কিশোরগঞ্জে ভারতীয় অবৈধ চিনির রমরমা কারবার চলছে। সীমান্তপথে চোরাচালানের মাধ্যমে আসা এসব চিনিতে সয়লাব জেলার বড়-ছোটসহ সব পাইকারী বাজার। অভিযোগ উঠেছে, কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেট এই চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে। এই সিন্ডিকেটে রয়েছেন তাঁর ঘনিষ্ঠজন ও অনুসারী ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা।
জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন চোরাচালানে আসা ভারতীয় চিনির ট্রাক ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে পাহারা দিয়ে নিরাপদে বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেন। এ জন্য তাঁকে ট্রাকপ্রতি ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। আর এ টাকা তিনি নিজের ব্যাংক হিসাব ও বিকাশের মাধ্যমে গ্রহণ করেন। তাঁর এই টাকা নেওয়ার প্রমাণ হিসেবে হোয়াটসঅ্যাপ-মেসেঞ্জারের স্ক্রিনশট গতকাল শনিবার রাত থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি একটি ভারতীয় চিনির ট্রাক পুলিশের হাতে জব্দ হওয়ার পর চোরাচালান সিন্ডিকেটের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। গত শুক্রবার (১৪ জুন) কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার নগুয়া বগাদিয়া তালতলা এলাকায় পাচারের সময় ভারতীয় চিনি ভর্তি একটি ট্রাক জব্দ করে পুলিশ। এ সময় ট্রাকটির চালক রাতুল ও হেলপার রাজিব এই দুইজনকে আটক করা হয়। এ ঘটনায় কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় এসআই মো. মারুফ কামাল বাদী হয়ে আটক হওয়া দুজন এবং শহরের নিউটাউন এলাকার জনি (৩৫) নামে এক যুবক ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি আল জুবায়েদ খান নিয়াজ এই চারজনের নামোল্লেখ এবং অজ্ঞাত ৫-৬ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি আল-জুবায়েদ খান নিয়াজের লোকজন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাঁরা চিনি চোরাচালানের সঙ্গে জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন জড়িত দাবি করে নানা রকমের পোস্ট দেওয়া শুরু করেন।
তাঁদের দাবি, জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন চিনি চোরাকারবারিতে জড়িত থাকলেও তাকে বাদ দিয়ে তারই প্ররোচণায় পুলিশ মামলায় জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি আল জুবায়েদ খান নিয়াজকে আসামি করেছে। ফেসবুকে একই রকম পোস্ট দিয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক লুৎফর রহমান নয়ন। তিনি লিখেছেন, ‘কিশোরগঞ্জে ভারতীয় চোরাই চিনির ব্যবসা করে কে, আর মামলা হয় কার নামে! এই ক্ষমতার খেলা আর বেশি দিন দেখাইতে পারবেন না জনাব।’
এদিকে কেবল অভিযোগ করেই পোস্ট নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযোগের পক্ষে তথ্য-প্রমাণও উপস্থাপন করা হচ্ছে। চিনি চোরাকারবারিদের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জারে জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমনের কথোপকথন এবং ব্যাংক একাউন্ট ও বিকাশ একাউন্টে টাকা লেনদেনের স্ক্রিনশট এখন ঘুরছে ফেসবুকের ওয়ালে ওয়ালে।
সরেজমিন জেলার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাইপথে আসা ভারতীয় চিনিতে সয়লাব পুরো কিশোরগঞ্জ। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে, জেলা শহর থেকে উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের বাজার এবং গ্রামের সাধারণ দোকানেও এসব চিনি ছাড়া অন্য কোনো চিনি মিলছে না। জেলা শহরের প্রধান পাইকারি বাজার বড়বাজারেই দৈনিক এক থেকে দেড় কোটি টাকার চোরাই চিনি কেনাবেচা হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। জেলা শহরের বিভিন্ন বাজার, করিমগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর, মরিচখালী ও পাকুন্দিয়া উপজেলার বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকায় দেশীয় পরিশোধিত চিনি ক্রেতারা খুঁজে পাচ্ছেন না। ফলে সবাইকে বাধ্য হয়ে ভারতীয় চিনি কিনতে হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চারটি উপজেলার ৬-৭টি রুট দিয়ে চোরাই পণ্য ঢুকছে কিশোরগঞ্জ জেলা শহরে। সবচেয়ে বেশি চিনি আসে চামড়া বন্দর দিয়ে।
অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন পথে চোরাই চিনি ট্রাকে করে প্রথমে জেলা শহরে প্রবেশ করাচ্ছে ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক কয়েক নেতা। এরপর এসব চিনির বস্তা পাল্টিয়ে দেশীয় নানা ব্র্যান্ডের স্টিকারযুক্ত বস্তায় ভরে এগুলো যাচ্ছে বিভিন্ন উপজেলায়, ইউনিয়ন পর্যায়ে এমনকি বিভিন্ন জেলা ও রাজধানী ঢাকাতেও।
এ বিষয়ে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক শাওন নিলয় ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেন, ‘কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন। ইদানিং ভারতীয় চিনি চোরাচালানের রমরমা বাণিজ্য করে আসছে। ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি চরম সংকটে।’
শহরের মানুষের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যও এ চোরাচালান চক্রের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের নিষ্ক্রিয়তা ছাড়া চোরাচালানের চিনি কয়েকটি উপজেলা পার হয়ে জেলা শহরের বড়বাজার পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব নয়।
ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য অনুযায়ী, আগে পুলিশ সদস্যদের ‘ম্যানেজ করে’ সড়কপথে ভৈরব ও নান্দাইল দিয়ে এবং নৌপথে চামড়া বন্দর দিয়ে ভারতীয় চিনি জেলা শহরে আসা হতো। তখন খুব কম সংখ্যক চিনি আসত। ছয় মাস ধরে ছাত্রলীগের কয়েকটি পক্ষ এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমান্ত দিয়ে চিনির ট্রাক ভৈরব-কিশোরগঞ্জ সড়ক দিয়ে ছাত্রলীগের কিছু কর্মী মোটরসাইকেলের পাহারায় এসব ট্রাক কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের বড় বাজারে নিয়ে আসে। একইভাবে নেত্রকোনা থেকে নান্দাইল দিয়ে আসা চোরাই চিনির ট্রাকগুলোর কিছু পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর ও কিছু গাইটাল এলাকা হয়ে ছাত্রলীগের কিছু কর্মী পাহারা বসিয়ে বড় বাজারে নিয়ে আসে। এছাড়া সুনামগঞ্জ থেকে ভারতীয় চিনির ট্রাকগুলো নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানা হয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল ও করিমগঞ্জ উপজেলা দিয়ে জেলা শহরের একরামপুরে ঢুকে। আর এই কাজে নেতৃত্ব দেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন।
এ ব্যাপারে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে আমার বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। ব্যাংক কিংবা বিকাশে আমি কোন চিনি ব্যবসায়ী কিংবা চোরাকারবারির কাছ থেকে টাকা নেইনি, নেয়ার প্রশ্নই আসে না। কেননা আমি চিনি চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত নই।’
এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘চিনি চোরাচালানে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তাঁদেরকেই মামলায় আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া মামলার তদন্তে যদি আরো কোন নাম পাওয়া যায়, তাদেরকেও আসামি করা হবে। এখানে পুলিশ কারো দ্বারা কোনভাবে প্রভাবিত হয়নি, আইন অনুযায়ী আমরা কাজ করছি।’
কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ বিপিএম-সেবা, পিপিএম (বার) বলেন, ‘চিনি চোরাচালান নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে আছে। আর কঠোর অবস্থানে আছে বলেই অভিযানে চিনি জব্দ হচ্ছে। চোরাচালানের সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, তাদেরকেই আইনের আওতায় আনা হবে।’
আজকের পত্রিকা