'মিথ্যাচার নিয়ে কিছু বলা আমার রুচিতে বাধে'


manobkantho.com | Published: 2017-08-07 06:05:23 BdST | Updated: 2024-07-01 09:05:18 BdST

বাংলাদেশ জন্ম ইতিহাসের প্রতি পাতায় লেখা আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদানের কথা। এই দেশ যখনই বিপদে পড়েছে, তখনই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। আর সে কারণেই স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে অনেক রাজনৈতিক দল এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবহার করতে চেয়েছে নিজের হাতিয়ার হিসেবে। দেশকে অস্থিতিশীল করার সহজ মাধ্যম হিসেবে তারা বারবার বেছে নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। আর সে কারণেই সম্ভবত মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছিলেন ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই একটা লাশ’ ফেলার কথা।

২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু থেকে আরম্ভ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও তার পরবর্তী ২ বছর হরতাল ও অবরোধে যখন সারাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল স্থবির, সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার কার্যক্রম চালিয়ে গেছে দৃঢ়তার সঙ্গে। আর তার পেছনে মূল অবদান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের। গত ৮ বছরের বেশি সময় ধরে এই দায়িত্বে থাকাকালীন সেশন জটের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধের কথা একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন মানবকণ্ঠকে।

ঢাবি উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকের কাছে প্রশ্ন ছিল- প্রায় সাড়ে আট বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আপনি। এই দীর্ঘ সময়ে আপনি কোন বিষয়টি সবচাইতে বড় সাফল্য হিসেবে দেখছেন?
উত্তরে তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ছাত্র, শিক্ষক সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার কল্যাণে কাজ করছি। মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীরা যেন সঠিক সময়ে পাস করে বের হয়ে যেতে পারে। যুদ্ধকালীন যেমন প্রস্তুতি অনেকটা তেমন প্রস্তুতি নিয়ে আমরা নেমেছিলাম। এক সময় ৪ বছরের কোর্স শেষ করতে ৭ বছর লেগে যেত। মাস্টার্সসহ ৫ বছরের কোর্স শেষ করতে ৮ বছরের বেশি সময় লেগে যেত। সেখানে ৪ বছরের কোর্স ৩ বছর ৮ মাসে শেষ হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের হাতে সনদ দিয়ে বিদায় দিতে পারছি।
তিনি বলেন, পুরো বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কল্যাণের লক্ষ্যে আমরা কাজ করে গেছি। চেষ্টা করেছি যেন কোথাও কারো কাজ করতে সমস্যা না হয়। সেশন জট কমানো, আবাসন সমস্যার সমাধানের জন্য চেষ্টা করা হয়েছে। আমাকে এ ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়নের জন্য ৬২০ কোটি টাকার বাজেট প্রদান করা হয়েছে। এই অর্থ দিয়ে আরো বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। বিশেষত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসরুমের অপর্যাপ্ততা রয়েছে। তা দূর করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

সিনেট অধিবেশনে উপাচার্য নির্বাচনের পর থেকে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা শোনা যাচ্ছে আপনাকে ও আপনার প্রশাসনকে নিয়ে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কি?

উত্তরে আরেফিন সিদ্দিক বলেন, সমালোচনা খুব ভালো বিষয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে সমালোচনা শুনতে ভালোবাসি। কিন্তু সমালোচনার একটা সংজ্ঞা রয়েছে। সমালোচনা হলো যৌক্তিক উপায়ে ও তথ্য নির্ভর উপস্থাপনের মাধ্যমে কোনো বিষয় বা কাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা। কিন্তু যেখানে কোনো যুক্তি নেই। যেখানে তথ্য নির্ভর কোনো আলোচনা নেই, শুধু প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর লক্ষ্যে মিথ্যা কথা বলে বেড়ানো। এটা সমালোচনা নয়। এটা প্রতারণা। মানুষকে প্রতারণা করার উদ্দেশ্যে এমন মিথ্যাচার নিয়ে কিছু বলা আমার রুচিতে বাধে।

বিগত সাড়ে আট বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ চালু নিয়েও বেশ কিছু সমালোচনা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঢাবির দীর্ঘকালীন উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক বলেন, নতুন বিভাগগুলো ছিল সময়ের দাবি। সমুদ্রবিজ্ঞান, রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বা আবহাওয়া-বিজ্ঞান বিভাগ কত গুরুত্বপূর্ণ, তা হয়তো আর কিছুদিন পরেই সবাই উপলব্ধি করবে। নতুন বিভাগগুলোর অধীনে এই বিশেষ ক্ষেত্রগুলোতে এক দক্ষ কর্মী শ্রেণি পেতে যাচ্ছি আমরা।

শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া ও নয়শ’ জনের বেশি শিক্ষক বিগত সাড়ে আট বছরে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর কারণ কি- জানতে চাইলে আরেফিন সিদ্দিক বলেন, নতুন অনেকগুলো বিভাগ ও অনুষদ চালু করা হয়েছে। সেখানে শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছে। এ ছাড়াও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছেন। তাদের স্থানেও কিছু শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিয়োগের বিষয়টি একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম ও শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে।

আর শিক্ষক নিয়োগে বেশ কিছু অনিয়মের কথা বিভিন্ন স্থানে বলা হচ্ছে। শিক্ষক নির্বাচনের জন্য পৃথক একটি স্বতন্ত্র কমিটি রয়েছে। সেই কমিটিতে সভাপতি হিসেবে থাকেন প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা), ওই অনুষদের ডিন, সংশ্লিষ্ট বিভাগের চেয়ারপার্সন, এ ছাড়াও থাকেন বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সদস্যরা। তারা যাচাই-বাছাই করে যখন একজন শিক্ষককে নিয়োগের জন্য নাম প্রস্তাব করেন, সেখানে আর যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ থাকে না। এখানে যেই সমালোচনাগুলো হচ্ছে, তা সত্যের অপলাপ। একটি বিভাগে স্নাতক ডিগ্রিধারী প্রকৌশলী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও কিন্তু স্নাতক ডিগ্রিধারীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের স্নাতকোত্তর পর্ব শেষ করার শর্তেই এই নিয়োগ প্রদান করা হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একই শর্তে নিয়োগ প্রদান করেছে। মাস্টার্স পর্ব শেষ করার পর তাদের প্রভিশনাল পিরিয়ড শেষ করা হবে।

এ ছাড়াও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের জিপিএ বা সিজিপিএ নিয়ে। কিন্তু যেই শিক্ষকরা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের অনার্স এবং মাস্টার্সের ফলাফল খুবই ভালো। পূর্বে এসএসসি ও এইচএসসির ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি ব্যাচের ফলাফল খারাপ ছিল। শিক্ষা-মন্ত্রণালয় থেকেও এই ক্ষেত্রে বিষয়টি বিবেচনায় রাখার কথা বলা হয়েছিল। সবকিছু মিলিয়ে সিলেকশন কমিটি দেখে, সে যোগ্য কিনা? সাক্ষাৎকার ভিত্তিক এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগ্য কিনা তা দেখা, সাক্ষাৎকারে তার পারফরমেন্স কেমন ছিল, একজন শিক্ষক হিসেবে তার নৈতিক অবস্থা ইত্যাদি বিবেচনা করে একজন শিক্ষক নিয়োগ হয়। আমি বলতে পারি, আমি দায়িত্বে থাকাকালে কোনো একজন শিক্ষককেও এমন নিয়োগ দেয়া হয়নি, যে অযোগ্য।

আরেকটি কথা জোর গলায় বলতে পারি। আমি দায়িত্ব থাকাকালে কোনো কর্মকর্তা বা কোনো শিক্ষক অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়নি। অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দিলে বলার সুযোগ ছিল উপাচার্য নিজে নিয়োগ দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সবগুলো নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। নির্বাচন কমিটি রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট রয়েছে। সুতরাং এখানে কোনোভাবেই উপাচার্যকে এককভাবে দোষারোপ করার সুযোগ নেই। নিয়োগ প্রশাসনের ক্ষেত্রে দেখেন প্রো-উপাচার্য (প্রশাসন) এবং শিক্ষকের ক্ষেত্রে প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা)। সুতরাং শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সরাসরি উপাচার্যের কোনো ভূমিকা নেই। শিক্ষক পদন্নোতির ক্ষেত্রে উপাচার্যের ভূমিকা রয়েছে। অর্থাৎ নিয়োগ পাবার পর তাদের বিষয়ে উপাচার্য ভূমিকা রাখেন।

বেশ কিছু পত্রিকায় যা করা হচ্ছে, তা মূলত অল্প কিছু শিক্ষকের ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে ও ব্যক্তিগত আদর্শের কারণে হচ্ছে। তারা তাদের স্বার্থের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে। মুখে মুক্তিযুদ্ধে চেতনার কথা বললেও, এই চেতনাবিরোধী শক্তির সঙ্গে তারা কাজ করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বা সুযোগ নেই বলে অভিযোগ করা হচ্ছে- এ প্রসঙ্গে আরেফিন সিদ্দিক বলেন, আমি বলব, বিগত সাড়ে আট বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার বরাদ্দ ও সুযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাসের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে গবেষণা খাতে সবচাইতে বেশি বরাদ্দ প্রদান করা হচ্ছে। উন্নয়ন বাজেটেও গবেষণার জন্য বরাদ্দ রয়েছে। এ ছাড়াও বিশ্ব ব্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য ৩০টি প্রজেক্ট চালু করা হয়েছে।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক এমফিল ও পিএইচডি শিক্ষার্থী রয়েছেন। গবেষণার জন্য আমরা বেসরকারি বিভিন্ন উৎস থেকেও নিয়মিত ভিত্তিতে ফান্ডের ব্যবস্থা করেছি। সেই সঙ্গে আমাদের গবেষকদের বিভিন্নভাবে আমরা সহযোগিতা করেছি এবং করছি।

ভিসি নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এটাকে কিভাবে দেখছেন- এ প্রসঙ্গে আরেফিন সিদ্দিক বলেন, নির্বাচনে নৈতিকতা পরিপন্থী কাজের কথা যদি বলা হয়, তাহলে আমি মনে করি এই নির্বাচনে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। কিন্তু আমাদের কিছু সহকর্মী তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য কাজ করতে গিয়ে এমন এক অবস্থানে নিয়ে গেছে যে আদালত পর্যন্ত বিষয়টি গিয়েছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নির্বাচন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, কতটা স্বচ্ছভাবে এই নির্বাচন হয়েছে। আমার মনে হয়, সিনেটের এই নির্বাচনে ভুল নেই।

ভিসির দায়িত্ব গ্রহণের পর এখনো ক্লাস নেন। কারণটা কি? জবাবে তিনি বলেন, আমি এই প্রশাসনিক কাজের পাশাপাশি আমার শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও কিছু সময় কাটাতে চাই। যে কোনো শিক্ষকের জন্য শ্রেষ্ঠ স্থান তার ক্লাসরুম। প্রথম বর্ষের সঙ্গে এই ক্লাসের মাধ্যমে আমি ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করি। প্রতি বছর নতুন ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে এই ক্লাসের মাধ্যমে কিছু কথা বলার সুযোগ থাকে। যোগাযোগের মূল বিষয়গুলো পড়ানোর একটা সুযোগ পাই। বিষয়টা আমি বেশ উপভোগ করি।

 

এমএসএল