শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও আধুনিক সেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) চালু হয় স্মার্ট আইডি কার্ড। একই বছরে ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ছয়টি অ্যাকসেস কন্ট্রোল গেট স্থাপন করা হয়। তবে মাত্র দুই মাস চালু থাকার পর গেটগুলো অকেজো হয়ে পড়ে। আধুনিক গেটগুলো অর্ধযুগ ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণে উদ্যোগ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এছাড়া আবাসিক হল, ইন্টারনেট সার্ভিস, পেমেন্ট সিস্টেম, মেডিকেল কার্ড ও লাইব্রেরি কার্ড, বাস কার্ডসহ ২৮টি সেক্টরে এ কার্ডের ব্যবহার নিশ্চিত করার কথা ছিল। এজন্য প্রতিটি কার্ড নিতে শিক্ষার্থীদের গুনতে হয় ৪০০ টাকা। তবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, শুধু চিকিৎসা কেন্দ্র ও ফরম পূরণের সময় ছাড়া আর কোনো কাজেই লাগছে না স্মার্ট কার্ড। প্রতিশ্রুত সুবিধাগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় কার্ডটি তাদের জন্য প্রায় অপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল শাখার তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালে সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ মিজান উদ্দিনের সময়কালে ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে কেনা হয়েছিল আধুনিক মানের ছয়টি প্রবেশাধিকার গেট। যার বর্তমান মূল্য ১ কোটি টাকার ওপরে। শুধু স্মার্ট কার্ডধারীরাই অ্যাকসেস কন্ট্রোল সিস্টেম মেশিনে কার্ড পাঞ্চ করে গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোয় প্রবেশ করতে পারবে বলে জানানো হয়েছিল। ফলে ভর্তির সঙ্গে স্মার্ট আইডি কার্ড বাবদ অতিরিক্ত ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবে গেটগুলো বসানোর মাস দুয়েক না যেতেই অকেজো হয়ে পড়ে। ব্যয়বহুল এসব মেশিন নষ্ট হওয়ার অর্ধযুগ পার হলেও মেরামত করা হয়নি।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, স্মার্ট আইডি কার্ডের মাধ্যমে ২৮টি সেক্টরে আধুনিক সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হলেও কোনো ক্ষেত্রেই কাজে লাগছে না। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্র ও ফরম পূরণের সময় ছাড়া আর কোনো কাজেই লাগে না স্মার্ট কার্ড। ঢাকার নীলক্ষেত থেকে ৫০ টাকায় তৈরি করা যায় এসব কার্ড। তাহলে বিনা সেবায় তারা কেন ৪০০ টাকা ফি দেবেন?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কার্ডে শিক্ষার্থীদের নাম, নিবন্ধন নম্বর, আইডি কোড, ছবি, বিভাগ, হল কোড, বর্ষসহ ব্যক্তিগত সব তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। এ কার্ড ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার নম্বরপত্র ও সনদ তোলা, গ্রন্থাগার, বিভাগ, ইনস্টিটিউট, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিস, হল অফিস এবং নিরাপত্তাবিষয়ক বিভিন্ন কাজ করার সুযোগ পাবেন বলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জানানো হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ফাহমিদুর রহমান বলেন, ‘স্মার্ট আইডি কার্ডের মাধ্যমে ২৮টি সেক্টরে সুবিধার কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে এটি কোনো কাজে আসে না। শুধু চিকিৎসা কেন্দ্র ও ফরম পূরণ ছাড়া আর কোনো কাজেই লাগে না। নীলক্ষেতে এ ধরনের স্মার্ট কার্ড ৫০ টাকায় পাওয়া যায়। অথচ আমরা দিচ্ছি ৪০০ টাকা।’
ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী হাসানাত কারীম জানান, অতিরিক্ত টাকা দিয়েও প্রতিশ্রুত সুবিধাগুলো পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। ৮৫ লাখ টাকায় কেনা গেটগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে। এত টাকা খরচ করে প্রকল্পের কোনো সুফল তারা পাননি। এটি শুধু টাকার অপচয়। ডিজিটালাইজেশনের নামে শুধু ফি নেয়া হচ্ছে, কিন্তু কোনো কার্যকর সেবা দেয়া হচ্ছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবন সূত্রে জানা যায়, স্মার্ট কার্ড বাবদ ২০১৬-১৭ সেশনের ৪ হাজার ১৪৫ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রায় ১৬ লাখ ৫৮ হাজার টাকা আদায় করা হয়। ২০১৭-১৮ সেশনে ১৬ লাখ ৪৭ হাজার ৬০০, ২০১৮-১৯ সেশনে ১৬ লাখ ৬৯ হাজার ২০০ ও ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ১৬ লাখ ৬০ হাজার ৪০০ টাকা আদায় করা হয়। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ৪ হাজার ৩৩২ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১৭ লাখ ৩২ হাজার ৮০০ টাকা আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত সাত বছরে কার্ড ক্রয় বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রায় ১ কোটি ১ লাখ ৩০ হাজার ৪০০ টাকা আদায় করা হয়েছে।
স্মার্ট কার্ডের দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক খাদেমুল ইসলাম মোল্ল্যা বলেন, ‘আমাদের একটা কার্ড কিনতে ২২০-২৩০ টাকা খরচ হয়। তাও আমরা কার্ড পাচ্ছি না। এখন কেউ যদি ৫০ টাকায় কার্ড দিতে পারে, তাহলে তাদের কাছ থেকে কার্ড এনে শিক্ষার্থীদের কম দামে দিতে পারব। আমরা যে কার্ড ব্যবহার করছি, সেটা রাজশাহী, ঢাকা ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবহার করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কার্ডের দাম ৫০০ টাকা নেয়। সেখানে আমরা তো কম-ই নিচ্ছি।’