
দেশে স্কুল পড়ুয়াদের বেশির ভাগের হাতে স্মার্টফোন, স্মার্টফোনের জনপ্রিয় অ্যাপগুলোর সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমের রাজা ‘ফেসবুক’ থাকবে এটা অনেকটা স্বাভাবিক। কেউ কেউ হাতে স্মার্টফোন না পেলেও বাসার ডেস্কটপ কম্পিউটারে ব্যবহার করছে ফেসবুক। এই ধারণার বাস্তব প্রমাণ ফেসবুকে অসংখ্য স্কুল পড়ুয়ার অ্যাকাউন্টের উপস্থিতি। ফেসবুক আসক্তির কারণে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ও সন্তান ‘রাত-দিন ফেসবুকে পড়ে থাকছে’ এমন অভিযোগ অনেক অভিভাবকের।
এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার আগে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম সাময়িক বন্ধের কথাও ভাবছে সরকার।
বাংলাদেশে ফেসবুক পরিস্থিতি আরও আঁচ করা যায় স্কুল-কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা শিক্ষার্থীদের ঘরের কথা শুনে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা এই প্রজন্ম স্মার্টফোন-ফেসবুকের প্রচলন দেখেছে আর তাদের ছোট ভাই-বোনরা পুরোপুরি বুঝতে শেখার আগেই খুলছে ফেসবুক আইডি।
ফেসবুক নীতিমালা অনুযায়ী ১৩ বছর বয়স হলেই ফেসবুক ব্যবহার করতে পারবে যে কেউ। তবে বিপত্তি দেখা দিয়েছে দেশের কিশোর-কিশোরীদের অতিমাত্রায় ফেসুবকে ডুবে থাকায়। পরিস্থিতি নিয়ে অভিভাবকদের উদ্বেগ জানা যায় রাজধানীর উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, জুনিয়র ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে গিয়ে।
উদয়নের গেটে সেকান্দার আলী নামের একজন অভিভাবক জানান তার সন্তান এখনো ফেসবুকের ব্যাপারে তেমন কিছু জানে না। সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছে সে। তবে নিজের এক আত্মীয়ের সন্তান ফেসবুক আসক্ত জানিয়ে বলেন: আমার এক নাতি মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে পড়ে। ওর বাবা-মার কাছে শুনেছি তাদের ক্লাস নাইনে পড়ুয়া ছেলে অতিরিক্ত সময় ফেসবুকে থাকে। নিষেধ করার পরও বহু রাত পর্যন্ত ফেসবুক ব্যবহার করছে সে। এমনকি বাবা মায়ের নজর এড়াতে গিয়ে লেপ-কম্বলের নিচেও মোবাইল চালায় সে।
আকরাম হোসেন নামের আরেকজন অভিভাবক জানান,বাসা-বাড়ির গণ্ডি পেরিয়ে স্কুলেও পৌঁছাচ্ছে ফেসবুক। স্কুলের নিষেধাজ্ঞা ফাঁকি দিয়ে ছেলে-মেয়ের হাতের মোয়া মোবাইলফোনটি কিভাবে যেনো ঢুকে যাচ্ছে ক্লাসেও।
কঠোরতার পরও তল্লাশী এড়িয়ে স্মার্টপ্রজন্ম স্মার্টফোন নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে স্বীকার করে উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক আসমা খাতুন বলেন: এতো কঠোরতার পরও মোবাইল ফোন সহ ক্লাস নাইনের এক ছাত্র ধরা পড়ে। আমরা দেখছিলাম তার রেজাল্টও খারাপ হচ্ছিলো। ওই ছাত্রের মাকে আমরা স্কুলে আসতে বলি। তিনি এসে বলেছিলেন আমরা (বাবা-মা) দু’জনেই ব্যস্ত থাকি। ও মোবাইল দিয়ে কী করছে সেটা তারা খেয়াল রাখতে পারেননি বলেই এমনটা হয়েছে।
এই শিক্ষকের নিজের মেয়ে দশম শ্রেণীতে পড়ছে তাই নিজে অভিভাবক হিসেবে তিনি মনে করেন সময় এবং প্রজন্ম দুইয়ের সঙ্গে সতর্কতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। কারণ আগের মতো কড়া শাসন, শারীরিক শাস্তির সুযোগ স্কুলে কিংবা বাড়িতে এখন নেই।
মেয়ের সঙ্গে মায়ের এই তাল রেখে চলার কথা তুলে ধরে এই শিক্ষক বলেন: আমি নিজে মা। আমি নিজেও ফেসবুক ইউজ করি। মেয়ে অভিযোগ করে ওর বন্ধুরা সবাই ফেসবুক ব্যবহার করে, আমি তাকে কেন দেই না। আমি তখন তাকে বলি, বয়স হোক ফেসবুক ব্যবহার করবে,অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ এখন সেটা আমি তোমার চেয়ে ভালো বুঝি।
তবে সব অভিভাবক শুধু এসব বলে প্রযুক্তি যুগের লাগামহীন ঘোড়ার পিঠে বসা সন্তানকে বোঝাতে পারবে না এই সত্যও স্বীকার করেন তিনি। তাই অভিভাবকদের অসহায়ত্ব থেকে যায় বলে মনে করেন তিনি।
শুধু ফেসবুক নয়। ফেসবুক ছাড়িয়ে এখন ইন্সটাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাটে ঝুঁকছে স্কুল পড়ুয়ারা। জুনিয়র ল্যাবরেটরিতে ক্লাস নাইনে পড়া ছোট বোনের কাছে ফেসবুকও এখন ‘ব্যাকডেটেড’ হয়ে গেছে জানিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বড় বোন বলেন: ফেসবুকে প্রচুর সময় দেয়। মেসেঞ্জারেই বেশি সময় থাকে। সেখানে গ্রুপ চ্যাট হয়, ঝগড়াঝাঁটিও হয় আবার সমাধানও নাকি সেখানেই আলাপ করে করে ফেলে। তবে এখন নাকি তার কাছে ফেসবুক পুরোনো লাগে তাই স্ন্যাপ করে (স্ন্যাপ চ্যাট ব্যবহার করে)।
শঙ্কা থাকলেও ফেসবুকের মতো নবপ্রযুক্তির সামাজিক মাধ্যম এড়ানোর সুযোগ নেই। সন্তানকে ধীরে ধীরে এই প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ড. সুমন দাস। নিজের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া সন্তানের জন্য একটি ফেসবুক আইডি খুলেছেন এই শিক্ষক।
তবে এটা কেবলই সন্তানের স্মরণীয় মুহূর্তগুলোকে টাইমলাইনে রাখতে খোলা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন: কয়েক বছর আগে ওর নামে আমরা একটি ফেসবুক আইডি খুলেছিলাম। এটা আমি আর ওর মা চালাই। এখানে ওর শৈশবের স্মৃতিগুলো ধরে রাখতেই এই আইডি যাতে বড় হয়ে সে দেখতে পারে। এখন ও ক্লাস টু-তে পড়ে। নিজে চালানোর সক্ষমতা তার হয়নি।
কিন্তু স্কুলের শিশুদের মাত্রাতিরিক্ত ফেসবুক এবং অন্যান্য মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে আসক্তির নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। কারণ অভিভাবককের পক্ষে সব সময় সন্তানের ওপর নজর রাখা সম্ভব হয় না।
কিন্তু এই উদ্বেগ-শঙ্কা প্রকাশ করে ফেসবুক ও সরকারের উপর দায় চাপানো যায় না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম।
তার মতে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিবর্তন হতে চলা সমাজে শিক্ষিত অভিভাবককে এখন প্রযুক্তি ব্যবহারেও শিক্ষিত ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
আগে অভিরুচি, বোধশক্তি গড়তে হবে মন্তব্য করে ড. নেহাল করিম বলেন: স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য কেউ ফেসবুক বন্ধ করতে চাইলে সফলতা আসবে এমনটা না। আমরা ভালো-মন্দ অনেক কিছু পাই। কোনটা নেবো, কোনটা নেবো না এটা বিবেচনাবোধ, অভিরুচির ব্যাপার। এসব মাত্র কয়েক ঘণ্টা স্কুলে থেকে শেখা যাবে না, সরকার শিখিয়ে দেবে না। এটা বাড়িতে বাবা-মা শিখিয়ে দেবে-বুঝিয়ে দেবে।
বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি এড়ানোর সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন: সমাজ বিজ্ঞানের একসময়ের ছাত্র এবং এখন অধ্যাপক হিসেবে এটা বলতে চাই সব কিছু দেখবো কিন্তু সব কিছু নেবো না। ভালো-মন্দের বিবেচনাবোধটা দরকার। টেলিভিশনে কত চ্যানেল আছে, আমরা তো সব চ্যানেল দেখি না। এখন সামাজিক মাধ্যমের মতো অন্যান্য প্রযুক্তি নির্ভরতার নতুন যুগে সন্তানকে অন্ধকারে তো রাখা যাবে না। একটা ফোনে পুরো পৃথিবী হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। ঝুঁকি সব নতুন কিছুতে আছে। এসবের ভালো-মন্দের জায়গাটি তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। বুঝিয়ে না বলে সরাসরি নিষিদ্ধ করে দিলে তারা আরও বেশি আগ্রহী হবে। সূত্র: চ্যানেল আই অনলাইন।
লিখেছেন: নাসিমুল শুভ।
টিআই/ ২৪ জানুয়ারি ২০১৮