভবন বৃদ্ধির ফলে খোলা ও উন্মুক্ত জায়গা কমে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় বিদ্যমান উন্মুক্ত স্থানসমূহ সাধারণ মানুষের বিচরণের জন্য উদ্যান কিংবা পার্কে পরিণত করা প্রয়োজন। এ গুলো শুধু প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্যই নয় বরং মানুষের চিত্ত বিনোদনের জন্যও প্রয়োজন।
বাংলাদেশের কৃষি জমিসমূহ রয়েছে মরুকরণের ঝুঁকিতে। জলবায়ূ পরিবর্তনজনিত কারণে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে ও বৃষ্টিপাতের হার কমে যাচ্ছে। একই সাথে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নীচে নেমে যাচ্ছে। এই অঞ্চলে অধিক বাষ্পীভবন এবং ভূ-গর্ভস্থ পানিউত্তোলনের ফলে ক্রমাগতভাবে মরুকরণের ঝুঁকিতে রয়েছে। ভূ-গর্ভস্থপানি ব্যবহার করে সেচ কাজ করার ফলে জমিতে লবণাক্ততাও ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। এর ফলে জমির উর্বরতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে জমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে দেশের উপকূল অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস এবং লোনাপানির চিংড়ী চাষের ফলে লবণাক্ততাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে এই অঞ্চলের মাটি “শারীরবৃত্তীয় খরা” ‘র ঝুঁকিতে রয়েছে।
পরিশেষে বলতে হয় বিশ্ব পরিবেশ দিবস শুধুমাত্র দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। প্রয়োজন প্রতিপাদ্য বিষয় কেন্দ্রিক কর্মসুচীগ্রহণ করা। স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী সময়োপযোগী কর্মসূচী গ্রহণ করে দেশেরমরুকরণ রুখতে রুখতে হবে। একই সাথে প্রয়োজন প্রাকৃতিক বাসস্থানসমূহকে পুনরুজ্জীবিত করা। জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরা, খরা সহনশীল ফসল উদ্ভাবন ও চাষাবাদ রপ্ত করা এবং দূষন রোধকারী কর্মসূচী গ্রহণ করা। মানুষকে সচেতন করা এবং পরিবেশ রক্ষার লক্ষে প্রণীত সকল আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করা।
লেখক: অধ্যাপক ডঃ মুহাম্মদ জাবেদ হোসেন, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ এবং প্রাধ্যক্ষ, ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল, ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়