সামাজিক অবক্ষয়ে সয়লাব সর্বত্র


মাহমুদুল হাসান জসীম | Published: 2017-10-06 15:48:44 BdST | Updated: 2024-05-10 08:18:56 BdST

অবক্ষয় শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘ক্ষয়প্রাপ্তি’। সামাজিক মূল্যবোধ তথা সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, ধৈর্য্য, উদারতা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃজনশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলি লোপ পাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলে সামাজিক অবক্ষয়। বর্তমান সময়ে আমাদের আপন সমাজে তা কেমন, তার অবয়ব সচেতন সামাজিক মাত্রেরই জানা। তথাপি নানাবিধ অপরিহার্য ব্যস্ততা হেতু আপন স্বার্থেই আপন চেহারা অবলোকন করে নেওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়।

আমাদের বর্তমান সমাজ কাঠামো ক্ষেত্রবিশেষে কেমন অবস্থায় রয়েছে? ক্ষেত্রবিশেষে বলতে দেশের বর্তমান আর্থ-ব্যবস্থা, রাজনৈতিক অবস্থা, শিক্ষাক্ষেত্রের অবস্থা, মূল্যবোধ ইত্যাদি সবকিছুকে বোঝায় বলে মনে করি। এক কথায় যদি এমত প্রশ্নের জবাব সন্ধান করতে চাই তাহলে বলব, মোটামুটিভাবে তেমন সুস্থ অবস্থায় নেই। বহু ক্ষেত্রে বিকৃতি গ্রাস করেছে, সুস্থ মূল্যবোধে ভয়ঙ্কর অভাব, ভীষণ অবক্ষয় এবং নৈতিকতার অভাব যা আমাকে বিশেষভাবে প্রবন্ধটি লিখতে
অনুপ্রাণিত করেছে।

১. আমার চোখে দেখা মজিদ (ছদ্মনাম) ভাটি বাংলার একজন নিন্মবিত্ত কৃষক। সামান্য কিছু জমিতে ধান চাষ, দু'তিনটে গরুই তার সংসারের এক মাত্র আয়ের উৎস। পাহাড়ী ঢল, অতিবৃষ্টি, হাওরের পানি; সব মিলিয়ে তলিয়ে যায় মজিদের সারাবছর সংসার চালানোর একমাত্র আয়ের পথ। তার উপর মজিদের স্ত্রী অসুস্থ। নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা, যদিও কিছু ব্যবস্থা করা যেতো তাও কেড়ে নিয়েছে সর্বগ্রাসী অভাব! মজিদ এর ছেলে তন্ময় ও মেয়ে হালিমা বাড়ি থেকে মাইল তিনেক দূরে একটা স্কুলে পড়াশোনা করে। অভাবের সংসারে এই ছেলে মেয়ে দুটোই মজিদ এর একমাত্র আশার আলো। মেয়েটি বড় হলে বিয়ে দিবে বড় কোন ঘড় দেখে। আর ছেলেটি বড় হলে একটা ট্রলার কিনবে। এইতো সুখ মজিদের; তখন হয়তো মজিদ ছেলের ট্রলারে করে টাঙ্গুয়ার হাওরে সূর্যাস্ত দেখতে যাবে।

দু'চোখ ভরে অনেক স্বপ্ন! কিন্তু, সব কিছু ভেস্তে যাচ্ছে পারিবারিক অভাবের জন্য। সমসাময়িক এমন অবস্থা সম্পন্ন আরও অনেক পরিবার আছে ঘেষপুর গ্রামে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য ঘেষপুর গ্রামে বর্ষার দিনে অনেক ভ্রমণ পিপাষু মানুষের আগমন হয়। প্রমত্তা হাওরের বুকে জোৎস্নার সৌন্দর্য অবলোকন করার জন্য কিছু কিছু ভ্রমণ পিপাষু সেখানে থেকেও যায়। সঙ্গতকারণেই তাদের সাথে মোবাইল, ক্যামেরাসহ নগদ টাকা পয়সা থাকে। হঠাৎ এমনি এক রাতে মজিদের
বাড়ির পাশের ঘাটে এক ভ্রমণকারী দলের আগমন হয়। প্রাণবন্ত ছেলেগুলো জোৎস্না মিশ্রিত রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য হাওরে ট্রলার ভাড়া করে থেকে যায়। রাত প্রায় ৩টার দিকে, হঠাৎ ট্রলারে ভীষণ সরগোল শুরু হলো। মজিদ এর সাথে আরও কিছু লোকজন এক সাথে আক্রমণ করলো ট্রলারে। মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেলো ভ্রমণকারীদের সব আনন্দ! সেটা বোধকরি খুব সুন্দর করে বুঝা গেলো বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা সাউন্ড বক্স দেখে! পরে ছেলেগুলি স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্যে ফেরত আসে। এভাবেই অভাববোধ কেড়ে নিচ্ছে বিবেক। সমাজের চোখে, আইনের চোখে সাধারণ মজিদের করে দিচ্ছে অপরাধী। উত্তরণের জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ও নৈতিক শিক্ষা।

২. আমি এমন একটা মফস্বল এলাকার কথা বলছি, যেখানকার ছেলেরা সারাদিনের কাজ শেষে বিকেলে একটা নির্দিষ্ট খেলার মাঠে খেলাধূলা করতো। ক্রমশ পরিকল্পনাহীন নগরায়ণের ফলে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ। ফলে খেলার জন্য মাঠ পাচ্ছে না। অলস বিকেলে খেলার সুযোগ না থাকায় ক্রমশ সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলছে। এরা সৃজনশীলতা হারিয়ে নেশার দিকে ঝুকে যাচ্ছে। বিভিন্ন ক্রিকেটিয় ইভেন্টে এবং খেলাধূলায় বাজি নামক জুয়ার দিকে ঝুকছে। আর বাজির টাকা পয়সার লেনদেন জনিত কারণে হচ্ছে চরম সমস্যা। যার ফলে আগ্রাসী হয়ে সামাজিক বন্ধন হারিয়ে যাচ্ছে।

৩. সজীব ৭ম শ্রেণীর ছাত্র। সে নব্য বিদ্যুতায়িত সমাজের বয়:সন্ধিকাল অতিরিক্ত করছে। জীবনের নতুন বাঁকে বাঁকে নতুন সব অভিজ্ঞতা হচ্ছে তার। এন্ড্রোয়েড ফোনে নতুন নতুন অনলাইন গেইমস্, নিজেকে বড় বড় বুঝাতে একটান-দু'টান ধূমপান তাকে রীতিমতো বাতাসে ভাসাচ্ছে! এসব করতে নূন্যতম টাকার দরকার হয়। দরিদ্র পরিবারে বহু জেদ করে হয়তো একটা মোবাইল কিনেছে, কিন্তু এর নিয়মিত ব্যয়ভার বহন করা তো তার পক্ষে সম্ভব না। অভাবী পিতাদের ব্যবহার বোধকরি সব সময় একটু খিটখিটেই হয়ে থাকে। তার বাবাও এর ব্যতিক্রম না। রোজ সকালে বাবার সাথে আর ঝগড়া করতে ভালো লাগছে না সজীবের। সে বন্ধুদের প্ররোচণায় বেছে নিয়েছে হাত টানের অভ্যাস। সে হয়তো দু'এক
জায়গায় ধরাও খায় এসব করতে গিয়ে। পরে আবার সব ঠিক এবং কিছুদিন পর পর এসব করে। এভাবেই চলছে আমাদের সমাজের হাজারও সজীব! এভাবে চলতে থাকলে একসময় পুরো সমাজটাই সজীবে ছেয়ে যাবে। এভাবেই অভাব ও সামাজিক বিনোদনের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধ। নৈতিক অবক্ষয় ও আগ্রাসী মানবিকতা তৈরি হচ্ছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইলেক্ট্রিকাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ (ইইই), জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

জেএইচ/ ০৬ অক্টোবর ২০১৭