শহিদ আসাদ দিবস, কেন স্মরণীয় তিনি?


ঢাকা | Published: 2021-01-20 18:22:23 BdST | Updated: 2024-03-28 20:36:49 BdST

আসাদের নামে সেদিন গোটা জাতি পাগলপ্রায়। মুহূর্তে তিনি জাগ্রত জাতির হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। আসাদ নামটিতে সে কী জাদু আর অনুপ্রেরণা ভর করেছিল সেদিন!

বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ঢাকায় নির্মিত ‘আইযুব গেটে’-এর নামফলক ছুড়ে ফেলে দিয়ে নতুন নাম দেয় আসাদ গেট (এখনো বর্তমান)। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী বলে পরিচিত ‘আইয়ুব নগর’ নামটিও (বর্তমান শেরেবাংলা নগর) বদলে রাখা হয় আসাদ নগর।

মোটকথা, দেশের যেসব প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় আইয়ুব খান নামটি ছিল, সেসব প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা থেকে আইয়ুব খানের নাম তুলে দিয়ে শহিদ আসাদের নামটি বসানো হয়। এই সেই উনসত্তরের আসাদ।

শহিদ আসাদ দিবস আজ। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ এলে সবার আগে মনে আসে শহিদ আসাদের কথা। পুরো নাম আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। ২০ জানুয়ারি শহিদ হন তিনি। ১৯৬৯ সালের এই দিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে স্বৈরাচারবিরোধী বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আসাদের এ আত্মত্যাগ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করে তোলে।

‘খুনের বদলে খুন চাই, আইয়ুব খানের রক্ত চাই’, ‘আসাদের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না’, আসাদের মন্ত্র, জন-গণতন্ত্র’, ‘আইয়ুব মোনেম দুই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই’-এমন সব স্লোগানে মুখরিত হয় এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত; দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে আইয়ুববিরোধী ক্রোধের দাবানল। আসাদ হত্যার প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রদেশব্যাপী তিন দিনের শোক পালন শেষে ২৪ জানুয়ারি হরতালের ডাক দেয়।

সেদিনের মিছিলে পুলিশ আবারও গুলি চালালে ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র মতিউর রহমান প্রাণ হারান। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা শহীদ হলে গণ-আন্দোলন সর্বাত্মক রূপ নেয়।

আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিদান ও তাকে বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিতকরণ-এই সবকিছুই গণ-অভুত্থান পর্বের বিজয়। ইতিহাসের কেমন বাস্তবতা; আসাদ হত্যার মাত্র ৩৬ দিনের ব্যবধানে ২৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের ‘দণ্ডমুণ্ডের মালিক’ কথিত লৌহমানব প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

শহিদ আসাদ ছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতির মূলমন্ত্রে দীক্ষিত। শোষণহীন সমাজ ও মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। আসাদের বাড়ি বর্তমান নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার ধানুয়া গ্রামে। তার বাবা এমএ তাহের ছিলেন শিবপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ; অসাধারণ মেধাবী এবং অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি হিসাবে তাকে এলাকার সবাই সম্মানের চোখে দেখত। আর মা মতিজাহান খাদিজা খাতুন নারায়ণগঞ্জ শহরের খ্যাতনামা আইটি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক।

বর্ধিষ্ণু ধানুয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪২ সালে আসাদের জন্ম। পরিবারটি খুবই শিক্ষিত ও ছিমছাম। ছেলে শহিদ হওয়া তথা গণ-অভ্যুত্থানের পর দুঃসহ স্মৃতি বহন করে স্বাধীন দেশে আরও অন্তত ২৭ বছর বেঁচেছিলেন আসাদের শোক-বিহ্বল বাবা-মা।

সুপরিসর বাড়িটি এলাকায় ‘মিয়াজি বাড়ি’ নামে সমধিক পরিচিত। আসাদের বাবা এমএ তাহের ছিলেন খুবই পণ্ডিত ব্যক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে তিনি ইতিহাস বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাস করেন। ইসলামি ও আধুনিক শিক্ষার এক বিরল সমন্বয় ঘটেছিল তার মধ্যে। ‘তাহের মৌলবি সাহেব’ নামে তার ব্যাপক পরিচিতি।

বাবার এমন আদর্শের ছোঁয়ায় সন্তানরাও গড়ে ওঠে। তাহের-মতিজাহান দম্পতি এমনই পরম সৌভাগ্যবান যে, সেরা সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা শেষে ছয় ছেলে ও দুই মেয়ে প্রত্যেককেই তারা যার যার কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হিসাবে দেখে যেতে পেরেছেন।

শহিদ আসাদসহ তাদের দুই ছেলে (ইতিহাস বিভাগ) ও দুই মেয়ে (প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। দুই ছেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে পরবর্তীকালে বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেন।

সবার বড় কেএম খুরশীদুজ্জামান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও তৃতীয় ছেলে এফএম রশীদুজ্জামান বাংলাদেশ কারিগরি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। খুবই গৌরবের কথা যে, আমাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও এর নকশা তৈরিতে বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের সহযোগী হিসাবে দেশীয় প্রকৌশলী রশীদুজ্জামানেরও (শহিদ আসাদের পিঠাপিঠি অগ্রজ) অংশগ্রহণ রয়েছে।

শহিদ আসাদের বৃদ্ধ বাবা মারা যান ১৯৯৬ সালে আর রত্নগর্ভা মা আগের বছর ১৯৯৫ সালে। একমাত্র আসাদ ছাড়া সব সন্তানেরই লেখাপড়া, বেড়ে ওঠা ও কর্মোদ্যম-সবকিছু স্বচক্ষে দেখে যান তারা। আরও গর্বের কথা, তাদের একটি সন্তানের আত্মবলিদানের বিনিময়ে গণ-অভ্যুত্থান সফল পরিণতির দিকে এগোয়। আইয়ুবের পতন, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ-এই সবকিছুর মূল প্রেরণা আসাদসহ শহিদদের আত্মত্যাগ।

ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে আমার একজন প্রিয় শিক্ষক এইচএম মনিরুজ্জামান শহিদ আসাদের পিঠাপিঠি ছোট ভাই। স্যারের সঙ্গে কথা বললে আসাদ ও সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহসহ অনেক কিছুই জানা যায়। আসাদ তার বাবার শিবপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৬৩ সালে সিলেটের এমসি কলেজ থেকে (ছাত্ররাজনীতিতে অধিক মনোযোগী হয়ে এক বছর পিছিয়ে) আইএ পাস করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন। ছাত্ররাজনীতিতে একই আদর্শে বিশ্বাসী হওয়ায় এমসি কলেজে নুরুল ইসলাম নাহিদ (সাবেক শিক্ষামন্ত্রী) ও আসাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। উভয়ে ছিলেন হরিহর-আত্মা। আসাদ ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে অনার্স পাস করেন। ১৯৬৭ সালে এমএ পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণি না পাওয়ায় ফলাফল বাতিল করে ১৯৬৮ সালে তিনি আবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। একইসঙ্গে এবং একই বিষয়ে (ইতিহাস) সেবার আসাদের পাশাপাশি বসে এমএ পরীক্ষা দেন অনুজ এইচএম মনিরুজ্জামানও।

গণ-অভ্যুত্থানের এক মাস পর (ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯) ফলাফল প্রকাশ হলে দেখা যায় উভয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাস করেছেন। আসাদ ছিলেন ঢাকা হলের (বর্তমানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল) ৩০২ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র।

শহিদ আসাদ জীবনের বিনিময়ে আমাদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রইলেন। বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান লিখলেন: ‘আসাদের শার্ট’-আহা, সে কী কথামালা!’ আসাদের নামে ঢাকার আসাদ গেটের নামকরণ হলো।

নরসিংদীর শিবপুরে সরকারি শহিদ আসাদ কলেজ, শহিদ আসাদ কলেজিয়েট গার্লস হাইস্কুল, শহিদ আসাদ সরণিসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান-স্থাপনা আসাদের স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। সরকার ২০১৮ সালে আসাদকে স্বাধীনতা পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত করেছে। দীর্ঘদিনের দাবি স্কুলের পাঠ্যসূচিতে শহিদ আসাদের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা। এতে নতুন প্রজন্ম ভালো করে গণ-অভ্যুত্থান, শহিদ আসাদ ও তাদের আলোকিত পরিবারের কথা জেনে অনুপ্রেরণা পেতে পারে।

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক

//