'ভাষা ও ভাবনা' একুশে শিক্ষার্থীদের মনের কথা


Shakib Aslam | Published: 2024-02-21 18:24:01 BdST | Updated: 2024-04-28 12:35:43 BdST

অচিন কোথাও বাংলা ভাষা যখন প্রতিধ্বনি হয় তখন মনে হয় আপন কেউ কথা বলছে। তখন মনে ছুটে যায় বাংলাভাষী মানুষের কাছে। এ ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে নয় বরং 'বাংলা ভাষা' হিসেবে মান মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে লড়াই করেছিল বাংলার নিবেদিত অসংখ্য প্রাণ শুধু তাই নয় বাংলা ভাষার অস্তিত্ব ধূলিসাৎ থেকে রক্ষা করার জন্য বুক পেতে শাহাদত বরণ করেছে আমাদের পূর্বপুরুষগণ। গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয় আমাদের ভাষা শহীদদের এবং আমাদের সংগ্রামী চিন্তা-চেতনা, মুক্তি এবং স্বাধীনচেতা মনোভাব তাদের ধারায় পুনর্জীবিত হয়। বিশ্বের বুকে ৫২'র ২১ শে ফেব্রুয়ারির বাঙালি তরুণরা তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলা ভাষার প্রতি অগাধ ভালোবাসা প্রকাশ করেছিল এবং সেইসাথে বাঙালি জাতিসত্তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তাদের অসামান্য অবদান প্রজন্ম হতে প্রজন্ম পর্যন্ত প্রবাহিত করার দায়িত্ব আমাদের।

দেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানের তরুণ শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে 'ভাষা ও ভাবনা' নিয়ে নানা দিকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন ও গ্রন্থনা করেছেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক্যাম্পাসটাইম’র প্রতিনিধি মো. সাকিব আসলাম।

" আবার আন্দোলন হোক! তবে নিজের সাথে”

মোছা. মরিয়ম খাতুন
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

ভাষাপ্রেমীদের বায়ান্নয় ভাষা আন্দোলনে ভাষাপ্রেম আত্ম- বলিদানের মাধ্যমে বাঙালিরা রাষ্ট্রবাভাষা বাংলা হিসেবে বাংলাকে অর্জন করেছিল ৬৭ বছর আগে। ৯৯-এ আন্তর্জাতিক তকমা পেয়ে বিশ্বের কাছে বাংলা শব্দটি সম্মানিত হয়। কিন্তু এ অধিকার আদায় করতে যারা অদম্য ত্যাগ-তিতিক্ষা আর রক্তক্ষরণ করলো তাদের জন্য আমরা কিছুই করতে পারছি না।

বর্তমান সময়ে আধুনিকতার নামে আমরা সুন্দর বৈচিত্রময় মায়ের ভাষাকে কলুষিত করছি। ভাষার প্রতি সম্মান রেখে শুদ্ধতার সাথে বাংলা ভাষার চর্চা না করলে আগামী প্রজন্ম ভাষা আর ভাষার জন্য জীবন দেওয়া শহীদদের কৃতিত্ব ভূলে যাওয়া কেবল সময়ের ব্যবধান। ছোট বেলায় নগ্ন পায়ে চরম যত্নে মায়ের বানিয়ে দেয়া ফুলের তোড়া হাতে শহীদ মিনারে যাওয়া আজকাল আধুনিকতার সাথে আবেগহীন হয়ে গেছে। আমার মনে হয় ভাষার প্রতি আগের মতো শ্রদ্ধাবোধ ফিরিয়ে আনতে নিজের সাথে আবার সেই বায়ান্ন'র মতো ভাষা আন্দোলন করতে হবে। ভাষার মূল্যবোধ সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মের সম্মুখে তুলে ধরতে হবে। সুন্দর সাবলীলভাবে নিজে কথা বলতে হবে এবং নবাগত মানুষদের অনুপ্রাণীত করতে হবে।
নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য অনুমতি চাওয়া যুগে আবার আন্দোলন হোক! তবে নিজের সাথে।

ভাষার মাসের তাৎপর্য কি শুধু বই মেলাতে সীমাবদ্ধ থাকবে?
মোঃ প্রত্যয় বিন শাফী
প্রতিষ্ঠাতা, রিনিউ আর্থ

জানেন দাদা? আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না! ভবানী প্রসাদ মজুমদারের এই কবিতা অনেকটা বর্তমানে দৃশ্যমান হয়ে উঠে আমাদের তরুণ সমাজে। ভাষা আন্দোলনের মহত্ব যেন শুধুমাত্র এখন শহিদ মিনারে ফুল দেয়া আর একুশের বই মেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। মাতৃভাষা না নয়, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছিল রফিক,শফিক,জব্বার, শফিউরসহ আরও অনেক ভাষা শহীদদের। সেখানে এখন এক শ্রেণীর মানুষ বাংলাতে কথা বলতে গেলে বা যোগাযোগ করতে গেলে বলা হয় স্কীল বা দক্ষতার অভাব। তাহলে কি প্রয়োজন ছিলো ভাষা আন্দোলনের? কেউ তো মাতৃভাষা হিসেবে বাংলাকে অস্বীকার করেনি? সেই শ্রেণীর মানুষ গুলো বই মেলাতে বা ফেব্রুয়ারিতে বিভিন্ন সেমিনারে গিয়ে বলবে আমাদের বাংলাকে টিকিয়ে রাখতে হবে, চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। কথা গুলো আমার কাছে এক প্রকার ফুটবল এর মৌসুমি ভক্তদের মতো শোনায়। কারণ বাকি ১১ মাস চর্চা না করে এ ২৮ দিন বিভিন্ন সভায় বক্তব্য দিলে ভাষার প্রতি ভালোবাসা-শ্রদ্ধা ফুটে না।
বাংলা ভাষার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে সারাবছর এর চর্চা ও বাস্তবিক ব্যবহার অব্যহত রাখতে হবে। তা না হলে আগামীর তরুণ প্রজন্ম শুধু বই মেলাকে মনে রাখবে সংগ্রামকে নয়।

বাংলা ভাষা সর্বত্র গ্রহণযোগ্যতা পাক
আশরাফ বিল্লাহ (রবি)
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শিক্ষার পত্তন’ বাংলা ভাষার দুর্দশার কথা চিন্তা করে হয়তো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন উক্তি করেছিলেন। ভাষা ও সংস্কৃতি একটি জাতির প্রধান অনুষঙ্গ। পৃথিবীর কোনো দেশ তার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির বাইরে নয়। তাই পৃথিবীতে দেখা যায় শত শত জাতি-গোষ্ঠী শত শত ভাষা-সংস্কৃতি। এটা ঐতিহ্য, এটাই তার অস্তিত্ব। আর সেই অস্তিত্বে আঘাত বা অবক্ষয় কোনোভাবে ঘটতে দেয়া হয় না। মানুষ তার নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষায় ব্যাপৃত হয়ে ওঠেন। একটা গানে আমরা শুনতে পাই ‘আমরা বাঙালি ছিলাম রে’। ভিন দেশি বাদ্যযন্ত্রনির্ভর ভিন দেশি গানচর্চার আধিক্যের কারণে এই গান গাওয়া। যা আমাদের ভিন দেশি সংস্কৃতি থেকে ফিরে আসতে আহ্বান করে। আমরা আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি লালন করব এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

"যতই আকাশ গর্জায়,
তোদের আমার অস্থি মাংস মজ্জায়
ফিনিক দিয়ে উঠছে তবু
       বুকের বাংলা ভাষা—
এবার থেকে ঐখানে হোক নিত্যি যাওয়া-আসা।"

রেজওয়ান কবির রাহাত
তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশল বিভাগ,
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী।

-কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের কবিতার মতো বাংলা ভাষা সকল বাঙালীর বুকের ভাষা। জন্মের পরে প্রথম 'মা' বলে ধ্বনি উচ্চারণ করা মায়ের ভাষা। প্রিয়জনকে মনের বিস্মৃত সকল অনুভূতি উজাড় করে দেওয়ার ভাষা। কিন্তু কালক্রমে আমরা আজ আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সম্পুর্ণ টা-ই ছিল এই মাতৃভাষা বাচিয়ে রাখার সংগ্রাম। কিন্তু আজ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অবতরণ করার পরে যা দেখছি তা-তে আমার মতো অনেক শিক্ষার্থীর কাছে এখন প্রশ্ন, তবে কি আমরা আমাদের ভাষা ভুলে যাচ্ছি?

কবি জসীম উদ্দীন মুহম্মদ বলেছেন-
"তুমি কোনোদিন কাউকে বলো না—-
আমরা নাকি ভুলে যেতে বসেছি বাংলা ও বাঙ্গালির ইতিহাস?

তাঁরা অবাক হয়ে কেবল ভাবেন, এতোকিছুর পরেও আমরা কিভাবে চুপ করে আছি!

আমরা কি তবে আর বাঙালি নেই? এই প্রশ্ন তাদের কুড়ে কুড়ে খায়।"

আমাদের সরল সন্তানদের কাছে আজ 'মা' হয়ে উঠেছে পাশ্চাত্যের 'মম'। ক্যাম্পাসের বন্ধুদের আড্ডামহলে বাংলিশ বলতে না পারলে সে গ্রামের চাচাতো ভাই। এক অঞ্চলের বন্ধু অন্য অঞ্চলের ভাষা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে।পরিচয় পর্বে সিনিয়ররা-ও এই মজা নিতে ছাড়েন না।ইন্টারভিউ বোর্ডে বাংলা উপস্থাপনে সম্মানীয় শিক্ষকরাও সংকোচ বোধ করেন। আমি বলছি না, যে বাংলা ভাষার সাথে অন্য ভাষার অনুশীলন দরকার নাই, কিন্তু যদি এমন অবস্থা হয়ে যায় গাছের শেকড়ে পচন ধরিয়ে ডাল-পালার যত্নে মশগুল হয়ে যায়, কেমন হবে ব্যাপার টা!
আশাকরি আগামী দিনে, প্রত্যেক বাঙালী তার অহংকার, তার মাতৃভাষা বাংলাকে দেশ ও দশের কাছে তুলে ধরতে সংকোচ বোধ করবে না। সবার কাছে হয়ে উঠবে 'বুকের বাংলা ভাষা'।

ভাষার অপব্যবহার
কাজী আম্বিয়া
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ,
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। মায়ের মুখের ভাষা, প্রাণের ভাষা বাংলা। একটি শিশু যখন তার মায়ের মুখ থেকে শেখা ভাষার স্পষ্ট, শ্রূতিমধুর, গ্রহণযোগ্য, বোধগম্য এবং অর্থবহ'কে বিস্তৃত ও বাস্তবিক রূপ দেয়, ঠিক তখন আমরা ভাষার ব্যবহার বুঝতে পারি। কখন, কোথায়, কিভাবে আমাদের ভাষার ব্যবহার করতে হবে। এর প্রেক্ষিতে দেখা যায়, আমরা মাতৃভাষাকে নানান বর্ণে, রীতিতে এমন করে উপস্থাপন করে থাকি। যার ঠিক ব্যবহারের চাইতে অপব্যবহারটা অধিক থেকে অধিকতর হয়ে উঠছে। অন্যদিকে আমরা এটাও চিন্তা করতে পারি, যে একজন বোবা, কথা বলতে না পারা মানব যখন তাঁর নিজস্ব ভাষা উচ্চারিত করতে পারে না, বলতে পারে না, কিন্তু ঠিকই সে সব বুঝে উঠতে পারে, তবে কখনো ভাষার অপব্যবহার করে নাহ। তারা প্রকৃত মানব, যারা কিনা ভাষাকে শ্রদ্ধা করে, তার ব্যবহার কে সম্মানের সাথে দেখে এবং উপস্থাপন করে। সুতরাং, বাঙালি জাতির সর্বত্র স্মরণ করতে হবে যেন আমাদের অর্জিত বাংলা ভাষাকে অমর্যাদা না করি এবং কাউকে দেখলে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করি। এতে ভাষার মাস, বছর, যুগ, শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেও আমাদের ভাষার প্রতি অভিন্ন আবেগ রয়ে যাবে। আমাদের অস্তিত্বের ধারক ও বাহক বাংলা ভাষা তাই বাংলাকে আপ্রাণ ভালোবাসি।